ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মনিরপেক্ষতা

প্রকাশিত: ২০:৫৩, ৭ অক্টোবর ২০২০

বঙ্গবন্ধুর ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মনিরপেক্ষতা

(গতকালের পর) ধর্মের অপব্যবহার নিয়ে বঙ্গবন্ধুর উপলব্ধি- ‘মানুষ যদি সত্যিকারভাবে ধর্মভাব নিয়ে চলত তাহলে আর মানুষে মানুষে এবং রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে এভাবে যুগ যুগ ধরে সংগ্রাম হতো না। কিন্তু মানুষ নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য ধর্মের অর্থ যার যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে চালাতে চেষ্টা করেছে। সেই জন্য একই ধর্মের মধ্যে নানা মতের সৃষ্টি হয়েছে। ধরুন রসূলে করিম (সা.) ইসলাম ধর্মকে যেভাবে রূপ দিয়েছিলেন সেভাবে যদি ধর্ম চলতো তাহলে আজ আর মানুষে মানুষে এ বিরোধ হতো না। কিন্তু সেই ইসলাম ধর্মের মধ্যে কত বিভেদ সৃষ্টি করা হয়েছে। সুন্নি, শিয়া, কাদিয়ানি, ইসমাইলি, আগাখানি, আবার মোহম্মদি, ওহাবি, কত রকমের বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে এই ধর্মের মধ্যে। এর অর্থ কী? আমরা দেখতে পেয়েছি শুধু হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ধর্মের লোকেরাই একে অন্যের সঙ্গে দাঙ্গাহাঙ্গামা করেনি। শিয়া, সুন্নি দাঙ্গার কথা আপনারা জানেন, হাজার হাজার মুসলমান মুসলমানকে হত্যা করেছে। আপনারা এও জানেন, কাদিয়ানি-শিয়া-সুন্নিদের সঙ্গে পাঞ্জাবে যে হত্যাকা- হয়ে গেছে তার নজির বোধহয় ইতিহাসে বিরল। এর কারণ কী? আজ ধর্ম কোথায়? আর যারা আমাদের ধর্মের গুরু তাদের অবস্থা কী? একবার চিন্তা করলে বুঝতে পারবেন, আমাদের দেশে এককালে এই সকল তথাকথিত ধর্মগুরু বা পীর সাহেবরা ইংরেজী পড়া হারাম বলে আমাদের জাতির কী ভয়ানক ক্ষতি করেছে। সৈয়দ আহমদ যখন ইংরেজী পড়ার জন্য আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি করলেন তখন তাকে এই সকল পীর সাহেবরা ফতোয়া দিল ‘কাফের’ বলে। জিন্নাহ সাহেব যখন পাকিস্তানের আন্দোলন শুরু করলেন তখন এই সমস্ত পীর সাহেবরা কায়েদে আযমের বিরুদ্ধে কী জঘন্য ভাষায় আক্রমণ করেছিল। হাজার হাজার পামফ্লেট কংগ্রেসের টাকা দিয়া ছাপাইয়া দেশ-বিদেশে বিলি করেছিল। ইসলামের নামে তারা কোরআন ও হাদিস দিয়া প্রমাণ করে দিতে চেষ্টা করত যে পাকিস্তান দাবি করা, আর কোরআনের খেলাফ কাজ করা একই কথা।’ (আমার দেখা নয়াচীন, পৃঃ ১০৮-১০৯)। ২১ ফেব্রুয়ারি ‘৫৬ পাকিস্তান গণপরিষদের এক অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র করার প্রচেষ্টা সম্পর্কে বলেছিলেন Let Pakistan be a pure and simple Pakistan of the people. Do not try to hoodwink the people of Pakistan in the name of Islam…………| Islam is for the good of the humanity: As a Mussalman, I believe in my religion and it is my duty to obey it. Allah will punish me for my faults. In there anywhere that the government will punish me if I do not say prayers five times a day? Is there in the Holy Quran, can you show me? I think there is nowhere mentioned that the government will punish me and put me in jail if I do not say my prayers. It is my new character and my own personal matter.’ এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে, ’৫৪-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে শর্ষিনার পীরসহ দেশের কিছুসংখ্যক পীর এবং আলেম ধর্মসভা ডেকে ফতোয়া দিয়েছিলেন, শেখ মুজিবকে ভোট দিলে ইসলাম থাকবে না, ধর্ম শেষ হয়ে যাবে। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী-২৫৬)। ১০ জানুয়ারি ’৭২ বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লক্ষ-কোটি মানুষের সামনে বলেছিলেন, ‘সকলে জেনে রাখুন-বাংলাদেশ এখন বিশে^র দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ।... কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ইসলামের নামে এ দেশের মুসলমানদের হত্যা করেছে। ইসলামের অবমাননা আমি চাই না। আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোন ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এ দেশে কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকুক।’ ১০ এপ্রিল ’৭২ গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর উত্থাপিত প্রস্তাব-‘...। এক্ষণে এই পরিষদ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার সেই সব মূর্ত আদর্শ- যথা জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা যা শহীদান ও বীরদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ করেছিল, তার ভিত্তিতে দেশের জন্য একটি উপযুক্ত সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে- সর্বসম্মতক্রমে গৃহীত হয়।’ ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠীর নানা সমালোচনা ও বক্তব্যের প্রেক্ষিতে গণপরিষদসহ বিভিন্ন ভাষণে বঙ্গবন্ধু এ বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন। ৪ নবেম্বর ’৭২ গণপরিষদে সংবিধান-বিলের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন-‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবও না।... মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে-তাদের বাধা দেয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারও নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে- কারও বাধা দেয়ার ক্ষমতা নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে- তাদের কেউ বাধাদান করতে পারবে না। খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে- কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেইমানী, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যাভিচার- বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব- ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি।’ ৯ মে ’৭২ রাজশাহী মাদ্রাসা ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আর সাম্প্রদায়িকতা যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। ... কিন্তু ইসলামের নামে আর বাংলাদেশের মানুষকে লুট করে খেতে দেয়া হবে না। পশ্চিমারা ২৩ বছর ইসলামিক ট্যাবলেট দেখিয়ে আমাদের লুটেছে। আপনারা জানেন? খবর রাখেন? এই বাংলা থেকে ২৩ বছরে ৩ হাজার কোটি টাকা পশ্চিমারা আমার কৃষকের কাছ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গেছে।’ ২৬ জুন ’৭২ মাইজদি কোর্টের জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমরা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ^াস করি। তার অর্থ ধর্মবিরোধী নয়।... এক ধর্ম অন্য ধর্মের ওপর অত্যাচার করবে না। ধর্মের নামে জুয়াচুরি, পকেটমার লুটতরাজ, ব্যবসা আর পশ্চিম পাকিস্তানের পয়সা খাইয়া রাজনীতি করা চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি চলবে না। ধর্মের নামে লুট করা চলবে না। তবে আমি মুসলমান, আমি মুসলমান হিসেবে আমার ধর্ম-কর্ম পালন করব। হিন্দু হিন্দুধর্ম পালন করবে। কেউ ধর্মকর্মে বাধা দিবার পারবে না। ঠিক? মানেন? আমার ধর্ম আমার কাছে। তোমার ধর্ম তোমার কাছে। আমার কুরআনের আয়াতে আছে তোমার ধর্ম তোমার কাছে। আমার ধর্ম আমার কাছে, এইটাই হলো ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র।’ ৩ জুলাই ’৭২ কুষ্টিয়ার জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘.... কিন্তু ঐ ধর্মের নামে রাজাকার, ধর্মের নামে আলবদর, ধর্মের নামে আলসামস্্ আর ধর্মের নামে ব্যবসা করতে বাংলাদেশের জনসাধারণ দেবে না, আমিও দিতে পারব না। কারণ এই ধর্মের নামে পশ্চিমারা আমার মা-বোনকে হত্যা করেছে। আমার দেশকে লুট করেছে। আমার সংসার খতম করেছে, আমার মানুষকে গৃহহারা করেছে। সে জন্য এ রাষ্ট্র চলবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র যেমন চলে’। ১৮ জানুয়ারি ’৭৪ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,- ‘রাজনীতিতে যারা সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে, যারা সাম্প্রদায়িক-তারা হীন, তাদের অন্তর ছোট। যে মানুষকে ভালবাসে সে কোন দিন সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। আপনারা যারা এখানে মুসলমান আছেন তারা জানেন যে, খোদা যিনি আছেন তিনি রাব্বুল আল-আমীন-রাব্বুল মুসলেমিন নন। হিন্দু হোক, খ্রিস্টান হোক, মুসলমান হোক, বৌদ্ধ হোক- সমস্ত মানুষ তাঁর কাছে সমান।... যারা এই বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িকতা করতে চায় তাদের সম্পর্কে সাবধান হয়ে যেও। আওয়ামী লীগের কর্মীরা, তোমরা কোনদিন সাম্প্রদায়িকতাকে পছন্দ করনি। তোমরা জীবনভর তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছ। তোমাদের জীবন থাকতে যেন বাংলার মাটিতে আর কেউ সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করতে না পারে।’ বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর প্রথমে সামরিক ফরমান বলে, পরবর্তীতে তথাকথিত ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতাসহ অন্যান্য মূলনীতির ওপর আঘাত আনা হয়। দেশকে পাকিস্তানী ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীসমূহ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত রাজাকার-আল্্বদরদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে পুনর্বাসন এবং সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প সৃষ্টির ঘৃণ্য প্রচেষ্টা শুরু হয়। সুপ্রীমকোর্ট ৫ম সংশোধনী অবৈধ ও অকার্যকর ঘোষণা করায় এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ধারাবাহিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকায় বাংলাদেশ এখন আবারও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে এগিয়ে চলছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে দেশের কোটি কোটি মানুষের কণ্ঠে ধ্বনি-প্রতিধ্বনিত হোক ২৬ মার্চ ’৭৫ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় ও গভীর প্রত্যয়- ‘ইন্শাআল্লাহ, বাংলাদেশ এসেছে, বাংলাদেশ থাকবে।’ (সমাপ্ত) লেখক : বিচারপতি বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, হাইকোর্ট বিভাগ এবং সাবেক চেয়ারম্যান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১, বাংলাদেশ
×