ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রী আজ ‘হাওড়ের বিস্ময়’ অলওয়েদার সড়ক উদ্বোধন করবেন

প্রকাশিত: ২২:৫২, ৮ অক্টোবর ২০২০

প্রধানমন্ত্রী আজ ‘হাওড়ের বিস্ময়’ অলওয়েদার সড়ক উদ্বোধন করবেন

স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতা, কিশোরগঞ্জ ॥ বর্ষায় হাওড় এলাকার গ্রামগুলোকে দূর থেকে ছোট ছোট দ্বীপের মতো মনে হয়। যেন থৈ থৈ পানিতে ভাসছে দুর্গম জনপদ। এ সময় হাওড়ে চলাচল করে শত শত ইঞ্জিনচালিত নৌকা। অর্থাৎ নৌকাই চলাচলের একমাত্র বাহন। সময় অসময়ে আপদ বিপদ হলে চলাচলের বিকল্প কিছু নেই। নেই সড়ক যোগাযোগ। তাই সব সময় বিপদ আর দুর্যোগ মাথায় নিয়ে চলতে হয় মানুষের। বর্ষাকালে হাওড় এলাকার বাসিন্দাদের এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম, এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলা কিংবা জেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র বাহন হিসেবে শত শত বছর নৌকাই একমাত্র ভরসা। কিন্তু দীর্ঘদিন হাওড়ের মানুষ সড়ক যোগাযোগের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। সাধারণ মানুষের স্বপ্নের কথা হাজার কান হয়ে পৌঁছায় জনপ্রতিনিধি পর্যন্ত। শুরু হয় স্বপ্নের বুনন। যা এখন বাস্তব হয়ে চোখের সামনে দৃশ্যমান। তা দেখে একেবারেই অবিশ^াস্য মনে হয় স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে। গভীর হাওড়ের মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগের জন্য তৈরি করা হয়েছে ‘অলওয়েদার সড়ক’। সড়কটি ইটনা উপজেলা সদর হতে শুরু হয়ে ধনু ও বাউলাই নদীর সমান্তরালে সম্পূর্ণভাবে বিস্তীর্ণ হাওড়ের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে মিঠাইন উপজেলা সদর হয়ে অষ্টগ্রাম উপজেলা সদরে সমাপ্ত হয়েছে। অর্থাৎ নতুন এই সড়ক তিনটি উপজেলা যুক্ত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে গোটা কিশোরগঞ্জ জেলায় সড়ক যোগাযোগে সৃষ্টি হয়েছে নতুন মাত্রা। সেইসঙ্গে অথৈই হাওড়ের বুক চিড়ে জেগে ওঠা সড়ক নিয়ে মানুষের মধ্যে আনন্দের যেন শেষ নেই। তেমনি দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা দুর্ভোগেরও অবস্থান হতে যাচ্ছে নতুন এই সড়ক নির্মাণের মধ্য দিয়ে। অনেকের কাছে পুরো ঘটনাটি একেবারেই বিস্ময়কর মনে হচ্ছে। জানা গেছে, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অধীনে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ৮৭৪ দশমিক ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে। ২৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ‘অলওয়েদার’ সড়কে ৫৯০ দশমিক ৪৭ মিটার দীর্ঘ তিনটি পিসি গার্ডার, ১৯০ মিটার দীর্ঘ ৬২টি আরসিসি বক্স কালভার্ট, ২৬৯ দশমিক ৬৮ মিটার দীর্ঘ ১১টি আরসিসি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া ৭ দশমিক ৬০ লাখ বর্গমিটার সিসি ব্লক দিয়ে স্লোপ প্রটেকশনের কাজ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৬১ দশমিক ৮১ মিটার দীর্ঘ ভাতশালা সেতু, ১৭১ দশমিক ৯৬৪ মিটার ঢাকী সেতু এবং ১৫৬ দশমিক ৭২ মিটার দীর্ঘ ছিলনী সেতু- এ তিনটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এই তিনটি সেতু সড়কটির সৌন্দর্যকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। নান্দনিক এই সড়ক এখন সৌন্দর্য পিপাসুদের কাছে হয়ে উঠেছে দুর্নিবার আকর্ষণ। এর ফলে কিশোরগঞ্জের হাওড় এলাকায় উন্মোচিত হয়েছে পর্যটন সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত। জেলা সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ রাশেদুল আলম জানান, গত অর্থবছরে ৮৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘অল ওয়েদার সড়ক’ নির্মাণ করা হয়। এলাকাবাসী বলছেন, এ সড়ক উদ্বোধনের মাধ্যমে হাওড়ে নতুন দিগন্তের উন্মোচন হবে। এ সড়ককে ঘিরে হাওড়ে ভারতের কেরালার মডেলে পর্যটন এলাকা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এক সময়ের অবহেলিত হাওড়বাসীর জন্য দিগন্ত বিস্তৃত হাওড়ের মাঝ দিয়ে পিচঢালা প্রশ্বস্ত উঁচু সড়কটি হাওড়ের সৌন্দর্যকে যেন বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। এ সড়ককে ঘিরে সমৃদ্ধ হবে হাওড়ের অর্থনীতি। বাড়বে মানুষের জীবনমান এমনটা মনে করছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে এরই মাঝে আগামীর পর্যটন ঠিকানা হিসেবে দেশ-বিদেশে পরিচিতি লাভ করেছে সড়কটি। একটি মাত্র সড়কই বদলে দিয়েছে হাওড়ের সামগ্রিক দৃশ্যপট। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলা কিশোরগঞ্জের পূর্ব প্রান্তে বিস্তীর্ণ হাওড় এলাকা নিয়ে ইটনা-মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার অবস্থান। হাওড় অধ্যুষিত বিচ্ছিন্ন এই তিনটি উপজেলা বছরের অর্ধেকের বেশি সময় জলমগ্ন থাকায় অনগ্রসর ও দুর্গম হিসেবে পরিচিত এলাকায় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না বললেই চলে। হাওড়বাসীর দীর্ঘদিনের এই কষ্ট লাঘবে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ হাওড়ের বুকচিরে অলওয়েদার সড়ক নির্মাণের স্বপ্ন দেখেন। তার একান্ত অভিপ্রায়ে সড়কপথে সারা বছর চলাচলের জন্য ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম উপজেলাকে যুক্ত করে নির্মিত হয় অলওয়েদার সড়ক। ‘হাওড়ের বিস্ময়’ হিসেবে পরিচিত হাওড়বাসীর স্বপ্নের এ সড়কটি আজ বৃহস্পতিবার সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোঃ সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী। কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম) আসনের সংসদ সদস্য ও রাষ্ট্রপতির বড় ছেলে রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক বলেন, সড়কটি হওয়ার ফলে তিন উপজেলার মানুষের যোগাযোগসহ পরস্পরের প্রতি সম্প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে। ভবিষ্যতে হাওড়ের অলওয়েদার সড়কটি সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহাসড়কে যুক্ত হবে। এছাড়া হাওড়ে ফ্লাইওভার নির্মাণেরও পরিকল্পনা রয়েছে। ইটনা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান চৌধুরী কামরুল হাসান বলেন, আমাদের হাওরের গর্ব রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ এক সময় এমন স্বপ্ন দেখতেন। তাঁর ঐকান্তিক ইচ্ছা আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগিতায় আজ তা বাস্তবে রূপ নিয়েছে। অষ্টগ্রাম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ শহীদুল ইসলাম জেমস বলেন, হাওড় এক সময় এতটাই দুর্গম ছিল যে, তিন উপজেলার মানুষের একে অপরের সঙ্গে দেখা হতো কালেভদ্রে। এ রাস্তা হাওড়বাসীর যোগাযোগে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করবে। গতি পাবে হাওড়ের জীবনধারা। ইতোমধ্যে সড়কটি উদ্বোধনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি বুধবার বিকেলেই শেষ হয়েছে। রং বেরঙের পতাকা দিয়ে সাজানো হয়েছে পুরো সড়ক। সড়ক দীপের চারপাশ আর বর্ণিল করে তোলা হয়েছে। রাস্তার বিভিন্ন পয়েন্টে টানানো হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি। শেষ হয়েছে রোড সাইনের কাজও। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। সেদিকেই তাকিয়ে আছেন গোটা হাওড়াঞ্চলের মানুষ।
×