ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

জাস্টিন গোমেজ

করোনা মহামারীতে প্রবীণদের ঝুঁকি

প্রকাশিত: ২০:৪৬, ১৩ অক্টোবর ২০২০

করোনা মহামারীতে প্রবীণদের ঝুঁকি

১৯৯০ সালে জাতিসংঘ পহেলা অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রবীণদের সুরক্ষা এবং অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি বার্ধক্যের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯১ সাল থেকে দিবসটি পালন করা শুরু হয়। প্রতিবছর প্রবীণদের নিয়ে প্রবীণ দিবস পালনের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য হলো, তাদের প্রতি আমরা যে গুরুত্ব দিচ্ছি তা যেন আমরা মূল্যায়ন করি। এ সময় আমাদের আরও ভাবতে আহ্বান হয়, পরিবারে থাকা প্রবীণদের প্রতি আমরা কতটা যত্নশীল? রাস্তাঘাটে কিংবা অন্য কোন স্থানে প্রবীণদের প্রতি আমাদের সহনশীলতা, ভদ্রতা সর্বোপরি উৎকৃষ্ট আচরণ বজায় থাকছে কি? তার চেয়েও বড় কথা, এই প্রবীণ-বৃদ্ধাদের কাছ থেকে কি কিছুই শিখিনি, কিছুই পাইনি, কিছুই পাচ্ছি না? যদি হ্যাঁ হয়ে থাকে, তাদের সম্মান করা, সহযোগিতা করা, তাদের পাশে থাকা কি দায়িত্ব ও কর্তব্য নয়? এবারে ২০২০ সালের ১ অক্টোবরের আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘চধহফবসরপং : উড় ঞযবু ঈযধহমব ঐড়ি ডব অফফৎবংং অমব ধহফ অমবরহম?’ অর্থাৎ ‘বৈশ্বিক মহামারীর বার্তা, প্রবীণদের সেবায় নতুন মাত্রা’ আর প্রতিপাদ্যটি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনূদিত ও নির্ধারিত। যা সকল ধরনের প্রচার-প্রচারণায় ব্যবহার করতে হবে বলে জানিয়েছে। বর্তমান সময়ের উপযুক্ত একটি প্রতিপাদ্য বিষয় বেছে নেয়া হয়েছে এবারের আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসের জন্য। সময়টা এখন কম-বেশি সবারই অস্বাভাবিক যাচ্ছে। সারা বিশ্বের এই সঙ্কটকালে প্রবীণরাই বেশি মাত্রায় ঝুঁকিতে আছে। এটা ছাড়াও প্রতিনিয়তই তাদের নিয়ে সমাচারে দেখা যায়, এ সময় তারা কর্মক্ষম হয়ে যায় বলে সংসার, পরিবার কিংবা সমাজে তারা হয়ে যায় অনেকটা মূল্যহীন। এমনও সমাচার রয়েছে, অনেকে প্রবীণদের সংসারের বোঝা মনে করে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে, কিংবা বাড়ি থেকে বের করে দেয়। ফলে তাদের অমর্যাদাকর করুণ পরিণতি বরণ করতে হয়। মহামারীর এই সঙ্কটকালে যেন আমরা সমাজের প্রবীণদের প্রতি আরেকটু বেশি নজর দিতে পারি সে জন্যই এই প্রতিপাদ্য নেয়া হয়েছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন আমার, আপনার ও সকলের পরিবারের প্রবীণ সদস্য এটা সবার কাছেই পরিষ্কার। বয়স্কদের মধ্যে অনেকেরই ভুলে যাওয়ার প্রবণতা আছে। এ ধরনের রোগীদের ক্ষেত্রে পরিবারের সবাইকে একটু বেশিই সতর্ক থাকতে হয়। সব সময় খেয়াল রাখতে হয়, তিনি মাস্ক ব্যবহার ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলছেন কিনা ইত্যাদি। প্রবীণদের দেখাশোনার ক্ষেত্রে প্রথম কথা হলো, আমাদের হয়ে উঠতে হবে তাঁদের ভরসাস্থল। তারপর করোনা সম্পর্কিত আলোচনা করতে হবে তাঁদের সঙ্গে। করোনা মহামারীকে পরিবারের প্রবীণ সদস্যের সামনে ভয়াবহরূপে তুলে না ধরে, সাধারণভাবে উপস্থাপন করুন এবং করণীয়-বর্জনীয় সম্পর্কে জানান। বর্তমানে বাড়ির প্রবীণ ব্যক্তি যিনি তার খাবার-দাবারে মনোযোগী হতে হবে খুব। বেলায়-বেলায় দরকার সচেতনতা। বিভিন্ন বার্ধক্যজনিত জটিলতার কারণে প্রবীণরা নিয়মিত ওষুধ খান। তাদের