ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ব অর্থনীতি স্বাভাবিক হতে দীর্ঘ পথ বাকি

প্রকাশিত: ২৩:৪৮, ১১ অক্টোবর ২০২০

বিশ্ব অর্থনীতি স্বাভাবিক হতে দীর্ঘ পথ বাকি

অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে দেখলে কোভিড-১৯ মহামারীর ভয়াবহতম দিনটি ছিল গুড ফ্রাইডে। এ বছরের ১০ এপ্রিলের এই দিনটিতে অনেক দেশেই লকডাউন কঠোরতম রূপ ধারণ করে। ফলে মানুষজন নিজেদের বাড়িঘরে আটকা পড়ে থাকে। সব কর্মকা-ে স্থবিরতা নেমে আসে। ওইদিন বৈশ্বিক জিডিপি অন্য অবস্থায় যা হতে পারত তার চেয়ে ২০ শতাংশ কম হয়েছে। এর পর থেকে সরকারগুলো ক্রমান্বয়ে লকডাউন তুল নিয়েছে। অর্থনীতির পুনরুদ্ধার শুরু হয়ে যায়। পর্যবেক্ষকদের হিসেবে এ বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের তুলনায় তৃতীয় প্রান্তিকে জিডিপির বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ কি তারও বেশি হবে। যথেষ্ট আশাবাদের কথা সন্দেহ নেই। তবে বিশ্ব স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে এখনও দীর্ঘ পথ বাকি আছে। ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারগুলো এখনও সামাজিক দূরত্ব রক্ষার পদক্ষেপগুলো বলবত করে চলেছে। এর ফলে হোটেল-রেস্তরাঁয় খেতে আসা মানুষের উপস্থিতি কম হচ্ছে। স্টেডিয়ামগুলোতে দর্শকদের উপস্থিতি নিষিদ্ধ রয়েছে। এতে উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। ভোক্তাসাধারণ ও কোম্পানিগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এখনও রেকর্ড উচ্চতার কাছাকাছি। সম্ভবত এ কারণেই বিনিয়োগের ব্যাপারে কোম্পানিগুলোর মধ্যে দারুণ অনীহা বিরাজ করছে। গোল্ডম্যান স্যাকস নামক একটি ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী সামাজিক দূরত্ব রক্ষার বিধিব্যবস্থার কারণে বৈশি^ক জিডিপি থেকে ৮ শতাংশ হ্রাস পেয়ে চলবে। ‘দি ইকোনমিস্ট সাময়িকী গত এপ্রিলে বলেছিল যে লকডাউন তুলে নেয়া শুরু হলে বিশ্ব অর্থনীতি তার ৯০ শতাংশ ক্ষমতায় চলতে থাকবে। তবে এক্ষেত্রে শিল্প প্রতিষ্ঠান ও দেশসমূহের মধ্যে যথেষ্ট তারতম্যও আছে। কোনটি তুলনামূলকভাবে ও বিস্ময়করভাবে ভাল করছে। আবার অন্যগুলোর অবস্থা ভয়াবহ। পণ্যসামগ্রী ও সার্ভিস সমূহের তুলনামূলক অবস্থা বিচার করা যাক। পণ্যসামগ্রী দ্রুত আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। বিশ্বব্যাপী রিটেইল বা খুচরা বিক্রি গত জুলাই নাগাদ প্রাক-মহামারী স্তরে পুনরুদ্ধার লাভ করেছে বলে জেপি মরগ্যান চেজ নামে আরেকটি ব্যাংকের গবেষণায় দেখা গেছে। ভাইরাসের আক্রমণ শুরু হওয়ার সময় থেকে সরকারগুলো যে ২ ট্রিলিয়ন ডলারের নগদ প্রণোদনা দিয়েছে তা হাতে পেয়ে সারাবিশ্বের ভোক্তা সাধারণ ল্যাপটপ থেকে শুরু করে ডাম্ববেল পর্যন্ত নানা ধরনের জিনিসপত্র কিনে মজুদ করেছে। অর্থনীতিবিদরা যেমনটি ধারণা করেছিল তার চেয়েও বিশ্ববাণিজ্য কেন ভাল অবস্থায় থেকেছে এ থেকে তার ব্যাখ্যা মিলতে পারে। বিশ্বের কলকারখানাগুলো লকডাউনের সময় উৎপাদনের ক্ষেত্রে যতটুকু যা মার খেয়েছিল তার প্রায় পুরোটাই পুষিয়ে নিতে পেরেছে। সার্ভিস খাতের অবস্থা প্রাক-মহামারী যে স্তরে ছিল তারও যথেষ্ট নিচে নেমে গেছে। সেটা হয়েছে বহুলাংশে এই কারণে যে, লোকে ভিড় এড়িয়ে চলায় সার্ভিস শিল্প ঝুঁকির মুখে পড়েছে। রেস্তরাঁয় খেতে আসা লোকের সংখ্যা বিশ্বব্যাপী স্বাভাবিক অবস্থার সময়কার সংখ্যার তুলনায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কম রয়ে গেছে বলে এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়। বিমানের শিডিউলড ফ্লাইটের সংখ্যা মহামারী আঘাত হানার ঠিক আগে যা ছিল তার প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। অর্থনৈতিক কর্মকা-ের ক্ষেত্রে দেশগুলোর মধ্যে কে কতটা ভাল করেছে বা খারাপ করেছে সেই সংক্রান্ত তারতম্যটা আরও লক্ষণীয়ভাবে চোখে পড়ে। তবে এ বছর উৎপাদনের ক্ষেত্রে ধ্বংসের আকারটা এতই বিশাল যে তা থেকে বোঝা যায় যে দেশগুলোর প্রবৃদ্ধির হারের মধ্যে তারতম্যটা বিপুল। গত ১৬ সেপ্টেম্বর ধনী দেশগুলোর সংস্থা ওইসিডি এক নতুন অর্থনৈতিক পূর্বাভাস দিয়েছে