ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অনলাইন ক্লাসের সাত সতেরো

প্রকাশিত: ২০:২০, ১২ অক্টোবর ২০২০

অনলাইন ক্লাসের সাত সতেরো

॥ তিন ॥ করোনার আবির্ভাবে আমাদের প্রচলিত জীবন ধারায় নানা পরিবর্তনের একটি হচ্ছে শিক্ষায় অনলাইন ক্লাস চালু করা। যেহেতু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ সেহেতু অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষা জীবনকে সচল রাখার ন্যূনতম প্রচেষ্টা এটি। এর আগে কোনকালেই আমরা এমন কোন উদ্যোগ গ্রহণ করিনি। সঙ্গত কারণেই এই বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যায় না। আমাদের দেশে সকল খাতেই তথ্যের ঘাটতি থাকে। এটি একদমই নতুন ঘটনা। ফলে এই বিষয়ে তথ্য প্রাপ্তি আরও দুষ্কর। সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন সূত্র থেকে আমরা অনলাইন ক্লাস বিষয়ে আরও কিছু তথ্য ও মতামত সংগ্রহ করতে পেরেছি। গত ৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ দৈনিক ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি ফোরাম আলোচনার শিরোনাম ছিল অনলাইন ক্লাস শিক্ষা বৈষম্য বাড়াচ্ছে। এর মানে দাঁড়ায় যে অনলাইন ক্লাস পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের মাঝে বিরাজমান সামাজিক বৈষম্যের পাশাপাশি আরও একটি বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। অর্থাৎ কেউ অনলাইন ক্লাস করতে পারছে এবং কেউ পারছে না। ফলে একটি স্পষ্ট বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। ফোরামের আলোচনায় কেউ কেউ এটিকে ডিজিটাল বৈষম্যও বলেছেন। প্রকাশের সপ্তাহখানেক আগে অনুষ্ঠিত একটি আলোচনা সভার বরাত দিয়ে এই পত্রিকায় মন্তব্য করা হয় যে অনলাইন ক্লাস চালু করার ফলে পশ্চাদপদ ছাত্রছাত্রীরা ডিজিটাল ডিভাইডের শিকার হচ্ছে। ফোরামের আলোচনায় তুলে ধরা হয় যে সর্বপ্রথম শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস চালু করার সিদ্ধান্তের পর সেখানে এর বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন শুরু করে। এর কারণসমূহ উল্লেখ করা হয় যে প্রথমত বিশ্ববিদ্যালয়টির অনলাইন ক্লাস নেয়ার অবকাঠামো নেই। দ্বিতীয়ত অনেক ছাত্রছাত্রী প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করে তারা ইন্টারনেট পায় না। তৃতীয়ত আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা বস্তুত সরাসরি ক্লাসভিত্তিক, অনলাইন ক্লাস এখনও তার বিকল্প নয়। অনলাইন শিক্ষা অনেকটা স্বেচ্ছাশিক্ষার মতো। এ জন্য প্রয়োজনীয় টুল ও গাইডলাইন দরকার। আলোচনায় বলা হয় যে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষা ও শিক্ষা প্রশাসন কোনটাই অনলাইন ক্লাস করার উপযোগী নয়। আলোচনায় এই প্রসঙ্গও আসে যে শিক্ষকবৃন্দ অনলাইন ক্লাস করার জন্য দক্ষ কিনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষিকা সামিনা লুৎফা তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন এভাবে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী এমনকি খাবার পায় না। আমরা আমাদের বিভাগের খোঁজ নিয়ে দেখেছি যে খাদ্যের জন্য ৯০ জন ছাত্রছাত্রীকে মাসিক সহায়তা প্রদান করতে হয়। আমার ক্লাসে মোট ১৯৮ জন ছাত্রছাত্রীর মাঝে ১৪০ জন অনলাইন ক্লাসে যোগ দিয়েছিল তার মধ্যে মাত্র ৮০ জন শেষাবধি ক্লাস করেছে। তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভীতির কথাও উল্লেখ করেছেন। অনলাইনে ক্লাস নিলে নাকি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অনলাইনে ক্লাস নিতে গিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন লঙ্ঘন করার সুযোগ হতে পারে সেটি ভাবতেই অবাক হচ্ছি। