ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বেগমগঞ্জের ঘটনায় বিক্ষোভ অব্যাহত

প্রকাশিত: ২২:৪৭, ৮ অক্টোবর ২০২০

বেগমগঞ্জের ঘটনায় বিক্ষোভ অব্যাহত

আজাদ সুলায়মান ॥ নোয়াাখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুর ইউনিয়নের সেই নারীকে নির্যাতনের ঘটনা ফেসবুকে ছড়ানোর হোতা আবুল কালামকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। বুধবার বিকেলে তাকে কুমিল্লাার দাউদকান্দি থেকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-১১। মঙ্গলবার রাতে আবুল কালাম ও দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করেছেন নির্যাতনের শিকার সেই নারী। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে ওই নারী বাদী হয়ে বেগমগঞ্জ মডেল থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলাটি করেন। এদিকে চাঞ্চল্যকর এই ঘটনায় নির্যাতিতার মেয়ে একটি বেসরকারী টেলিভিশনের কাছে তার পিতার ভূমিকাও রহস্যজনক বলে উল্লেখ করে সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। বুধবারও রাজধানীর শাহবাগ ও নোয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ হয়েছে। এতে অংশগ্রহণকারী সকল ধর্ষণকারী ও নিপীড়নকারীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। র‌্যাব-১১ অধিনায়ক লে. কর্নেল খন্দকার সাইফুল আলম দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, মামলার তিন নম্বর আসামি আবুল কালামকে গ্রেফতার করার পর তাকে তাৎক্ষণিক পাঠিয়ে দেয়া হয় বেগমগঞ্জ থানায়। তার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে আরও একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। জানা গেছে, দেলোয়ারের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার এজাহারে নির্যাতনের শিকার ওই নারী অভিযোগ করেনÑ গত ২ সেপ্টেম্বর দেলোয়ার বাহিনীর সদস্যরা বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনার আগে দেলোয়ার দু’বার তাকে ধর্ষণ করেছিল। এর মধ্যে একবার ধর্ষণ করা হয় প্রায় এক বছর আগে। আর দ্বিতীয়বার ধর্ষণ করা হয় রমজান মাসের কিছুদিন আগে। দ্বিতীয়বার ধর্ষণের ঘটনার দিন দেলোয়ারের সহযোগী কালামও তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। বেগমগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মুহাম্মদ হারুন-অর-রশিদ চৌধুরী বলেন, দেলোয়ার হোসেনকে এই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হবে। এছাড়া মামলার আরেক আসামি আবুল কালামকে গ্রেফতারে চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ। এর আগে গতকাল জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত দলের কাছে নির্যাতনের শিকার ওই নারী এসব তথ্য জানান। তদন্ত দলের প্রধান মানবাধিকার কমিশনের পরিচালক আল-মাহমুদ ফয়জুল কবীর নোয়াখালী চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের মিলনায়তনে উপস্থিত সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে ওই অভিযোগের কথা বলেন। নির্যাতনের শিকার নারীর বরাত দিয়ে ফায়জুল কবীর বলেন, ভুক্তভোগী নারী অভিযোগ করেছেন দেলোয়ার প্রায় সময় তাকে কুপ্রস্তাব দিত। কুপ্রস্তাবে সাড়া দিতে হুমকি-ধমকিও দেয় দেলোয়ার। বছর খানেক আগে দেলোয়ার ওই নারীর ঘরে ঢুকে প্রথমবার ধর্ষণ করে। গত রমজানের কিছুদিন আগে দেলোয়ার তার সহযোগী কালামের মাধ্যমে ওই নারীকে একটি নৌকায় ডেকে নেয়। সেখানে দেলোয়ার ও কালাম দুজনই তাকে ধর্ষণ করতে চায়। এ সময় দেলোয়ারের কাছে অনুনয়-বিনয় করলে কালামকে টাকা দিয়ে পাঠিয়ে দেয়। এরপর নৌকায় দ্বিতীয়বার তাকে ধর্ষণ করে দেলোয়ার। নির্যাতনের ঘটনার প্রথম দুটি মামলায় দেলোয়ারের নাম না থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নিরাপত্তাহীনতার কারণে ভুক্তভোগী নারী দেলোয়ারের নামে মামলা করেননি বলে আমাকে জানিয়েছেন। এমনকি ২২ ধারার জবানবন্দীতে দেলোয়ারের নাম না থাকার কারণ শুধু নিরাপত্তাহীনতা ও ভয়। একইসঙ্গে ওই নারীকে ধর্ষণের ভিডিওগুলো ফেসবুকে ছেড়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়। এদিকে নির্যাতিতা নারীর