ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ইউরোপজুড়ে ফের করোনা সংক্রমণ বাড়ছে

প্রকাশিত: ২২:৫৯, ১১ অক্টোবর ২০২০

ইউরোপজুড়ে ফের করোনা সংক্রমণ বাড়ছে

রশিদ মামুন ॥ ইউরোপে তাপমাত্রা কমতে থাকায় করোনার সংক্রমণ আবার তীব্র আকার ধারণ করেছে। অতীতে ইউরোপের যেসব দেশ করোনা প্রতিরোধে খুব ভাল অবস্থানে ছিল সে দেশগুলোতেও এখন প্রতিদিনের সংক্রমণ ছাড়িয়েছে হাজারের বেশি। বিশ্বজুড়েই করোনার দ্বিতীয় দফার সংক্রমণ বা সেকন্ডে ওয়েভ বেশ আলোচিত হচ্ছে। শীতের সঙ্গে করোনার একটি সংযোগ রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। অক্টোবরের শেষ বা নবেম্বরের শুরুতে দেশেও শীত পড়তে শুরু করবে। তখন করোনার নতুন রূপের প্রকাশ নিয়ে শঙ্কা জাগছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভাইরাসের বিস্তার একটুও কমেনি। মানুষ স্বাস্থ্যবিধি না মেনে বদ্ধ জায়গায় থাকলে বেশি বেশি আক্রান্ত হবেন এটি স্বাভাবিক। এজন্য নাগরিকের নিজের সচেতনতার সঙ্গে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন। জানতে চাইলে দেশবরেণ্য চিকিৎসক ডাঃ এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, শীত প্রধান দেশে এখন সংক্রমণের মাত্রা কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। সঙ্গত কারণে আমাদের দেশেও শীতে বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে বিশ্বজুড়ে এর বিপরীত চিত্রও রয়েছে। গরমেও সংক্রমণ বেড়েছে। তিনি বলেন, সবার আগে মানুষকে সচেতন হতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি আরও কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। বারবার হাত ধোয়ার অভ্যাসটির সঙ্গে মাস্ক পরতে হবে। অকারণে বাইরে ঘোরাফেরা করা যাবে না। তিনি বলেন, বদ্ধঘরে ভাইরাস বেশি বিস্তার লাভ করে। এজন্য ঘরে প্রচুর আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে। শীতে ভাইরাসজনিত সাধারণ জ¦র, সর্দিতেও মানুষ আক্রান্ত হন। এজন্য সকলকে সচেতন থাকতে হবে। ইউরোপের যেসব দেশে আবার করোনা বিস্তার শুরু করেছে সেসব দেশের দিন রাতের তাপমাত্রা সাত থেকে ২৪ ডিগ্রীর সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। তবে বেশিরভাগ দেশের দিন রাতের তাপমাত্রা নয় থেকে ১৪ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে রয়েছে। দেশে গত বছরের নবেম্বরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রার গড় ১৯ দশমিক ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস ডিসেম্বরে যা কমে ১৪ দশমিক ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসে নেমে যায় এবং জানুয়ারিতে যা আরও কিছুটা কমে ১২ দশমিক ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস হয়। তবে ফেব্রুয়ারি থেকে তাপাত্রা বাড়তে থাকে। গত ফেব্রুয়ারিতে দেশের গড় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৫ দশমিক ১ সেলসিয়াস। ফলে এখন ইউরোপের যে তাপমাত্রা রয়েছে আগামী মাস থেকে দেশের তাপমাত্রা কমে তার কাছাকাছি যেতে পারে। তবে ইউরোপে ওই সময় তাপমাত্রা আরও কমবে। দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ শুরু হয় গত মার্চে। মূলত তখন দেশের তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করেছিল। শীতের আগে কোন ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক না পাওয়াতে এবার শীতজুড়েই নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবে গোটা বিশ্ব। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার সংক্রমণ থেকে বাঁচতে এখন বারবার হাত ধোয়া, বাইরে থেকে বাসায় ফিরে ভাল করে সাবান মেখে গোসল করে থাকেন বেশিরভাগ মানুষ। শীতের কারণে নিজস্ব এই প্রতিরোধ ব্যবস্থা অনেক ক্ষেত্রেই কাজ করবে না। এতে সংক্রমণ আরও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া বদ্ধঘরের পরিবর্তে করোনা প্রতিরোধে দরজা-জানলা খোলা রাখার পরামর্শ দিয়ে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। শীতের হাড় কাঁপানো বাতাসের কারণে সাধারণত জানালা দরজা খোলেন না অনেকে। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে ইউরোপে খুব ভালভাবে করোনা সামলে আসা অস্ট্রিয়াতেও সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। দেশটিতে গত ২৬ মার্চ সর্বোচ্চ আক্রান্ত ছিল এক হাজার ৩২১ জন। আর গত ৮ এবং ৯ অক্টোবর যথাক্রমে আক্রান্ত ছিল এক হাজার ২০৯ জন এবং এক হাজার ১৩১ জন। ইউরোপের করোনা বিস্তারের চিত্র বলছে শনিবার লন্ডনের দিন রাতের তাপমাত্রা সাত থেকে ১৩ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করেছে। নিম্নমুখী এই তাপমাত্রার প্রভাবে সেপ্টেম্বর থেকেই করোনার প্রকোপ শুরু হয়েছে ব্রিটেনজুড়ে। গত ৯ অক্টোবর ব্রিটেনে নতুন আক্রান্ত হয়েছেন ১৩ হাজার ৪৬৪ জন। এর আগের দিন ৮ অক্টোবর যা ছিল ১৭ হাজার ৫৪০ জন। বিশ্বে মোট আক্রান্তের সংখ্যায় ১২ নম্বরে থাকা ব্রিটেনে জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত করোনার সংক্রমণ একেবারে কমে আসে। এসময় দৈনিক নতুন সংক্রমণ ৫০০ জনের নিচে নেমে আসে। বিশ^জুড়ে সংক্রমণের ৬ নম্বরে থাকা ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্পেনজুড়ে করোনা সংক্রমণ নতুন করে বেড়ে চলেছে। দেশটিতে মোট আট লাখ ৯০ হাজার ৩৬৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন। যার মধ্যে ৩২ হাজার ৯২৯ জনের মৃত্যু দেখতে হয়েছে স্পেনবাসীর। গত মে থেকে জুলাই আগস্ট পর্যন্ত সংক্রমণ কম থাকলেও এখন সেখানে সংক্রমণ যেমন বেড়েছে মৃত্যুও বেড়েছে তেমনই। গত ৯ অক্টোবর স্পেনে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজার ৯৮৬ জন। জুন-জুলাই এবং আগস্ট প্রায় মৃত্যু শূন্য ছিল স্পেন। কিন্তু এখন আবার সেই মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে চলেছে ৮ অক্টোবর সেখানে নতুন করে মারা গেছেন ২৪১ জন। মৃত্যুর এই সংখ্যা বৃদ্ধিই স্পেনবাসীর জন্য নতুন আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শনিবার দেশটির রাজধানী মাদ্রিদে দিন রাতের তাপমাত্রা ওঠানামা করেছে ৯ থেকে ২৪ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে। বিশ^জুড়ে সংক্রমণের ১০- এ থাকা ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের তাপমাত্রা শনিবার ওঠানামা করেছে ৯ থেকে ১৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। ৯ অক্টোবর দেশটিতে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ২০ হাজার ৩৩৯ জন। বিশে^ সংক্রমণের ১৭ তে থাকা ইতালিতে ৯ অক্টোবর আক্রান্ত হয়েছে পাঁচ হাজার ৩৭২ জন। ইতালির তাপমাত্রাও নি¤œমুখী। দিন এবং রাতে ১৮ থেক ২৪ ডিগ্রীর মধ্যে তাপমাত্রা ওঠানামা করছে। একই অবস্থা জার্মানির। সেখানেও নতুন করে করোনার সংক্রমণ শুরু হয়েছে। বার্লিন -এর তাপমাত্রা ছয় থেকে ১৩ ডিগ্রীর মধ্যে ওঠানামা করছে। দেশটিতে ৯ অক্টোবর করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন চার হাজার ৯৬৪ জন। অথচ এসব দেশে গ্রীষ্মজুড়ে সংক্রমণ কমে যাওয়াতে ধারণা করা হয়েছিল করোনা হয়তো এখান থেকে চলে গেছে। ইউরোপীয় দেশগুলোর সংক্রমণের চিত্র আশঙ্কা জানাচ্ছে আগামী শীত নিয়ে। ইতোমধ্যে সেকেন্ড ওয়েভ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকলকে সতর্ক করেছেন। জাতীয় রোগ তত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, ঠা-া বা গরমের সঙ্গে ভাইরাসের বিস্তারের সরাসরি কোন সম্পর্ক নেই। তবে শীতের সঙ্গে বিস্তারের পরোক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। অতিরিক্ত শীতে মানুষ বদ্ধ জায়গায় থাকে। এই পরিবেশ ভাইরাস বিস্তারের জন্য উপযুক্ত। গরমের কারণেও যদি বেশি মানুষ একই জায়গাতে থাকে তাহলেও করোনার বিস্তার ঘটতে পারে। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে রোগী শনাক্ত করে দ্রুত তাকে আলাদা করতে হবে। দ্বিতীয়ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। ঘরের মধ্যেও অনেক লোক এক জায়গা থাকলে বারবার হাত ধোয়া এবং মাস্ক পরার অভ্যাস করতে হবে। তিনি বলেন, এজন্য শুধু মানুষকে দোষ দিলেই হবে না। স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে সরকারকে কঠোর হতে হবে। শুধু করেন করেন করলাম, আর হয়ে গেছে বললেই হবে না। সংক্রমণের শুরুতে মানুষ যেভাবে ভয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানতো এখন সেভাবে মানছে না। ফলে যারা এটা করছে না তাদের করতে বাধ্য করতে হবে। এখন অনেকে করোনা হওয়ার পরও টেস্ট করাতে আসছেন না। তাদের জন্যও বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয় এমন উদ্যোগ নিতে হবে।
×