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজীর শিক্ষক ফখরুল আলম জানান যে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষাদানের প্রচেষ্টা গ্রহণ করে ব্যর্থ হয়েছেন। নেত্রকোনা শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য হিসেবে তিনি তার অভিজ্ঞতার বিষয়টি জানান যে, শতকরা ৩০ ভাগ ছাত্রছাত্রী ইন্টারনেটের কাছেও নেই। তিনি বিরাজমান ডিজিটাল ডিভাইড দূর করার জন্য এখনই উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানান। শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. কামালউদ্দিন মনে করেন যে পর্যাপ্ত অবকাঠামো গড়ে তোলাটা অনলাইন ক্লাসের পূর্বশর্ত। অন্যদিকে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আতিকুল ইসলাম জানান যে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শতকরা ৯৩ ভাগ ছাত্রছাত্রী অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারছে। প্রাসঙ্গিকভাবে তিনি তার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ছাত্রছাত্রীদের জন্য শতকরা ২০ ভাগ ফিস মওকুফের কথাও জানান। তার মতে শতকরা ১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এই নতুন পরিস্থিতি মোকাবেলার সক্ষমতা রাখে না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী আনিকা জুলফিকার মনে করেন যে, অনলাইন ক্লাস ছাত্রছাত্রীদের পছন্দ নয়। আনিকার মতের প্রতিফলন অন্যান্য জরিপেও পাওয়া যায়। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. কায়কোবাদ মনে করেন নানা সমস্যা থাকার পরও বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তাদের অনলাইন ক্লাসেই যুক্ত হতে হবে- কেননা এখন তাদের আর কোন বিকল্প নেই। তিনি সরকারকে ফ্রি বা স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট প্রদানের ব্যবস্থা করারও আহ্বানও জানান। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য প্রফেসর ড. আলমগীর জানান যে অনলাইন শিক্ষা বিষয়ক একটি নীতিমালা প্রণীত হওয়া উচিত। তার দেয়া তথ্য মতে ১৯ হাজার ছাত্র ও ৭ হাজার শিক্ষকের মাঝে পরিচালিত এক অনলাইন জরিপ অনুসারে শতকরা ৭১ ভাগ ছাত্রছাত্রী ও ৬৩ ভাগ শিক্ষক অনলাইন ক্লাস নেয়ার বিপক্ষে। (https://www.the dailystar.net/opinion/news/online-classes-increasing-the-education-divide-1931409) ডেইলি স্টারের ফোরাম আলোচনার চাইতে ভিন্নতা নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। নিবন্ধটি প্রধানত কেমন করে অনলাইন ক্লাস নিতে হবে সেই বিষয়ক। সেই নিবন্ধটি থেকে কিছু মতামত তুলে ধরছি। ‘শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ আইডি দিয়ে অনলাইন ক্লাসে জয়েন করছে বটে, কিন্তু শিক্ষক হিসেবে প্রায়ই আমি সন্দিহান থাকি, ওরা আসলেই ক্লাস করছে কি না। কেউ কেউ ক্লাসে জয়েন করে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ডেটা স্বল্পতার কথা বলে ক্যামেরা চালু রাখতেও গড়িমসি করে অনেকে। সব মিলিয়ে অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।’ কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ শিক্ষক। (সঞ্জয় বসাক, দৈনিক প্রথম আলো, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০) আপনারা বিস্মিত হতে পারেন যে, আমেরিকানরা ২০১২ সালে অনলাইন ক্লাস নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১১ নবেম্বর ২০১২ ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়, NEW YORK -In a radical rethinking of what it means to go to school, states and districts nationwide are launching online public schools that let students from kindergarten to 12th grade take some-or all-of their classes from their bedrooms, living rooms and kitchens. Other states and districts are bringing students into brick-and-mortar schools for instruction that is largely computer-based and self-directed. Nationwide, an estimated 2,50,000 students are enrolled in full-time virtual schools, up 40 percent in the last three years, according to Evergreen Education Group, a consulting firm that works with online schools. More than two million pupils take at least one class online, according to the International Association for K-12 Online Learning, a trade group. Advocates say that online schooling can save states money, offer curricula customi“ed to each student and give parents more choice in education. A fwe states, however, have found that students enrolled full-time in virtual schools score significantly lower on standardi“ed tests, and make less academic progress from year to year, than their peers. Critics