মেয়ে গতকাল একটি বেসরকারী টেলিভিশনকে দেয়া সাক্ষাতকারে অভিযোগ করেনÑ তার মাকে দীর্ঘদিন ধরেই অত্যাচার নির্যাতন করে আসছিল আসামিরা। এ ঘটনা তার বাবাও জানতেন। আসামিদের মতো তার বাবাও টাকার জন্য তার মাকে সব সময় চাপ দিত। একবার শত কষ্ট করে তার মা দশ হাজার টাকা যোগাড় করে বাবার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তারপরও তার বাবা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। উল্টো আসামিদের সঙ্গে রহস্যজনক মেলামেশা করত। এমনকি সেই রাতের ঘটনার পরও তার বাবা ও স্থানীয় মেম্বারের কাছে জানানো হয়। কিন্তু সবাই ছিল নির্বিকার। কেউ বিষয়টি থানা পুলিশকে জানায়নি। প্রাণভয়ে তার মার পক্ষেও সম্ভব হয়নি থানায় গিয়ে প্রভাবশালী আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা মোকদ্দমা করা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেগমগঞ্জ থানার ওসি হারুন-অর রশিদ দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, প্রথমদিন ভিকটিম তো আমাদের কাছে এমন কোন অভিযোগ করেননি। এখন তার মেয়ে যদি এ ধরনের অভিযোগ করেন সেটা অবশ্যই আমরা খতিয়ে দেখব। নোয়াখালী থেকে গিয়াস উদ্দিন ফরহাদ জানান, বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুরে বাড়িতে ঢুকে নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনায় গ্রেফতারকৃত ৩ আসামি মাঈন উদ্দিন সাজুর ছয়দিন, আনোয়ার হোসেন সোহাগ ও নুর হোসেন রাসেলকে দুদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। পর্নোগ্রাফি, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলায় এ রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে। বুধবার দুপুরে নোয়াখালী চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলি আদালত ৩-এর বিচারক মাসফিকুল হকের আদালত এ আদেশ দেন। বিবস্ত্র নির্যাতনের হোতা দেলোয়ার ও সহযোগী কালামের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নির্যাতনের শিকার ওই নারী স্থানীয় দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার ও তার অপর এক সহযোগী আবুল কালামের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা দায়ের করেছেন। সোমবার রাত ২টার দিকে বেগমগঞ্জ থানায় ওই নারী বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেন। মামলা ও থানা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত এক বছর পূর্বে দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার ওই নারীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে জোর পূর্বক দুই দফায় ধর্ষণ করে। আর দেলোয়ারকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করে তার বাহিনীর অন্যতম সদস্য আবুল কালাম। দেলোয়ার অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী হওয়ায় তিনি ভয়ে বিষয়টি কাউকে বলেননি। তবে এরই মধ্যে গত মাসের প্রথম সপ্তাহে দেলোয়ার বাহিনীর সদস্যরা ওই নারীর ঘরে ঢুকে তার স্বামীকে বেঁধে রেখে তাকে বিবস্ত্র করে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে এবং তা মোবাইলে ধারণ করে। এক পর্যায়ে গত ৪ অক্টোবর ধারণকৃত ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। পরে এ ঘটনায় ওই নারী বাদী হয়ে বেগমগঞ্জ থানায় দেলোয়ার বাহিনীর অপর এক সদস্য বাদলকে প্রধান আসামি করে নয়জনের নাম উল্লেখ করে দুটি মামলা দায়ের করেন। এ সম্পর্কে বেগমগঞ্জ থানার ওসি মোঃ হারুন-অর রশিদ জানান, দেলোয়ার বর্তমানে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় র‌্যাবের দায়ের করা অস্ত্র মামলায় রিমান্ডে রয়েছে। তাকে নির্যাতিতা নারীর দায়ের করা আগের দুটি মামলায় গ্রেফতারের জন্য মঙ্গলবারই আদালতে আবেদন করা হয়েছে। বর্তমান ধর্ষণের মামলায়ও তাকে গ্রেফতার দেখানো হতে পারে বলে জানান ওসি। প্রতিবাদ বিক্ষোভ ॥ এদিকে বুধবারও ঢাকা নোয়াখালীসহ কয়েকটি স্থানে এ ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ হয়েছে। এ সময় সেøাগানে মুখর হয়ে উঠেছে শাহবাগের ধর্ষণ ও নারী নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন। ধর্ষণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ- ব্যানারে তৃতীয় দিনের মতো রোদ-বৃষ্টি ও পুলিশের বাধা উপেক্ষা করেই আন্দোলন চালিয়েছে ছাত্রজনতা। জাতীয় জাদুঘরের সামনে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে ছড়া পড়েন আয় ছেলেরা, আয় মেয়েরা শাহবাগে আয়, ধর্ষণের বিচার করবই এ বাংলায়। এছাড়া ধর্ষণবিরোধী গান, কবিতাও পাঠ করছেন আন্দোলনকারীরা। বিক্ষোভ মিছিলে আন্দোলনকারীদের দেয়া সেøাগানের মধ্যে রয়েছে– রোদ-বৃষ্টি মানব না ধর্ষক পেলে ছাড়ব না। আসমানী আশা নামের এক আন্দোলনকারী বলেন, আমরা ধর্ষণের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছি। অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা পার করতে হচ্ছে। তার পরও আমরা আন্দোলন চালিয়ে যেতে চাই। এ দেশের মাটিতে আমরা প্রতিটি ধর্ষণের বিচার নিশ্চিত করেই মাঠ ছাড়ব। এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শান্তির দাবিতে নোয়াখালীতে মানববন্ধন-সমাবেশ করেছে আইনজীবীরা। বুধবার নোয়াখালী প্রেসক্লাবের সামনে ধর্ষণ, নিপীড়নবিরোধী আইনজীবী মঞ্চের ব্যানারে এ কর্মসূচী পালন করে। এ সময় বক্তারা বলেন, নারীকে মানুষ হিসেবে নয়, দেখা হচ্ছে নারী হিসেবে। যার কারণে বার বার সমাজে নারীরা নির্যাতিত হয়ে আসছে। একইসঙ্গে নির্যাতনের ঘটনায় দায়ের করা মামলার আসামিরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না পাওয়ার কারণেও এমন ন্যক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। বেগমগঞ্জের ঘটনাসহ ভবিষ্যতে এমন কোন ঘটনা ঘটলে জেলার আইনজীবীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্যাতিতার পক্ষে সর্বাত্মক সহায়তা দেয়া হবে। এছাড়া সাড়ে ১১টার দিকে নোয়াখালী আইডিয়াল পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট ও সো-টিম নামে একটি সংগঠন নোয়াখালী প্রেসক্লাবের সামনে ধর্ষণের প্রতিবাদে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে। এ ঘটনায় সকল আসামির বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করেছে জেলা জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা। বুধবার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনের সড়কে জেলা জাতীয় পার্টির উদ্যোগে এ মানববন্ধন কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয়। জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক বোরহান উদ্দিন মিঠুর নেতৃত্বে বেগমগঞ্জে গৃহবধূকে বিবস্ত্র নির্যাতনসহ দেশব্যাপী নারী, শিশু ধর্ষণ ও নির্যাতনের প্রতিবাদে জেলা এবং উপজেলা জাতীয় পার্টি নেতাকর্মীরা দ্রুত ঘটনার সঙ্গে জড়িত দুর্বৃত্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। এ ছাড়া মানববন্ধন করেছে সুবর্ণ ব্লাড ফাউন্ডেশন নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। বুধবার সুবর্ণচর উপজেলার চরজব্বার থানার মোড়ে সোনাপুর চেয়ারম্যান ঘাট সড়কে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধনে উত্তাল হয়ে ওঠে। মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, গত এক মাসে পত্রিকায় সুবর্ণ ব্লাড ফাউন্ডেশনের সভাপতি নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে এবং ওমর ফারুক সুমনের সঞ্চালনায় মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন কামরুল হাসান, ইয়াছিন প্রমুখ। বক্তারা অবিলম্বে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। উল্লেখ্য, রবিবার দুপুরের দিকে ঘটনার ৩২ দিন পর গৃহবধূকে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রকাশ পেলে তা ভাইরাল হয়ে গেলে টনক নড়ে স্থানীয় প্রশাসনের। ঘটনার ৩২ দিন পর থেকে অভিযুক্ত স্থানীয় দেলোয়ার, বাদল, কালাম ও তাদের সহযোগীরা নির্যাতিতা গৃহবধূর পরিবারকে কিছুদিন অবরুদ্ধ করে রাখে। একপর্যায়ে তার পুরো পরিবারকে বসতবাড়ি ছাড়তে বাধ্য করলে পুরো ঘটনা দীর্ঘদিন স্থানীয় এলাকাবাসী ও পুলিশ প্রশাসনের অগোচরে থাকে। পরে ঘটনার জানাজানি হলে পুলিশ ও র‌্যাব কয়েক দফায় অভিযান পরিচালনা করে প্রধান আসামিসহ এ পর্যন্ত আটজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
×