ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জেএসসি ও এসএসসির ফলের ভিত্তিতে মূল্যায়ন

এইচএসসি পরীক্ষা হবে না

প্রকাশিত: ২২:৪৮, ৮ অক্টোবর ২০২০

এইচএসসি পরীক্ষা হবে না

স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রাণঘাতী করোনার ছোবলের মধ্যে এবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা হবে নাকি হবে না- এমন প্রশ্নে লাখ লাখ শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষকসহ জনমনে সৃষ্ট উদ্বেগের অবসান হলো। করোনা সংক্রমণ থেকে শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের জীবন রক্ষার কথা মাথায় রেখে এবারের স্থগিত হওয়া এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা নেয়া হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফলের গড়ের ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে। পাস করবে সকলেই। আগামী ডিসেম্বরে প্রকাশ করা হবে মূল্যায়নের ফল। এদিকে করোনার ঝুঁকির মধ্যে পরীক্ষা না নেয়ার সিদ্ধান্তকেই যুক্তিযুক্ত বলে মত দিয়েছেন শিক্ষাবিদ, পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। করোনার কারণে স্থগিত থাকা এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ভবিষ্যত কি তা নিয়ে জনমনে ছিল প্রশ্ন। সকলেরই আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল বিষয়টি। আবার পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলে তা নিয়ে উদ্বেগও ছিল শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে। উদ্বেগ ছিল শিক্ষাবিদ এমনকি করোনা প্রতিরোধ সংক্রান্ত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির অনেক সদস্যের মাঝেও। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের পরিকল্পনা কি হবে তা জানার আগ্রহ ছিল মানুষের। যদিও গত ৩০ সেপ্টেম্বরই কিছুৃটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি। তিনি সেদিন এক কর্মসূচীতে বলেছিলেন, অনেক বিকল্প প্রস্তাব ঠিক করা হয়েছে। তবে পরীক্ষা ছাড়াই মূল্যায়ন করা যায় কিনা সেই প্রশ্নও এখনই নাকচ করছেন না তারা। পরীক্ষা না নিয়ে আগের পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন করে সার্টিফিকেট প্রদান করার প্রস্তাব করছেন অনেকে। এটিকেও আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি, এটি একটি প্রস্তাব হতে পারে। তবু আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না আসা পর্যন্ত এ পরীক্ষা ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। এ পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে ভর্তি কার্যক্রম চলায় বিষয়টি নিষ্পত্তির আশা ছিল সকলেরই। ঠিক এমন অবস্থায় বুধবার এক ভার্চুয়াল প্রেস ব্রিফিংয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি ঘোষণা দিয়েছেন, ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষা সরাসরি গ্রহণ না করে ভিন্ন পদ্ধতিতে মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এরা দুটি পাবলিক পরীক্ষা অতিক্রম করে এসেছে। এদের জেএসসি ও এসএসসির ফলের গড় অনুযায়ী এইচএসসির ফল নির্ধারণ করা হবে। ডিসেম্বরের মধ্যে তারা এইচএসসির চূড়ান্ত মূল্যায়ন ঘোষণা করতে চান, যাতে জানুয়ারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। এ সময় শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী, মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের সচিব, শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানরাসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ব্রিফিংয়ে সংযুক্ত ছিলেন। শিক্ষামন্ত্রী জানান, গতবার যারা ফেল করেছে, তাদেরও জেএসসি ও এসএসসির ফলের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হবে। উচ্চ মাধ্যমিকে একজন শিক্ষার্থীকে সাতটি বিষয়ে ১৩টি পত্রে পরীক্ষায় বসতে হয়। এর মধ্যে দুই বিষয়ে (সর্বোচ্চ চার পত্র) ফেল করলে পরের বছর শুধু ওইসব বিষয়ে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ ছিল। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, পরীক্ষা গ্রহণের জন্য কমপক্ষে ৩০-৩২ কর্মদিবসের প্রয়োজন হয়। দুই হাজার ৫৭৮টি পরীক্ষা কেন্দ্রে এ পরীক্ষা নেয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলাম। এক্ষেত্রে পরীক্ষা নেয়া সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে পরীক্ষা নিতে গেলে আমাদের দ্বিগুণ কেন্দ্র প্রয়োজন পড়বে। বিদ্যমান কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র প্যাকেটজাত করে পাঠানো হয়েছিল। সব প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। প্যাকেট ভেঙ্গে নতুন প্যাকেট করার সুযোগ নেই, কেন্দ্র দ্বিগুণ করতে হলে যে জনবল তাও দ্বিগুণ করতে হবে। বর্তমান সময়ে এসব করা শিক্ষা