যা তেমন একটা নিরানন্দ নয়। তার পরও ২০২০ সালে জি-৭ রাষ্ট্রগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে ভাল প্রবৃদ্ধি করেছে এবং সবচেয়ে খারাপ করেছে সেই সংক্রান্ত প্রবৃদ্ধিগত ব্যবধানটা ৬০৭ শতাংশ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এক দশক আগে বিশ্বব্যাপী সর্বশেষ অর্থনৈতিক মন্দা চলার সময় যেমনটি ছিল এটা তার চেয়েও অনেক বেশি। বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র চীন ২০২০ সালে অর্থনৈতিক প্রসার ঘটাতে পারবে বলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়। আমেরিকা ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো কিছু কিছু দেশের প্রবৃদ্ধি হবে নিম্নগামী, তবে তা মোটেই তেমন বিপর্যয়কর নয়। ১৭০৯ সালে ভয়াবহ মন্দার পর থেকে ব্রিটেন গভীরতম মন্দার সম্মুখীন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। মহামারী পরবর্তী প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে দেশগুলোর মধ্যে এই যে বিশাল ব্যবধান সেটা পরিসংখ্যানগত একটা হেঁয়ালি বলে কোন কোন অর্থনীতিবিদ মনে করেন। কিন্তু বাস্তবে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রে কে ভাল করেছে এবং কে খারাপ করেছে সেটা শেষ পর্যন্ত তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। প্রথমটি হচ্ছে শিল্পের গড়ন বা গঠন প্রকৃতি। গ্রীস ও ইতালির মতো দেশগুলো খুচরা ব্যবসা এবং আতিথেয়তার ওপর নির্ভরশীল। এই দেশগুলোকে সর্বদাই জার্মানির তুলনায় অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপন্ন দেখা গেছে। জার্মানিকে দেখা যায়নি কারণ জার্মানির বিশাল মেনুফ্যাচারিং খাত পণ্যসামগ্রীর বৈশ্বিক পুনরুজ্জীবন থেকে বরং লাভবান হয়েছে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে আস্থা। লকডাউনের সময়কার দেশের অভিজ্ঞতার দ্বারা এটা নির্ধারিত হয়। বিট্রেন করোনা মহামরী ভালভাবে মোকাবেলা করতে না পারায় দেশটির অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রে দুর্বলতা দেখা দিয়েছে। ব্রিটেনরা বাইরে অর্থনৈতিক কর্মকা- চালানোর ক্ষেত্রে অন্য ইউরোপীয়দের তুলনায় অধিকতর নার্ভাস হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। তৃতীয়ত হচ্ছে প্রণোদনা। আমেরিকা তার অর্থনীতির আকারের বিচারে বিশ্বের বৃহত্তম উদ্ধার কর্মসূচী নিয়েছে। ওই সিডি মনে করে যে এ বছর ধনী দেশগুলোর মধ্যে আমেরিকার অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের চিত্রটা হবে তুলনামূলকভাবে ভাল। বিশ্ব অর্থনীতির ৯০ শতাংশ সক্ষমতায় আসার পরবর্তী চিত্রটা কি হতে পারে? এর সুনিশ্চিত জবাব দেয়া কঠিন। কোন কোন দেশ আবার লকডাউনে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু অন্যরা অর্থনৈতিক উৎপাদনের ওপর বিরূপ প্রভাব না ফেলে সামাজিক দূরত্ব রক্ষার পদক্ষেপগুলো আরও ভালভাবে নির্ধারণ ও প্রয়োগ করত পারবে। তাতে কবে বিশ্ব ৯৫ শতাংশ অর্থনীতির কাছাকাছি চলে আসতে পারবে। বস্তুতপক্ষে ওইসিডি আশা করে যে এ বছর বৈশ্বিক জিডিপির আরও খানিকটা পুনরুদ্ধার ঘটবে। করোনার টিকা বের হলে এবং তা যথেষ্ট ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা হলে স্বাভাবিক অবস্থা দ্রুত ফিরে আসবে এমনটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। তবে এখানে যথেষ্ট কিন্তু আছে। বিনিয়োগের ব্যাপারে আজ ফার্মগুলোর যে অনীহা দেখা যাচ্ছে। তার অর্থ ভবিষ্যতে উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পাবে। আমেরিকার ক্রমবর্ধমান সংখ্যক শ্রমিক-কর্মচারীর ধারণা তারা আগের কাজে ফিরে যেতে পারবে না। পর্যবেক্ষকদের মতে আমেরিকায় বেকারত্বের হার মহামারীর আগে যেখানে ৪ শতাংশ ছিল ২০২৩ সালের আগে সেই অবস্থায় আর ফিরে যেতে পারবে না। তবে গোল্ডম্যান স্যাকস মনে করে যে সেটা হতে ২০২৫ সাল লেগে যাবে। তার আগে নয় যদিও এই ব্যাংকটি আশাবাদী যে শীঘ্রই করোনার টিকা ব্যাপক পরিসরে বিতরণ করা হবে। তবে যেটাই হোক করোনার কারণে বিশ্ব অর্থনীতির মন্দগতি বেশ কিছুকাল ধরেই চলতে থাকবে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×