ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সিরাজউদ্দিন আহমেদ

গল্প ॥ স্পর্শ

প্রকাশিত: ০০:১৫, ৯ অক্টোবর ২০২০

গল্প ॥ স্পর্শ

মাধবী মাগরিবের নামাজের সালাম ফেরাতে দেখল হাসান তাঁর ঘরে বসে আছে। নামাজ শেষ করে মাধবী জিজ্ঞাসা করল, এখানে কী করছ? এমনি বসে আছি। বিরক্তিতে মাধবীর ভ্রুকুঁচকে ওঠে, প্রতিটি কাজের পেছনে উদ্দেশ্য কিংবা লক্ষ্য থাকে। দীর্ঘদিন কলেজে অধ্যাপনা করার কারণে কিনা মাধবী তাঁর প্রতিটি কথা যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এই যে আমি নামাজ পড়ছি এর একটা লক্ষ্য আছে। তুমি যে বসে আছ তারও উদ্দেশ্য আছে। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে হাসান মৃদু হেসে বলল, তোমাকে দেখছিলাম। হাসান ভেবেছে মাধবী খুশি হবে। মাধবী বরং বেগে গেল। তাঁর ভ্রুকুঁচকানো বৃদ্ধি পেল। চাপা রাগে বলল, ভীমরতি! আগে মাধবীর মুখে কখনও এ বকা সে শুনেনি। এখন যতই সে বুড়ো হচ্ছে মাধবীর মুখে ভীমরতি বকা ততই প্রিয় হয়ে উঠছে। হাসান চা খাওয়ার জন্য ডাইনিং টেবিলে বসল না। সে মন খারাপ করে নিজের ঘরে চলে এলো। গৃহকর্মী মেয়েটি তাঁর ঘরে ট্রে করে চা-নাস্তা দিয়ে গেল। হাসানের খেতে ইচ্ছে করছে না। চা পানে এখন আর আগের মতো আনন্দ পায় না। তাঁর ইচ্ছে করে অনেক কথা বলতে। কথা বলতে বলতে মাধবীর মুখোমুখি চা খেতে। মাধবী চা খেয়ে জি বাংলা সিরিয়াল দেখতে বসবে। এরপর নামাজ ও তশবিহ্ গণনায় আত্মমগ্ন হবে। কথা বলার সময় মাধবীর নেই। কথা বলার জন্য হাসান যখন কাউকে খুঁজে পায় না, সে তখন কল্পনায় মাধবীর মুখোমুখি বসে। মাধবী বলল, তুমি চা খাওনি কেন? ইচ্ছে করে না। তোমার কী খেতে ইচ্ছে করে দয়া করে আমাকে বলবে? আনন্দে হাসানের মুখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, সেই আগের মতো চা খেতে ইচ্ছে করে। সারাদিন পর তুমি আমি অফিস থেকে ফিরি। সন্ধ্যায় মুখোমুখি চা খেতে বসি। কত কথা আমাদের। চা খাওয়া শেষ হয়, কথা ফুরোয় না। মাধবীর ভ্রুকুঁচকে উঠে। বিরক্তি নিয়ে বলল, ভীমরতি! এ বাড়িতে দু’জন মানুষের বসবাস। মাধবী ও হাসান। তাঁদের একমাত্র সন্তান তমাল আমেরিকার একটি ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করে। বৌমা ডাক্তার। তাঁদের একমাত্র সন্তান অর্ক এ লেভেলের ছাত্র। তমাল প্রতিদিন নিয়ম করে বাবা-মার খোঁজখবর নেয়। হাসানের ইচ্ছে হোক বা না হোক স্কাইপে ছেলের মুখোমুখি বসতে হয়। তমাল জিজ্ঞেস করে, মুখটাকে এত গম্ভীর করে রেখেছ কেন বাবা? সবসময় হাসিখুশি থাকবে। লাইফকে এনজয় করবে। তোমরা এখন ফ্রি। মন যা চায় করবে, দুজনে একসঙ্গে বেড়াতে যাবে। পৃথিবী ঘুরে বেড়াবে। হাসান নিষ্প্রাণ গলায় বলল, তুমি ঠিক বলেছ। তমাল উদ্বেগ নিয়ে বলল, বাবা, আর ইউসিক? তোমার মন কি খারাপ? মার সঙ্গে ঝগড়া করেছ? হাসান মৃদু হেসে বলল, ঝগড়া করার মতো এনার্জি এখন আর পাই না। তার মানে তোমার শরীর মন কোনটাই ঠিক নেই? তা বলতে পার। কী হয়েছে? ভীমরতি। সেটি আবার কী? এক ধরনের বুড়ো বয়সের অসুখ। শুধু পুরুষদের হয়। ডাক্তার দেখিয়েছ? তেমন সিরিয়াস কিছু