ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মিহির কুমার রায়

টেকসই কৃষি উৎপাদন প্রয়োজন

প্রকাশিত: ২৩:৪৯, ১১ অক্টোবর ২০২০

টেকসই কৃষি উৎপাদন প্রয়োজন

জাতিসংঘ প্রণীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি)-২ তে উল্লেখ আছে ক্ষুধা থেকে মুক্তি, খাদ্যের নিরাপত্তা বিধান, পুষ্টির মানোন্নয়ন এবং কৃষি ক্ষেত্রে টেকসই কর্মপদ্ধতির বিকাশ সাধন। বর্তমান সরকার কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে নানাবিধ উপায়ে খাদ্য নিরাপত্তা বিধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যার সঙ্গে পুষ্টি উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনের সম্পর্ক রয়েছে। প্রকৃতিগত কারণে প্রতি বছর দেশে ১ ভাগ হারে কৃষি জমি হ্রাস পেলেও দেশে চালের উৎপাদন বেড়েছে ৩ গুণ, গমের উৎপাদন বেড়েছে ২ গুণ, সবজির উৎপাদন বেড়েছে ৫ গুণ এবং ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে ১০ গুণ। আবার আম উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশে^ প্রথম স্থানে, আলু উৎপাদনে ১০ম স্থানে এবং চাল উৎপাদনে বিশে^র চতুর্থ স্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, বাংলাদেশের ৫৭ শতাংশ গৃহস্থালি কৃষির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত যারা প্রবৃদ্ধিতে, পুষ্টি উন্নয়নে ও খাদ্য নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখছে বিশেষত শ্রমঘন, স্বল্প পুঁজি ও স্বল্প জমির প্রয়োজন হেতু। বিবিএসের বৈদেশিক বাণিজ্য পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে বিগত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে যথাক্রমে চামড়াজাত পণ্য (২০২৪.১০ কোটি টাকা), মাংস ও মাংসজাত (৯.৮৮ কোটি টাকা), প্রাণিজ উপজাত (১২৬.৮১ কোটি টাকা) অর্থাৎ সর্বমোট ২১৭৬ দশমিক ৭৭ কোটি টাকা। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ৯টির মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তা, সুষম খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিতকরণ, কর্মসংস্থান, নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে প্রাণিসম্পদ সংযুক্ত। এই খাতকে গুরুত্ব দিলে এসডিজি অর্জনে সহায়ক হবে বিশেষত গণতান্ত্রিক সরকার ভিশন ২০২১ অর্জনে জনপ্রতি দুধ ১৫০ মিলিমিটার, মাংস ১১০ গ্রাম এবং বছরে ১০৪টি ডিমের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে কাজ করে চলছে। দেশের কর্মশক্তির ২০ শতাংশ প্রাণিজ সম্পদ খাতে রয়েছে এবং ৪৪ শতাংশ আমিষ আসছে এ খাত থেকে। এছাড়া মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয় থেকে মৎস্য চাষে বিশে^র ৪র্থ স্থানে ও সার্বিকভাবে পঞ্চম স্থানে রয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মাছের উৎপাদন আগের চেয়ে ৮৪ হাজার টন বেশি, যা প্রায় ৫৩ শতাংশ বেড়েছে। দেশের জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান ৩ দশমিক ৬১ শতাংশ। এই অবস্থায় টেকসই উন্নয়নের জন্য গতিশীল কৃষির অবশ্যই প্রয়োজন আছে। কিন্তু