সেই ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস মজুদ রাখার বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। বাড়ির শিশুদের দায়িত্ব দিয়ে দেয়া যেতে পারে যেমন; দাদা-দাদি কিংবা নানা-নানির সঙ্গে মিলে হাত ধোয়ার কাজটা একসঙ্গে করা। খেলতে খেলতে একসঙ্গে হাত ধোয়ার কাজটি করলে প্রবীণ এবং শিশুর মধ্যে মধুর সম্পর্কটি আরও মধুর হবে। তাদের জন্য বরাদ্দ থাকুক আলাদা হ্যান্ড স্যানিটাইজার। আর এভাবে ব্যক্তিগত স্যানিটাইজারে জীবাণুমুক্ত থাকবেন তারা। আমাদের দেশের জন্য এটি একটি সত্যিই লক্ষ্যণীয় বিষয় যে, করোনা বা যে কোন দুর্যোগের সময় আমাদের দেশের তরুণরা প্রবীণদের সুরক্ষার দিকে আগে গুরুত্ব দেন। যেটি অন্যান্য দেশে দেয়া হয় না। বাংলাদেশে যখন করোনা সংক্রমণ শুরু হলো তখন দেখা গেল যে প্রবীণদের সুরক্ষা করার জন্য পারিবারিকভাবে অনেক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে, সামাজিকভাবে অনেক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশের কাছে আগে থেকেই তথ্য ছিল প্রবীণরা এই রোগে কাবু হন বেশি, তাই শুরু থেকেই পরিবারের সদস্যরা সমাজের সদস্যরা প্রবীণদের প্রতি আলাদা দৃষ্টি রেখেছিল। এ ছাড়াও প্রবীণরা নিজেরাও অনেক বেশি সচেতন ছিল। নবীনরা অবাধে ঘোরাফেরা করেছে, কিন্তু প্রবীণরা ঘরবন্দী থেকেছে, তারা অবাধে ঘোরাফেরা করেনি। ফলে ঘরে থাকার কারণে তারা নিরাপদ রয়েছে। এই তিন কারণেই মূলত বাংলাদেশে প্রবীণরা করোনায় ভাল আছে। ফলে এখনও পর্যন্ত দেখা গেছে, বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে প্রবীণরা কম, মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকেও প্রবীণরা তেমন কোন আতঙ্ক ছড়াচ্ছেন না। তাই প্রবীণদের যে রকম সুরক্ষিত করা হচ্ছে, বাংলাদেশে পরিবারে প্রবীণদের যেই পারিবারিক অবস্থান, সেটিও বিশ্বের কাছে একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে। শেষের কথায় বলতে চাই, প্রবীণদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হবে। প্রবীণদের যথাযোগ্য সম্মান, মর্যাদা ও সেবাপ্রদানের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। পরিবারে সন্তানদের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এ কথা সবাইকে মনে রাখতে হবে, প্রবীণরা পরিবার বা সমাজে বোঝা নন বরং তারা মূল্যবান সম্পদ। ‘পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন ২০১৩’ যেন শুধু আইনেই সীমাবদ্ধ না থাকে। এই আইনে বলা হয়েছে, পিতা-মাতার ভরণপোষণে ব্যর্থতার জন্য সন্তানের সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা অর্থদ- হতে পারে। অনাদায়ে তিন মাস কারাভোগেরও ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু এ আইন সম্পর্কে অনেকে জানে না। আর জানে না বলেই প্রয়োগও হচ্ছে কম। এ ছাড়া এ আইনে প্রবীণদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধার কথা উল্লেখ রয়েছে। আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ায় অনেক প্রবীণকেই অবহেলা-অসম্মান ও অনাদরে জীবনের শেষ সময়টা কাটাতে হয়। এর থেকে দ্রুত পরিত্রাণের জন্য সরকারী-বেসরকারী ও ব্যক্তি পর্যায়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ভাল থাককু আমাদের সমাজের প্রিয় প্রবীণজনেরা। কেননা তারা তো নবীন জীবনের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। লেখক : সাংবাদিক [email protected]
×