না। মা তো আমাকে কিছু বলেনি। সিরিয়াস হলে নিশ্চয়ই তোমাকে বলত। সিরিয়াস কী সিরিয়াস না ডাক্তার বলবে। তুমি অবশ্যই আগামীকাল ডাক্তার দেখাবে এবং আমাকে রিপোর্ট জানাবে। তোমার রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত আমি দুশ্চিন্তায় থাকব। হাসান মনে মনে বলল, গাধা! ভীমরতি কী তাই জান না। জি-বাংলার সিরিয়াল শেষ করে মাধবী তাঁর ঘরের দরজা বন্ধ করেছে। অজু করে জায়নামাজ বিছিয়ে বসবে। রাত দশটা পর্যন্ত চলবে ইবাদত বন্দেগী। তারপর ঘুম। হাসান ড্রইংরুমে এসে টিভির রিমোট নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করল। পড়া পত্রিকার পাতা উল্টাল। বুকসেলফ থেকে একটি বই বের করে পড়তে বসল। কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে রেখে দিল। সে উঠে মাধবীর ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। সে দ্বিধায় দোদুল্যমান দরজায় নক করবে কী করবে না। মাধবী, আমার ভাল লাগছে না। অস্থির অস্থির লাগছে...। প্লিজ, তুমি একটু দেখবে? হাসান মনে মনে কথাগুলো বলে তাঁর ঘরে ফিরে এলো। গৃহকর্মী মেয়েটি চলে যাবার আগে তাঁর বিছানা পরিপাটি করে রেখে গেছে। মশারি টাঙ্গিয়েছে। পায়ের কাছে কাঁথা ভাঁজ করে রাখা। ভোর রাতের দিকে ঠাণ্ঠা পড়ে, মেয়েটি এ কথা মনে রেখেছে। সাইট টেবিলে গ্লাসে পানি ঢাকা। সঙ্গে ওষুধের কৌটাটি রাখা। এই সাঁঝ বেলাতে হাসানের ঘুমোতে ইচ্ছে করছে না। সে মশারি খুলে ফেলল। ঘরের লাইট অফ করে দিল। তাঁর ইচ্ছে করছে লোভল্যুয়ামে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়বে। রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে ইউটিউব অন করল। পর মুহূর্তে অফ করল। নামাজের সময় গান শোনা মাধবী পছন্দ করে না। কত বছর আগে তাঁরা বিছানা আলাদা করেছে হাসান মনে করতে পারে না। দশ বছর? বারো বছর? তমালের ছেলে হলো যে বছর, তাঁরা দুজন দাদা-দাদি হলো। তাঁদের নাতি অর্ক প্রথম জন্মদিন পালন করেই দাদির বিছানা দখল করে নিল। তাঁর ঠাঁই হলো পাশের ঘরে। পাঁচ বছর পর তমাল যখন স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পরবাসী হলো, হাসানের প্রত্যাশা ছিল একই ছাদের নিচে একই ঘরে তাঁরা আবার বসবাস করবে। মাধবীর অনাগ্রহের কারণে সেটি আর হয়নি। বিয়ের আগে তাঁদের প্রতিজ্ঞা ছিল, যত দাম্পত্য কলহ হোক, বয়সের ভারে ন্যুব্জ বুড়োবুড়ি হই, যতদিন বেঁচে থাকব একই ঘরে একই শয্যায় বসবাস করব। শুধু মৃত্যুই পারবে তাঁদের আলাদা করতে। হাসান হাসল। মানুষ ভাবে এক হয় আরেক। কঠিনতম প্রতিজ্ঞাও সময়ের ক্ষয়রোগে হাস্যকর মনে হয়। বিয়ের পর পর হাসানের যখন উথাল পাথাল জ্বর হতো সেই দিনগুলো ছিল তাঁর শ্রেষ্ঠ সময়। মাধবীর সময় কাটতো অস্থির দুশ্চিন্তায়। কী ব্যাকুলতা, কী গভীর উষ্ণতা। সারা রাত উষ্ণ সেবায় তাঁকে জড়িয়ে রাখতো। ওষুধ খাওয়ানো, বার বার টেম্পারেচার দেখা, মাথায় পানি ঢালা, শরীর স্পঞ্জ করা, পথ্য খাওয়ানো। সকাল হলে হাসপাতালে নিয়ে যাবে কিংবা ডাক্তার দেখাবে। রাত্রির বিভীষিকা কেটে যখন প্রভাতের সূর্য উঠতো দেখা যেতো হাসানের