বাস্তবে আমরা কি দেখছি যা থেকে মনে হয় সত্যিই কি কৃষির গুরুত্ব কমে যাচ্ছে? যেমনÑ জিডিপিতে কৃষির অবদান ক্রমেই কমছে আর শিল্প তথা সেবা খাতে তা ক্রমেই বেড়েই চলছে। বর্তমান অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে (এডিপি) কৃষি খাতে বরাদ্দ সবচেয়ে কম যেখানে পরিবহন খাতে রয়েছে সর্বোচ্চ ৩৭ হাজার ৫১৩ কোটি টাকা। বিশিষ্ট জার্মান অর্থনীতিবিদ জোসেফ সুমপিটার বহু বছর আগে বলেছিলেন, শিল্পায়ন হলো একটি ক্রিয়েটিভ ডেস্ট্রাকশন বা ভাঙা-গড়ার প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কম সম্ভাবনাময় খাত থেকে বেশি সম্ভাবনাময় যাতে সম্পদের পুনর্বণ্টন ঘটে থাকে। বিবিএসের তথ্য মতে ২০১৮ সালে আউশ, আমন ও বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি বিশেষত সিলেটের হাওড়াঞ্চলে অকাল বন্যা এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ব্লাস্ট রোগের কারণে। কিন্তু বর্তমানে দেশের চাহিদার তুলনায় চাল উৎপাদন বৃদ্ধি হওয়ায় চালের আমদানি নির্ভরতা এখন কমছে। ফলে দেশের কম-বেশি ৮০ শতাংশ মানুষের প্রধান খাদ্য মোটা চালের দাম প্রতি কেজি ৩০-৩৫ টাকা যা সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করে দেয়। এই গেল শস্য খাতে চাল উৎপাদন ও বিতরণের কথা। কিন্তু সার্বিক সামষ্টিক অর্থনীতির বিবেচনায় কৃষি অর্থনীতি এখনও অর্থনীতির সিংহ ভাগ সেখান থেকে কাঁচামাল সরবরাহ হয়ে শিল্প উৎসাহিত হয় এবং উৎপাদনের সরাসরি ভূমিকা রাখে যা খাদ্যপণ্য কিংবা ভোগ্যপণ্য উভয়েই হতে পারে। আবার কৃষি এখনও ৪২ দশমিক ৭ শতাংশ শ্রমশক্তির নিয়োজনের একটি নির্ভরযোগ্য ক্ষেত্র। জমির স্বল্পতার কারণে প্রান্তিক ক্ষুদ্র শ্রেণীর কৃষকের সংখ্যা বাড়ছে তারাই এখন দেশের খাদ্য নিরাপত্তার একমাত্র ভরসাস্থল যারা একখণ্ড জমিকে আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকে। তাদের জমিতে যথাযথ প্রযুক্তির উপস্থিতির ঘটালে এবং কর্মসংস্থান বাড়ালে তা টেকসই কৃষি উৎপাদন ও দারিদ্র্যবান্ধব হবে। এখানে খাদ্যের বাজারদর কম থাকলে কৃষি শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির জন্য চাপ কম থাকবে এবং শিল্প লাভজনক হবে। বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশের মোট গ্রামীণ শ্রমশক্তির শতকরা ১১ ভাগ কৃষি শ্রমিকে রয়েছে যাদের বয়স ত্রিশের উর্ধে এবং সনাতনী ধারণায় স্বল্প কিংবা অশিক্ষিত। বর্তমান বছরের বাজেটে কৃষি খাতের অংশ মোট বাজেটের মাত্র ৬ দশমিক ১ শতাংশ যার একটি বৃহৎ অংশ কৃষি ভর্তুকিতে চলে যাবে। ফলে উন্নয়ন খাতে তেমন কিছু থাকে না। তা ছাড়াও স্বাভাবিক ভর্তুকির অতিরিক্ত হিসাবে কৃষিজাত সামগ্রী রফতানির ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা হারে ছাড় প্রদান, কৃষি যান্ত্রিকীকরণের উন্নয়ন সহায়তার হার হাওড় ও দক্ষিণাঞ্চলের জন্য ৭ শতাংশ করা ইত্যাদি বলবৎ রয়েছে। এ বিষয়গুলো টেকসই কৃষি উন্নয়নের মানুষ্যসৃষ্ট কারণগুলোর ব্যাপারে প্রতিকারমূলক ও প্রাকৃতিক কারণগুলোর মোকাবেলায় উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
×