ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মীম মিজান

বই ॥ যুদ্ধের প্রতি ঘৃণা ও ইরানের দর্পণ

প্রকাশিত: ২১:২৬, ৯ অক্টোবর ২০২০

বই ॥ যুদ্ধের প্রতি ঘৃণা ও ইরানের দর্পণ

পৃথিবীটা বরাবরই অশান্ত। আর এই অশান্তের মূল কারণ “আমি আজ ক্ষুধার্ত। গোটা বিশ্ব খেয়ে ফেলবো। ক্ষুধার্ত পেটের একেকটি মোচড় সিডর তোলে ভূপৃষ্ঠে। অর্থাৎ যারা ক্ষমতাসীন তারা সারা পৃথিবীটাকে করতে চায় নিজের করতলগণ। তাই হানাহানী, মারামারি, যুদ্ধ-বিগ্রহ। আর এই যুদ্ধের ফলে সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা মনুষ্যজাতি। মনুষ্যজাতির কিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধ ব্যক্তিগণ এই যুদ্ধের ফলে মারা পড়ছে বেশি। বুক চাপড়ে মাতম করছে কোন মা, কোন ভগ্নি, কোন নবোঢ়া বা বাগদত্তা। আর ক্ষমতালিপ্সু ব্যক্তিগণ দম্ভ করে যাচ্ছেন। বাগদত্ত বা মনের মানুষকে হারানো একজন মেয়ের ঘৃণাযুক্ত উক্তি ‘আগায়ে দকতর, যুদ্ধকে ঘৃণা করি, ন্যায়যুদ্ধ হলেও আমি একে ঘৃণা করি। ঘৃণা করি।’ উক্তিটি মার্কিনমুলুকে প্রবাসী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, ঔপন্যাসিক ও সম্পাদক হুমায়ূন কবিরের উপন্যাস পারস্য পরবাসে এর মূলকথা। মধ্যাবয়বের এই উপন্যাসটিতে আমরা বিপ্লবোত্তর ইরানের উপর ইরাকের শাসক সাদ্দামের আক্রমণে লক্ষ লক্ষ পুরুষ মানুষের মৃত্যুর খতিয়ান দেখি। দেখি ইরানের উচ্চবিত্ত থেকে পশ্চাদপদ মানুষদের জীবনাচরণ। বিপ্লবীরা প্রজাতন্ত্রটিতে সাম্যের পরাকাষ্ঠা প্রতিষ্ঠা করতে পরম যতœশীল। পশ্চিমা সংস্কৃতির আদলে শাহ সরকারের সরাসরি মদদে চলতো খোলামেলা ও অবাধ মেলামেশা। সেখানে ইসলামী শরীয়ার বিধান পুরোপুরি মেনে চলা। মেয়েরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে পুরোপুরি পর্দা মেনে চলতে। তবে বামঘেঁষা রাজনীতি যারা করতো তাদের অবস্থা কোণঠাসা থেকে শোচনীয়। যদিও তারা বিপ্লবে ইমাম খোমেনিকে সমর্থন দিয়েছিল। কেননা শাহ ছিল স্বৈরাচারী ও একনায়কতন্ত্রের ধারক। উপন্যাসের নায়ক ঔপন্যাসিক নিজেই। তিনি বর্ণনা করে চলছেন তাঁর ভাগ্যান্বেষণে যাওয়া ইরানের চরম উত্তাল সময়ের ঘটনা। বিপ্লবী সরকারের অধীনে চিকিৎসা খাতে একটি চাকরি জুটানোতে যার আপাতত ভাগ্য সুপ্রসন্ন। চাকরি পেয়ে যান। থিতু হওয়ার কিছুকাল অতিক্রম হতেই দেশে ফেরার তাগিদে মন উন্মুখ হয়ে ওঠে। সৈয়দ মুজতবা আলীর ভ্রমণকাহিনী ‘দেশেবিদেশে’র মতো রসসমৃদ্ধ না হলেও বেশ সুখপাঠ্য এই ভ্রমণ উপন্যাসটি। ইরানের ইতিহাস, চায়ের ঐতিহ্য, টিউলিপের ইতিহাস, ইরানি ছোট্ট চাকুরেদের কর্তব্যনিষ্ঠা, বড়বড় পদে অধিষ্ঠিত বিপ্লবীদের অমায়িকতা, সবার মাঝে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার মানসিকতা, পশ্চিমাদের প্রতি চরম ঘৃণা, নিজেদের দেশের বিপ্লবের প্রচার ও বহির্বিশ্বে এর প্রতি সমর্থন যোগানো ইত্যাদিতে প্রোজ্জ্বল উপন্যাসটি। উপন্যাসটি পাঠে চলতি কিছু ফারসি শেখা হয়ে যাবে। কেননা ঔপন্যাসিক ইরানের জনগণসহ অন্যান্যদের সাথে কথোপকথনের সময় ফারসি লিখে সেগুলোর বাঙলায়ন করেছেন। নিজদেশের প্রতি টান অনেকটাই প্রবলভাবে তুলে ধরেছেন লেখক। মা-বাবার স্মৃতিচারণ, মমতা-প্রীতির অবগাহন, চিঠির জন্য মুখিয়ে থাকা, টেলিফোনে কথা বলা, যুদ্ধ কবলিত দেশে সন্তানের জন্য উদ্বিগ্নতা, মঙ্গল কামনা করে দুয়া-মিলাদ পড়ানো, বিয়ের জন্য পাত্রী খোঁজা, ছবি পাঠিয়ে দেয়া, সেই ছবি দেখে কল্পনায় ভাসা, দেশের বিভিন্ন ঋতুর প্রকৃতি ইত্যাদি ঔপন্যাসিকের স্বদেশপ্রেমকে প্রগাঢ় করেছে। ভাষার ব্যবহারে ঔপন্যাসিকের দক্ষতা প্রস্ফুটিত। প্রত্যেকটি ঘটনা এক একটি ছোটগল্পের মতো। প্রকৃতির সুনিপুণ বর্ণনা যেন তা চোখের সামনে ভাসছে। বন্ধুসুলভ খুনসুটি, আনুশেহ সিরাজির রূপের মাধুর্যের বর্ণনা, ইরানি লোকদের অবয়বের স্কেচ করা ইত্যাদি উপন্যাসটিকে করেছে অসাধারণ। ঔপন্যাসিকের সহপাঠী ও প্রাণের বন্ধু আমানের কাছথেকে ইরান সম্পর্কিত জানাশোনা, তারপর ইরানে যাওয়ার অভিপ্রায় হয়। আর সেই বন্ধু আমানকেই উৎসর্গ করেছেন উপন্যাসটি। উপন্যাসটি ২০১৮ সালের অমর একুশে বইমেলায় সময় প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়। চমৎকার প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এষ। মূল্যঃ ৩৪০ টাকা।
×