worry that kids in online classes donÕt learn hwo to get along with others or participate in group discussions. Some advocates of full-time cyberschools say that the disappointing results are partly because some of the students had a rough time in traditional schools, and arrive testing belwo grade level in one or more subjects. (https:/ww/w.foxnews.com/us/u-s-public-schools-turn-to-digital-education# ixyy1hevv1jDt) এরপর বিগত ৮ বছরে আমেরিকার শিক্ষা ব্যবস্থায় অনলাইন পদ্ধতি কতটা প্রভাব ফেলেছে তার সঠিক কোন তথ্য আমার হাতে এখন নেই। উইকিডিয়ায় (https://en.wikipedia.org/wiki/List_of_online_colleges_in_te_United_States) প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে আমেরিকায় ডিস্ট্যান্স এডুকেশন এ্যাক্রিডিটেসন কমিশন নামক একটি সংস্থা অনেকগুলো কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়কে অনলাইন কোর্স চালু করার অনুমতি দিয়েছে। করোনাকালে অনলাইনে ক্লাস নেয়ার জন্য এই সংস্থার স্বীকৃতির প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করার কোন কারণ নেই। ঘটনাচক্রে বাংলাদেশে দূরশিক্ষণ নামে অনলাইন শিক্ষা তো নেই-ই উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ই হচ্ছে একমাত্র প্রতিষ্ঠান যার সাহায্যে সরাসরি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিয়মিত ক্লাস না করে পড়াশোনা করা যায়। কি কারণে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইন কোর্স অফার করে না বা করতে পারে না সেটি আমার অজানাই। করোনার মাঝে বাস করে যারা এখন অনলাইন ক্লাস নিয়ে ভাবছেন তারা একটু লক্ষ্য করুন যে আমেরিকানরা শিক্ষা ব্যবস্থার অনলাইন রূপান্তর নিয়ে কত আগে কত কিছু ভেবেছে এবং এমন দশটা করোনাকে মোকাবেলা করার বিষয়টি কত সচেতনভাবে প্রয়োগের চিন্তা করেছে। খোঁজে দেখলাম আমিও ১৫ সালের এক লেখায় এই উদ্ধৃতিটি দিয়েছিলাম। এবারে আসুন দেখি ২০২০ সালে সারা দুনিয়া এই বিষয়ে কি বলছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম, যারা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কথা বলেছে তারা জানাচ্ছে কোভিড-১৯ এর জন্য বিশ্বের ১৮৬টি দেশের ১.২ বিলিয়ন ছাত্রছাত্রী ক্লাসরুমের বাইরে রয়েছে। এর ফলে বিশ্বজুড়ে ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থাটি বেড়েছে এবং শিক্ষা ব্যবস্থার নাটকীয় পরিবর্তন হয়েছে। গবেষণা বলছে যে অনলাইন শিক্ষার ফলে তথ্য ধারণ, সময়ের স্বল্পতা ইত্যাদি সুবিধাদি দৃশ্যমান হয়েছে। ফলে প্রতীয়মান হয় যে এই অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা হয়ত থেকেই যাবে। এই প্রতিষ্ঠানটিই জানাচ্ছে যে কোরিয়ায় ছাত্রছাত্রীরা অনলাইনে রোল কলের জবাব দিচ্ছে। সারা বিশ্বের শিক্ষা খাতে এই আকস্মিক পরিবর্তনের প্রভাব কি হবে সেটি এখন বিশ্ববাসীর গভীর ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম এমন তথ্য দিয়েছে যে ২০১৯ সালে সারা বিশ্বে ১৮.৬৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে কেবলমাত্র শিক্ষাপ্রযুক্তিতে। এমনটি ধারণা করা হচ্ছে যে ২০২৫ সালে বিশ্বের অনলাইন শিক্ষার বাজার ৩৫০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। যেসব খাতে বিশ্ব বাজারটি এত বড় হতে পারে সেগুলো হলো ভাষা এ্যাপ, অনলাইন টিউশনি, ভিডিও কনফারেন্সিং ও অনলাইন শিক্ষা সফটওয়্যার। https:/ww/w.weforum.org/agenda/2020/04/coronavirus-education-global-covid19-online-digital-learning/এমন তথ্যাদি আমাদের একটি নতুন সম্ভাবনার জগতের সন্ধান দিতে পারে। খুব সহজেই আমরা বলতে পারি করোনা যত আপদ বিপদই তৈরি করুক সারা দুনিয়ার ডিজিটাল রূপান্তরে একটি বিপ্লবী ভূমিকা পালন করেছে। এটি এখন অতি দ্রুত বিদায় নিলেই বাঁচি। তবুও আমরা এটি জানব যে ডিজিটাল বিশ্বের অন্যতম নিয়ামক ছিল করোনা। (আগামী পর্বে সমাপ্য) ঢাকা ॥ প্রথম লেখা ১ আগস্ট ২০২০ সর্বশেষ সম্পাদনা ১০ অক্টোবর ২০২০ ॥ (মতামত লেখকের নিজস্ব) লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান-সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক [email protected], www.bijoyekushe.net.bd, www.bijoydigital.com
×