জ্বর চলে গেছে। দিব্যি সে সুস্থ মানুষ। হাসানকে খুশি খুশি মনে হতো। যেন জ্বর তাঁর কাক্সিক্ষত স্বপ্ন। কতকাল সে মাধবীর স্পর্শ পায় না। মাধবী যদি তাঁর কপালে হাত রেখে বলত, তোমার কপাল গরম লাগছে কেন, জ্বর হয়নি তো? থার্মোমিটার এনে বলত, হা কর তো টেম্পারেচার দেখি। হাসানের চোখ ভিজে ওঠে। পরদিন সকালে দেখা গেল হাসান চাদর মুড়ি দিয়ে রোদে বসে আছে। এখনও এত শীত পড়েনি যে চাদর মুড়ি দিয়ে রোদ পোহাতে হবে। মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি। অসুস্থ লাগছে। বসার ভঙ্গিটিও বিসদৃশ্য। কেমন লেবার লেবার মনে হয়। মাধবীর ভ্রুকুঁচকে উঠে। আশপাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা কী ভাবছে। মাধবী বিরক্তি নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর সংসারের কাজে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর মাধবীর দৃষ্টি আবার হাসানের দিকে গেল। হাসান এখনও সেইভাবে রোদে পড়ে আছে। মুখ ঈষৎ খোলা। ঠোঁট বেয়ে লালা পড়ছে। দৃষ্টি অর্ধনমিত। দূর থেকে মনে হয় স্থির। মুখের উপর একটি ডাঁশ মাছি শব্দ করে উড়ছে। মুখের লালায় বসছে। দৃশ্যটি মাধবীর ভাললাগে না। অজানা আশঙ্কায় তাঁর বুক কেঁপে ওঠে। তড়িত গতিতে সে হাসানের কাছে উঠে এলো। তোমার কী হয়েছে? হাসান চোখ মেলল, ভাল লাগছে না। শীত শীত করছে। মনে হয় জ্বর আসবে। মাধবী বলল, এখানে এভাবে শুয়ে আছো কেন? ঘরে গিয়ে শোও। হাসান কাঁপা গলায় বলল, রোদটা ভাল লাগছে। একটু পরে ঘরে যাই। হাসান ভেবেছে জ্বরের কথা শুনে মাধবী তাঁর কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখবে। হাসানের ইচ্ছে পূরণ হলো না। মাধবী ঘরে ফিরে গেল। হাসানের চোখে ঘুম নামে। দেহমনে ঘোমের আচ্ছন্ন ভাব ঘিরে ধরে। কপালে ঠা-া হাতের স্পর্শ পেয়ে হাসান চোখ মেলে তাকায়। মাধবী তাকে স্পর্শ করেছে। মাধবী তাঁকে স্পর্শ করেছে! তোমার শরীর দেখছি জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে! হাসান কোন কথা বলতে পারে না। সে মুগ্ধ চোখে মাধবীর দিকে তাকিয়ে থাকে। মাধবী হাসানকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি আমার কাঁধ ধরে উঠে দাঁড়াও। ঘরে হেঁটে যেতে পারবে তো? বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মাধবী বলল, তোমার টেম্পারেচার কমাতে হবে। শরীর স্পঞ্জ করা দরকার। তুমি শুয়ে থাক। আমি ব্যবস্থা করছি। বিয়ে পরবর্তী অসুখের সেই দিনগুলো যেন ফিরে এলো। হাসান বিজয়ের গৌরবে উথাল পাথাল আনন্দে ভাসে। মাধবী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। হাসান বগলের নিচ থেকে পেঁয়াজটা বের করে বাইরে ছুড়ে ফেলল। স্কুল জীবনে রতনের চালাকি তাঁকে আজ বিজয়ের আনন্দ এনে দিয়েছে। স্যারদের বেত্রাঘাত থেকে আত্মরক্ষা ও ক্লাস পালানোর কৌশল হিসাবে রতন প্রায়ই বোগলে পেঁয়াজ নিয়ে রোদে দাঁড়িয়ে জ্বর বাঁধিয়ে ফেলত। হাসানের শরীর স্পঞ্জ করার ব্যবস্থা করে মাধবী বলল, আজ রাতে তোমার একা থেকে কাজ নেই। আমি তোমার সঙ্গে থাকব।কথাটা শুনে হাসানের কেমন লজ্জা করতে লাগল।
×