ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ট্রাম্প কি সত্যই করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন?

প্রকাশিত: ২০:৪৫, ৭ অক্টোবর ২০২০

ট্রাম্প কি সত্যই করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন?

করোনার মতো মহামারী নিয়েও যে নাটক করা যায়, তা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দেখালেন। হোয়াইট হাউস থেকে বলা হলো তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে গেছেন। হাসপাতালে রোগশয্যায় শুয়েও তিনি তার ‘মহামূল্যবান’ বাণী টুইট করেছেন। গর্ব করে লিখেছেন, ‘আমি এখনই হেঁটে বাইরে চলে যেতে পারি।’ তার পর দু’দিন যেতে না যেতেই তিনি ভাল হয়ে হোয়াইট হাউসে ফিরে এলেন। এটা যেন ‘মিরাকল্্’। আর এই ‘মিরাকল’ একমাত্র ডোনাল্ড ট্রাম্পই দেখাতে পারেন। তার ভাবশিষ্য ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন যখন করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, তখন এই নাটক তিনি দেখাতে পারেননি। দীর্ঘ সময় তিনি হাসপাতালে ছিলেন। এক সময় তার প্রাণ সংশয়ও দেখা দিয়েছিল। চিকিৎসকরাও তার জন্য চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। চিকিৎসকরা তার প্রাণ রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। দীর্ঘ চিকিৎসার পর বরিস জনসন রোগমুক্ত হয়ে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ফিরেছেন। ট্রাম্পের বেলায় এর কিছুই হয়নি। তিনি যেন হাসপাতালে গিয়ে করোনার সঙ্গে কিছু মসকরা করে ঘরে ফিরে এসেছেন। তিনি করোনা আক্রান্ত হয়েছেন বলে যখন খবর প্রকাশ হয়, তখনই লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকার লিড নিউজে বলা হয়েছিল, ‘ঈড়হভঁংরড়হ ৎবরমহং ড়াবৎ ঃৎঁব ংঃধঃব ড়ভ চৎবংরফবহঃ’ং যবধষঃয’ (প্রেসিডেন্টের আসল অবস্থা সম্পর্কে সংশয় বিরাজ করছে।) কারণ, ট্রাম্পের আসল রোগ সম্পর্কে তার ডাক্তাররা এবং হোয়াইট হাউস ভিন্ন কথা বলছিলেন। হোয়াইট হাউস বলেছে, তার সামান্য ইনফেকশন হয়েছে। অন্যদিকে তার চিকিৎসক বলেছেন, প্রেসিডেন্টের অবস্থা প্রথমে খারাপ হয়ে দ্রুত ভাল হয়ে গেছে। এই দ্রুত ভাল হয়ে যাওয়া সম্পর্কে তারা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। পর্যবেক্ষকদের অনেকেই এজন্য মনে করেন ট্রাম্পের খুব সর্দিজ্বর হয়েছিল। এই সর্দিজ্বরেও অনেক সময় মৃদু শ্বাসকষ্ট হয়। মজার ব্যাপার এই যে, ট্রাম্পের কখন এই সর্দিজ্বর হয়েছে, তা নিয়ে তার চিকিৎসক ডাঃ সীন কনলি পরস্পরবিরোধী রিপোর্ট দিয়েছেন। পরে তাকে এই রিপোর্ট সংশোধন করে বিবৃতি দিতে হয়েছে। এক নিউজ কনফারেন্সে যোগ দেয়ার পর ট্রাম্পের রোগ ধরা পড়ে। গত শুক্রবার (২ অক্টোবর) তার অসুস্থতার খবর প্রকাশিত হওয়ার ৩৬ ঘণ্টা আগেই ট্রাম্প জানতেন তিনি সুস্থ নন। এ খবর তার চিকিৎসক ডাঃ কনলিও জানিয়েছেন। এই অসুস্থতা সত্ত্বেও তিনি দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে মিনিসোটায় যান এক র‌্যালিতে যোগ দিতে। তারপর নিউজার্সিতে এক ফান্ড রাইজিং সভায় যোগ দেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকের প্রথম প্রশ্ন, ট্রাম্প যদি জানতেন তার করোনা হয়েছে, তাহলে এই রোগ ছড়াবার জন্য কেন দু-দুইটি জনসমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন? দ্বিতীয় প্রশ্ন, তিনি সত্যই করোনা আক্রান্ত হয়ে থাকলে এই কষ্টকর রোগ শরীরে নিয়ে দু-দুটি জনসমাবেশে যোগ দেয়া সম্ভব কি? তার চিকিৎসা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বলা হয়েছে, তাকে গুরুতর করোনা রোগ সারানোর স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ দেয়ার সঙ্গে করোনার পরীক্ষামূলক কিছু ওষুধ দেয়া হয়েছে, যা এখনও মার্কিন স্বাস্থ্য দফতরের ‘নিরাপদ ওষুধের’ অনুমোদন পায়নি। প্রশ্ন, এই পরীক্ষামূলক ওষুধ কি করে প্রেসিডেন্টকে দেয়া হলো? সঙ্গে প্রশ্ন, প্রেসিডেন্টের করোনা রোগটি যদি গুরুতর না হয়ে থাকে (ডাক্তারদের মতে), তাহলে গুরুতর করোনা রোগের স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ দেয়া হলো কেন? নাকি প্রেসিডেন্টের করোনা হয়নি? তার রোগ ও ওষুধ সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে? ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিজের কথাতেই নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। করোনা আক্রান্ত রোগী হয়েও তিনি টুইটারে তার বাণী ছড়িয়েছেন। করোনা নিয়ে তার তুচ্ছতাচ্ছিল্য গোটা আমেরিকায় এই মহামারীতে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। এখন তিনি এই মহামারীকে প্লেগ আখ্যা গিয়ে টুইটারে বলেছেন, এখন যেসব নতুন ওষুধ তৈরি করা হয়েছে, যা আমি গ্রহণ করছি, তা ঈশ্বরের কাছ থেকে পাঠানো ‘মিরাক্্ল।’ অর্থাৎ, সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং ম্যাজিক ওষুধ পাঠিয়ে তাকে ভাল করে দিয়েছেন। প্রশ্ন, সৃষ্টিকর্তা তাকে ভাল করে দিচ্ছেন, অথচ লাখ লাখ আমেরিকানকে কেন ভাল করছে না? ট্রাম্প বলেছেন, ‘তিনি এই রোগটি সম্পর্কে অভিজ্ঞ হয়েছেন। তার এই অভিজ্ঞতার কথা জনগণকে জানাবেন না।’ কোভিড-১৯ ভাইরাসে যখন অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমেরিকাতেও লাখ লাখ লোকের আক্রান্ত হওয়া বন্ধ হয়নি, সেখানে ট্রাম্প যাবেন তার অভিজ্ঞতার কথা তাদের জানাতে? এই মন্তব্য অতি দুঃখেও আমেরিকার জনগণকে হাসাবে। মার্কিন প্রশাসনের মতে, ট্রাম্প হাল্কা করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। আমেরিকারই অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বলেছেন, তিলকে তাল করা হয়েছে। আবার এমন প্রচারও করা হয়েছে ট্রাম্প এই রোগ প্রেসিডেন্সিয়াল পদে তার ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের কাছ থেকে সাম্প্রতিক ডিবেটের সময় পেয়েছেন। প্রচারণাটি বন্ধ করার জন্য জো বাইডেন তার শরীরে করোনাভাইরাস আছে কিনা তা পরীক্ষা করিয়েছেন। আমেরিকার ইতিহাসে সবচাইতে কলঙ্কজনক অধ্যায়টি যোগ করে গেলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত জো বাইডেনের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মুখোমুখি বিতর্কে যে ভাষা ব্যবহার করেছেন, তা ইতরামি ছাড়া আর কিছু নয়। জো বাইডেন তার গালাগালি সহ্য করতে না পেরে এক সময় চিৎকার করে বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘ইউ শাট আপ, ম্যান।’ (তুমি চুপ করো)। জনমত জরিপেও দেখা গেছে, আগামী নবেম্বর নির্বাচনে জো বাইডেন ট্রাম্পের চাইতে এগিয়ে আছেন। সাধারণভাবেও ধারণা করা যাচ্ছে নবেম্বর মাসে নির্বাচনে বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গদের জোটবদ্ধ ভোট পেলেও ট্রাম্প জয়ী হবেন না। ট্রাম্প এই পরাজয়ের আভাস পেয়ে ভীত হয়ে পড়েছেন। ফলে আগেভাগেই ঘোষণা করেছেন, তাকে নির্বাচনে পরাজিত ঘোষণা করা হলেও তিনি তা মেনে নেবেন না। তিনি নাকি জানেন, এই নির্বাচনে ভোট কারচুপি করা হবে। এই কারচুপি বন্ধ করার নামে তিনি ডাকযোগে ভোটদান ব্যবস্থা বিলম্বিত করার জন্য ডাক বিভাগের প্রধানের পদে তার এক ঘোর সমর্থককে বসিয়েছেন। তার কপাল ভাল। সুপ্রীমকোর্টের প্রধান বিচারপতির পদ এই সময় শূন্য হওয়ায় তিনি সেখানেও তার এক তল্পিবাহককে বসাবার চেষ্টা করছেন। এভাবে বুশ পরিবারের মতো নির্বাচনে গুরুতর অনিয়ম ঘটিয়ে ট্রাম্প আবার প্রেসিডেন্ট হতে চান। গত শনিবার (৩ অক্টোবর) লন্ডনের ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় এক কলামিস্ট লিখেছেন, ‘ট্রাম্প শুধু মার্কিন গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছেন না, গোটা আমেরিকাকে সাদা কালো দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলেছেন। এখন শুধু আনুষ্ঠানিক বিভক্তিটাই বাকি। ট্রাম্প আরেকবার প্রেসিডেন্ট হলে সেই আনুষ্ঠানিক বিভক্তির কাজটাও করে যাবেন।’ নানা বর্ণের, নানা গোত্রের, নানা ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষ নিয়ে আমেরিকা রাষ্ট্রটি গঠিত। এই রাষ্ট্রটি একটি মহাদেশ। কেবল গণতন্ত্রই এই মহাদেশকে এক সূত্রে বেঁধে রেখেছে। এই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে গেছেন জর্জ ওয়াশিংটন, জেফার্সনের মতো নেতারা। আব্রাহাম লিঙ্কন বুকের রক্ত দিয়ে ঐক্যবদ্ধ আমেরিকান রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ভিত্তি শক্ত করে গেছেন। বলেছেন, ‘গভরমেন্ট জনগণের, জনগণের দ্বারা চালিত এবং জনগণের জন্য।’ এই গণতন্ত্রের ভিত্তি ভাঙ্গার কাজ বুশ পরিবারের প্রেসিডেন্সির আমল থেকেই প্রকৃতপক্ষে শুরু হয়। ট্রাম্প সেই গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেকটি হয়তো ঠুকে দেবেন। বাক্যে ও কার্যে তিনি অশ্লীল। তার ভণ্ডামির অন্ত নেই। করোনা রোগে আক্রান্ত হওয়া নিয়েও তিনি যদি ভণ্ডামি করে থাকেন, তাহলে বিস্ময়ের কিছু নেই। তিনি সিন্দবাদের দৈত্যের মতো মার্কিন জনগণের কাঁধে চেপে বসেছেন। আমেরিকার জনগণ এই দৈত্যকে কাঁধ থেকে নামাতে না পারলে তাদের গণতন্ত্র যেমন ধ্বংস হবে, তেমনি ধ্বংস হবে সারা বিশ্বের গণতন্ত্র। বিপন্ন হবে মানবতা। বিশ্ব মানবতা তাই করোনা মহামারীর মতো ট্রাম্পের কবল থেকেও মুক্তি চায়। এই চাওয়াটাই স্বাভাবিক। লন্ডন, ৬ অক্টোবর, মঙ্গলবার, ২০২০ ॥
×