বোর্ডের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে। অন্যান্য দেশের পরিস্থিতিও বিবেচনায় নেয়া হয়েছে জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ভারতেও সেন্ট্রাল বোর্ড অব সেকেন্ডারি বোর্ডের আওতায় উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা কোভিড-১৯ শুরুর আগেই শুরু করেছিল এবং তিনটি পরীক্ষা গ্রহণের পর স্থগিত করা হয়। এছাড়া হংকং, চীনে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা বাতিল বা স্থগিত করা হয়েছে। শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, আমরা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতিকে অনুসরণ করতে যাচ্ছি। আমরা যদি এইচএসসি পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করি, তাহলে আন্তর্জাতিক পরীক্ষা আছে এবং আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো একটা মূল্যায়নের ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিয়েছে। সেক্ষেত্রে আমাদের পিছিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বৈষম্যের শিকার হওয়ার কারণ নেই। সকলের মতামতের ভিত্তিতে পরীক্ষা না নেয়ার সিন্ধান্ত নেয়া হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, আমাদের কাছে পরীক্ষার্থী এবং সংশ্লিষ্ট সবার জীবনের নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সার্বিক বিবেচনায় আমরা বিভিন্ন অংশীজনের মতামত নিয়ে ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষা সরাসরি গ্রহণ না করে একটু ভিন্ন পদ্ধতিতে মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পরীক্ষা না নিয়ে পরীক্ষার্থীদের মূল্যায়ন শিক্ষা বোর্ডসমূহের জন্য একেবারেই নতুন। ফলে কীভাবে মূল্যায়ন করা হলে ফল দেশে এবং বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করবে এবং শিক্ষার্থীদের পরবর্তী জীবনে কোন বিরূপ প্রভাব পড়বে কিনা, এসব বিষয় আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি নির্দিষ্ট সময়ে ॥ এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল হলেও শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, জেএসসি ও জেডিসি এবং এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার গড় নম্বর মূল্যায়ন করে এইচএসসির ফলের ভিত্তিতে নির্ধারিত সময়ে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে। এবার একই ধরনের বিশ^বিদ্যালয়ে একই সঙ্গে বা গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার আশা করছেন তারা। মূল্যায়ন ও গ্রেড নির্ণয়ে কমিটি গঠন ॥ শিক্ষার্থীদের আগের দুটি পাবলিক পরীক্ষার নম্বর মূল্যায়ন পদ্ধতি ও গ্রেড নির্ণয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ দিতে একটি কমিটি গঠন করা হেেয়ছে জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, সে কমিটির পরামর্শের ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। যেহেতু এসএসসি পরীক্ষা হচ্ছে না সেহেতু একজন শিক্ষার্থীকে মূল্যায়নের ফাইনাল ধাপ হবে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি। এক্ষেত্রে পরামর্শক কমিটির সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেয়া হবে। সিদ্ধান্ত যুক্তিযুক্ত, স্বস্তির ॥ করোনার মধ্যে ঝুঁকি থাকায় পরীক্ষা না হওয়ার সিদ্ধান্ত ‘ভিন্ন কিছু’ মনে হলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে এটিকেই যথাযথ সিদ্ধান্ত বলছেন পরীক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষাবিদরা। তারা বলছেন, পরীক্ষা দিয়ে একটা ফল পাওয়া আর না দিয়ে এ ধরনের মূল্যায়ন; দুটো হয়তো ভিন্ন অনুভূতি। কিন্তু জীবন আগে। সবার জীবন নিয়ে ভাবতে হবে আগে। কারণ এই পরীক্ষার সঙ্গে প্রায় ১৪ লাখ পরীক্ষার্থীসহ অন্তত ৩৯ লাখ মানুষ সম্পৃক্ত। ফলে পরীক্ষা হলে জীবন রক্ষা করাটাই বড় সঙ্কট হতে পারত। হলিক্রস স্কুল এ্যান্ড কলেজের এবারের পরীক্ষার্থী সেলেনা গমেজ তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলছিল, একটু অন্যকরম লাগছে। তবে ভয়টাও ছিল যদি পরীক্ষা হয় আবার যদি করোনাও থাকে। তাই এখন অন্তত স্বস্তি ফিল করছি। ভিকারুন নিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজের পরীক্ষার্থীর অভিভাবক রোমানা আক্তার বলছিলেন, সিদ্ধান্ত যাই হয়েছে ভাল। পরীক্ষা নিয়ে ছেলেমেয়েরা ভয় পাচ্ছিল। আমার এক বোন করোনায় মারা গেছেন। এতে আরও ভয় ছিল। এখন অন্তত স্বস্তি। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শেখ ইকরামূল কবীর বলছিলেন, আসলে পরিস্থিতি পাবলিক পরীক্ষা নেয়ার মতো ছিল না। কোনভাবেই নিরাপদ ছিল না। যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আমিরুল আলম খান বলছিলেন, পরীক্ষা না নেয়াটা মন্দের ভাল হয়েছে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে এর চেয়ে ভাল আর কোন বিকল্প ছিল বলে তিনি মনে করেন না।
×