ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

উচ্চ আদালতে ঝুলে আছে ধর্ষণ মামলা

প্রকাশিত: ২২:২০, ১০ অক্টোবর ২০২০

উচ্চ আদালতে ঝুলে আছে ধর্ষণ মামলা

বিকাশ দত্ত ॥ চলন্ত বাসে সিরাজগঞ্জের রূপাকে ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় চারজনের ফাঁসির রায় হয়েছে ২০১৮ সালে। ডেথ রেফারেন্স হিসেবে মামলাটি হাইকোর্টে এলেও দুই বছর ধরে রয়েছে ফাইলবন্দী। সর্বশেষ গত বছরের ২৯ অক্টোবর ফেনীর সোনাগাজী মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলায় ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত ১৬ আসামির ডেথ রেফারেন্স ও মামলার যাবতীয় নথি হাইকোর্টে আসে। মামলাটি এখন শুনানির অপেক্ষায়। প্রধান বিচারপতি বেঞ্চ গঠন করে দেয়ার পরই শুনানি শুরু হবে। শুধু নুসরাত জাহান রাফি নয়, উচ্চ আদালতে ঝুলে আছে ধর্ষণসহ এমন অনেক চাঞ্চল্যকর মামলা। বিচারিক আদালতের রায়ের পর হাইকোর্টে এসে আটকে যাচ্ছে, গড়াচ্ছে বছরের পর বছর। ১৮০ দিনের মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা নিষ্পত্তির আইনী ও হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও বিচারিক আদালতও তা মানছে না বলে অভিযোগ আইনজীবীদের। গত দুই বছরে ছয়বার পিছিয়েছে ধর্ষণ মামলার রায়। আদালত পাল্টেছে দুইবার। জামিনে থাকা আসামি এখন লাপাত্তা। রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় দায়ের করা মামলায় বিচার পাওয়ার আশা আর ধরে রাখতে পারছেন না নির্যাতিতা। বিচারের আশায় দুই বছর ধরে আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। জামিনে থাকা আসামির ভয়ে কোণঠাসা এই নির্যাতিতা। নির্যাতিতা জানান, আমি শুধু ন্যায় বিচারের আশায় হাইকোর্ট ও জজকোর্টের বারান্দায় ঘুরছি। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী স্বীকার করলেন, জটের কারণে মনোযোগ হারায় মামলাগুলো। এদিকে নজর না রাখলে এত মামলার জটে এই মামলাগুলো রেডি করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। বর্তমানে যে অবস্থা চলছে, তাতে এর জন্য বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এসব মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির দাবি জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মীরা। ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে উচ্চ আদালতে আলাদা বেঞ্চ গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন তারা। তা না হলে জনগণের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যাবে। বর্তমানে উচ্চ আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৫ লাখ ১২ হাজার ৬৮৫টি মামলা। পাশাপাশি নিম্ন আদালতে ধষণ মামলা বিচারের ক্ষেত্রে কার্যকর হচ্ছে না হাইকোর্টের দিক-নির্দেশনা। উচ্চ আদালতসহ নিম্ন আদালতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি, মামলার বাদী বিশেষ করে পুলিশ যারা সাক্ষী দিতে আসে তারা না এলে তাদের প্রমোশন স্থগিত করা, ধর্ষণ মামলায় হাইকোর্টে আলাদা বেঞ্চ গঠন করার আহ্বান জানিয়েছেন ্সাবেক বিচারপতি, আইন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীরা। অন্যদিকে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড করতে বিদ্যমান নারী-শিশু নির্যাতন দমন আইনও সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞগণ। একটি সূত্র জানায়, ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবনের পরিবর্তে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে চলতি সপ্তাহেই রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারি হতে পারে। সূত্র আরও জানায়, এখন সংসদ অধিবেশন নেই। যে কারণে আশু পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রী আগামী সোমবার রাষ্ট্রপতি বরাবর বিল আকারে সামারি পাঠাবেন। সংশোধিত ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০’-এর খসড়া আগামী সোমবার মন্ত্রিসভা বৈঠকে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনার পর মন্ত্রণালয় আইন সংশোধনের এই উদ্যোগ নিয়েছে বলেও জানান আইনমন্ত্রী। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী বর্তমানে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড। দেশে সাম্প্রতিক কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনার পর ধর্ষণকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- করার দাবি তোলার মধ্যে সরকার শাস্তি বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন, ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধনের জন্য একটি প্রস্তাব আগামী সোমবার মন্ত্রিসভা বৈঠকে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ জনকণ্ঠকে বলেন, যদি হাইকোর্ট নির্দেশনা দিয়ে থাকে, তা মানা না হয়, তা হলে সেটা হবে আদালত অবমাননা। সে লক্ষ্যে কেউ যদি হাইকোর্টের নজরে আনে নিশ্চয়ই হাইকোর্ট প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তা না হলে মানুষের যে আস্থাস্থল সর্বশেষ বিচার সেটা হলো বিচার বিভাগ। আমরাও চাই বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে এবং অত্যন্ত তড়িৎ গতিতে মানুষের যে আশা-আকাক্সক্ষা, সুবিচার পাওয়া তা প্রতিষ্ঠিত করবে। এটা যদি দীর্ঘদিন, বছরের পর বছর বিচার না হয়, তা হলে শাস্তি হবে না, বিচার হবে না। দেখা যাচ্ছে, ৮ বছর ধরে ধর্ষণের মামলায় সাক্ষী আসছে না। কাজেই আমি সব সময় বলে আসছি, যে মুহূর্তে মামলা হবে, তড়িৎ গতিতে পুলিশ তার তদন্ত করবে। তদন্ত কাজ শেষ করে আদালতে দেবে। তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করলে বিচার কাজ শুরু করবে। বিচার কাজ শুরু হলে কখনও তা মুলতবি করা যাবে না। রাষ্ট্রপক্ষের দায়িত্ব হবে সাক্ষীকে হাজির করানো এবং তড়িৎ গতিতে বিচার শেষ করা। তিনি আরও বলেন, হাইকোর্টে মামলা জটের ফলে ধর্ষণ মামলায় আলাদা বেঞ্চ গঠন করা যেতে পারে। একই সঙ্গে আইনমন্ত্রী আইন সংশোধনের যে কথা বলেছেন সেটা খুবই ভাল উদ্যোগ। আইন সংশোধন করে ধর্ষণ মামলায় প্রাণদ-ের ব্যবস্থা করলে অনেকাংশে ধর্ষণের প্রবণতা কমবে। হাইকোর্ট ধর্ষণের বিষয়ে সাত দফা নির্দেশনা দিয়েছিল। সেখানে সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের সব ধরনের আইনী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়ে আদালত বলেছে, তিন-চার বছরের বাচ্চারা ধর্ষিত হবে, মামলার বিচার কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হবে না, তা দুঃখজনক। আলাদা তিনটি ধর্ষণ মামলার আসামিদের জামিন শুনানিতে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোঃ মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ ঐ আদেশ প্রদান করেন। ধর্ষণ কিংবা ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা মামলার বিচার করতে নিম্ন আদালতের বিচারক, পাবলিক প্রসিকিউটর, সাক্ষী, পুলিশ, চিকিৎসক বা মামলার অন্যান্য বিশেষজ্ঞের প্রতি সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে এই সাত দফা নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কিন্ত হাইকোর্টেও ওই নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (১) ধারায় ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন এবং ৯(২) ধারায় ধর্ষণের কারণে মত্যু হলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান রয়েছে। জানতে চাইলে আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মোঃ নিজামুল হক নাসিম জনকণ্ঠকে বলেন, দেশে এখন ধর্ষণ মারাত্মক অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। শক্ত হাতে এগুলো দমন করতে হবে। হাইকোর্টে ধর্ষণ মামলার জন্য আলাদা বেঞ্চ গঠন করা ভাল। তা না হলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ মামলাগুলোর শুনানি করতে হবে। আইনের বইতে অনেক কিছু লেখা আছে, লেখা থাকলে কি হয়। সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী স্বপন কুমার রায় বলেছেন, ধর্ষণ মামলার বিচার কার্যক্রম দ্রুত না হওয়ার ফলে আসামিরা দ্রুত জেল থেকে বের হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার পাওয়া যায় না। এ সমস্ত মামলা দ্রুত তদন্ত করে তাড়াতাড়ি বিচার করতে হবে। সাক্ষী না এলে বিচার বিলম্বিত হয়। এ ছাড়া পর্নোগ্রাফি রোধ আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। আইনমন্ত্রী ইতোমধ্যে বলেছেন, আইন সংশোধন করে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- করা হবে। এটা খুবই ভাল উদ্যোগ। এর ফলে ধর্ষণের হার অনেকাংশে কমে যাবে বলে মনে করি। ২০১৮ সালে অস্ত্রের মুখে ধর্ষণের পর হাতিরঝিলে মামলা করেন এক নারী। আসামিরা ছাড়া পেয়ে যায়। কোর্ট বদলি হবার কারণে আগের তারিখ পিছিয়েছে ৫ বার। মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, আসামি আসলাম কৌশলে নিজ বাসায় নিয়ে যায় বাদীকে। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তাকে ধর্ষণের অভিযোগে ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট হাতিরঝিলে মামলা করা হয়। প্রায় দেড় বছর মামলা চলার পর আদালতের প্রতি অনাস্থার কারণে উচ্চ আদালতের নির্দেশে চলতি বছরের আগস্টে ট্রাইব্যুনাল বদল করা হয়। মামলাটি নারী ও শিশু নিয়াতন ট্রাইব্যুনাল-৭ থেকে ৫ এ বদল করা হয়েছে। নারী ও শিশু আদালত আসামিকে জামিন দেয়ার পর ঐ বিচারককে তলব করে আপীল বিভাগ। পরবর্তীতে আসামি আসলাম শিকদারের জামিন বাতিল করা হয়। ওইদিন সাবেক এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতে বলেছিলেন, সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ স্থগিতাদেশ থাকার পরও আসামিকে নিম্ন আদালতের জামিন দেয়াটা আদালত অবমাননার শামিল। এ প্রসঙ্গে সুপ্রীমকোর্টের ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিনুদ্দিন মানিক বলেন, হাইকোর্টের সাত দফা নির্দেশনা আছে। সবাইকে তা মানা উচিত। বিভিন্ন দেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড রয়েছে। আমাদের এখানেও সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা। পাশাপাশি ধর্ষণ মামলা দ্রুত বিচার করা। হাইকোর্টে বেশ কিছু ধর্ষণ ও হত্যা মামলা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি ইতোমধ্যে মামলা জট নিরসনে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। যাতে করে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করা যায়। যে সমস্ত মামলার বাদী বা তদন্ত কর্মকর্তা আছেন তাদেরকে নিয়মিত আদালতে সাক্ষী প্রদান করতে হবে। যদি কোন সাক্ষী যারা পুলিশ সাক্ষী দিতে না আসে তা হলে তাদের প্রমোশন স্থগিত করা যেতে পারে। তা হলে সাক্ষী আসা বন্ধ হবে না। আইনজীবীদের অভিমত, যাবজ্জীবন সাজার মেয়াদ শেষ হলে জেল থেকে বের হয়ে অনেক সময় একই অপরাধে আবারও জড়ায় অপরাধীরা। সে ক্ষেত্রে শাস্তির মাত্রা মৃত্যুদন্ড হওয়া উচিত। এ প্রসঙ্গে আইন ও শালিস কেন্দ্রের সেক্রেটারি জেনারেল মোঃ নুর উদ্দিন খান বলেছেন, মৃত্যুদ-টি একটি হাতিয়ার, আমি তা মনে করি না। যতটুকু আইন আছে সেটাই যদি প্রয়োগ করা হয়, তা হলেই সমাজের অপরাধ এবং দুর্বৃত্তায়ন নিবৃত্ত করা সম্ভব। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যিনি পাহারাদার থাকবেন, সেই পুলিশ বাহিনী তার দায়িত্ব যতটা পালন না করে তার চেয়ে কাউকে খুশি করার জন্য বেশি করে। ফলে ঐখানেও শৃঙ্খলা শৈথিলতা লক্ষ্য করি। সেখানে আস্থার অভাব থাকে। বেগমগঞ্জের ঘটনা একমাস পর যখন ভিডিও ভাইরাল হলো, তখন পুলিশ তৎপর হয়ে উঠল। এক্ষেত্রে মানুষের আস্থায় ফিরে আনতে হবে। সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এ উদ্যোগটি রাষ্ট্রের গ্রহণ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, শুধু ধর্ষণের ক্ষেত্রে নয়। যে কোন অপরাধের ক্ষেত্রে এক ধরনের বেপরোয়া ভাব লক্ষ্য করছি। বিচারহীনতা শুধু দীর্ঘসূত্রতা নয় অন্য কারণও আছে। আমরা লক্ষ্য করছি পেশীশক্তি, অর্থশক্তি এবং রাজনৈতিক শক্তি এর যে কোন একটি শক্তি থাকলে কোন অপরাধ ঘটিয়ে পার পাওয়া যাবে, এমন একটা ধারণা মানুষের মধ্যে বদ্ধমুল এসেছে। আর যদি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় আসে সে এতটাই বেপরোয়া হয়ে যায় কল্পনাও করে না তাকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব। ২০১৯ সালের ১৮ জুলাই হাইকোর্ট সাত দফা নির্দেশনা প্রদান করে। সেই সাত দফা নির্দেশনা দিয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, প্রথম দফা : দেশের সব নিম্ন আদালতকে ধর্ষণ এবং ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা মামলাগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আইনের নির্ধারিত সময়সীমার (বিচারের জন্য মামলা প্রাপ্তির তারিখ হতে ১৮০ দিন) মধ্যে দ্রুত বিচারকার্য সম্পন্ন করতে হবে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের সব ধরনের আইনী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া যাচ্ছে। দ্বিতীয় দফা : ট্রাইব্যুনালগুলোকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০-এর ধারা ২০-এর বিধান অনুসারে মামলার শুনানি শুরু হলে, তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি কর্মদিবসে একটানা মামলা পরিচালনা করতে হবে। তৃতীয় দফা : ধার্য তারিখে সাক্ষীর উপস্থিতি ও সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিজেলায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন), সিভিল সার্জনের একজন প্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটরের সমন্বয়ে একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করতে হবে। ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর কমিটির সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকবেন এবং কমিটির কার্যক্রম সম্পর্কে প্রতিমাসে সুপ্রীমকোর্ট, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠাবে। যেসব জেলায় একাধিক ট্রাইব্যুনাল রয়েছে সেসব জেলায় সব ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটররা মনিটরিং কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হবেন এবং তাদের মধ্যে যিনি জ্যেষ্ঠ তিনি সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবেন। চতুর্থ দফা : ধার্য তারিখে রাষ্ট্রপক্ষ সঙ্গত কারণ ছাড়া সাক্ষীকে আদালতে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হলে মনিটরিং কমিটিকে জবাবদিহি করতে হবে। পঞ্চম দফা : মনিটরিং কমিটি সাক্ষীদের নামে দ্রুততম সময়ে যাতে সমন জারি করা যায়, সে বিষয়েও মনিটরিং করবেন। ষষ্ট দফা : নির্ধারিত তারিখে সমন পাওয়ার পরও অফিসিয়াল সাক্ষীরা, যেমন ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, চিকিৎসক বা অন্যান্য বিশেষজ্ঞ সন্তোষজনক কারণ ব্যতিরেকে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য উপস্থিত না হলে, ট্রাইব্যুনাল ওই সাক্ষীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ এবং প্রয়োজনে বেতন বন্ধের আদেশ দেয়ার বিবেচনা করবেন। সপ্তম দফা : আদালতের (হাইকোর্টের) সুচিন্তিত মতামত এই যে, অবিলম্বে সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন এবং আদালত এটাও প্রত্যাশা করছে, সরকার অতি স্বল্প সময়ে উক্ত বিষয়ে আইন প্রণয়ন করবে। গত বছরের ২৮ জুন তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় বগুড়ার সারিয়াকান্দি থানায় মামলা করেন ছাত্রীর বাবা। এ ঘটনায় তদন্ত শেষে পুলিশ ২ সেপ্টেম্বর অভিযোগপত্র দেয়। ওই মামলায় এখন পর্যন্ত অভিযোগ গঠন না হওয়ায় আসামি মোঃ রাহেল ওরফে রায়হান সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালে জামিন চাইলে গত ১ জুলাই তার জামিন আবেদনটি খারিজ হয়। পরে হাইকোর্টে জামিন আবেদন করেন রাহেল। হাইকোর্ট ঐ দিন তার আবেদন খারিজ করে দেয়। ধর্ষণের অভিযোগে ২০১৭ সালের ১১ অক্টোবর নোয়াখালীর নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা হয়। ওই মামলায় আসামি সারোয়ার রুবেল ও এমরানকে গত বছরের ২৯ মে এক বছরের জন্য জামিন দেয় আদালত। এই জামিনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ৩ জুলাই তাদের কারাগারে পাঠায় ট্রাইব্যুনাল। এই আদেশের বিরুদ্ধে জামিন চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন তারা। হাইকোর্ট জামিন মঞ্জুর করে। গত বছর ১৭ মার্চ ঢাকার শনির আখড়ায় আট বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের মামলায় আসামি সেকান্দার আলীর জামিন চলতি বছরের ২৪ জুন নামঞ্জুর করে ঢাকার ট্রাইব্যুনাল-৩। এর বিরুদ্ধে হাইকোর্ট জামিন আবেদনের পর তাদের আবেদন ঐ দিন খারিজ করে হাইকোর্ট। এদিকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বলা আছে, আসামি হাতেনাতে ধরা পড়লে তদন্ত করতে প্রথমে ১৫ দিন ও পরে ৩০ দিন এবং সর্বোচ্চ ৪৫ দিনে তদন্ত শেষ করতে হবে। আর আসামি হাতেনাতে ধরা না পড়লে ট্রাইব্যুনাল থেকে তদন্তের আদেশ প্রাপ্তির তারিখ থেকে প্রথমে ৬০ দিন এবং পরবর্তীকালে ৩০ দিনে অর্থাৎ সর্বোচ্চ ৯০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হবে। অন্যথায় তদন্ত শেষ না হওয়ার কারণ লিপিবদ্ধ করে সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ বা তদন্তের আদেশ প্রদানকারী ট্রাইব্যুনালকে অবহিত করতে হবে। ওই কারণ বিশ্লেষণ করে যদি দেখা যায় যে, তদন্ত কর্মকর্তার কারণেই তদন্তে বিলম্ব হয়েছে, তা হলে তা ওই তদন্ত কর্মকর্তার অদক্ষতা ও অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে। এ বিষয়গুলোও মানা হচ্ছে না।
×