ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রায়হান আহমেদ তপাদার

করোনার দ্বিতীয় ওয়েব নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশ্ব

প্রকাশিত: ২০:৪২, ৭ অক্টোবর ২০২০

করোনার দ্বিতীয় ওয়েব নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশ্ব

করোনার সঙ্গে মোকাবেলা করার জন্য ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে গোটা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যেই শোনা যাচ্ছে আশার কথা। কোন কোন ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পথে অনেকটা সাফল্যও এসেছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা পুরোপুরি সফল হলেও ভ্যাকসিন বাজারে আসতে এখনও কয়েক মাস লাগবে। এই অবস্থায় দ্বিতীয় দফায় করোনাভাইরাস ফিরে আসতে পারে বলে আগেই সতর্ক করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। সেই দ্বিতীয় ওয়েব ইতোমধ্যে শুরুও হয়ে গিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তার প্রভাবও পড়তে শুরু করেছে। যার জেরে সাময়িক স্বস্তির পরে ফের করোনা নিয়ে কড়াকড়ি শুরু হয়েছে নানা দেশে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে দ্বিতীয় দফায় আরও ভয়াবহ চেহারা নিতে পারে করোনা। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপের একাধিক দেশে করোনা সংক্রমণ ফের বেসামাল হয়ে উঠেছে। ফ্রান্স, ব্রিটেনের মতো দেশে আক্রান্তের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। আর করোনার এমন বেনজির তা-বের পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপীয় দেশগুলোকে সতর্ক করে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, করোনার সংক্রমণ যেভাবে ছড়াচ্ছে, তাতে ইউরোপীয় দেশগুলোতে দ্বিতীয় দফার ঢেউ যে কোন মুহূর্তে আছড়ে পড়তে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক হান্স ক্লুজ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলেছেন, ‘ইউরোপে গত মার্চে করোনা মহামারীর সংক্রমণ যখন চূড়ায় পৌঁছেছিল, তার চেয়েও বর্তমান পরিসংখ্যান খারাপ ইঙ্গিত দিচ্ছে। বর্তমানে ইউরোপে নতুন করে সংক্রমিতের সংখ্যা তিন লাখের গণ্ডি ছাড়িয়েছে। ইউরোপের অর্ধেকের বেশি দেশেই গত দুই সপ্তাহে ১০ শতাংশ নতুন রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। সাতটি দেশে নতুন সংক্রমণ বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। গত কয়েক সপ্তাহের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যায় ইউরোপে গত জুন মাসে সংক্রমণ সবচেয়ে কম ছিল। কঠোর লকডাউনের ফল মিলেছিল। কিন্তু লকডাউন শিথিল হওয়ার পরে সেপ্টেম্বরে সংক্রমণের হার এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে আমাদের সবার সচেতন হওয়ার সময় এসেছে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে ইউরোপে ৫০ থেকে ৭৯ বছর বয়সীদের মধ্যে করোনার সংক্রমণ বেড়েছে। তবে নতুন আক্রান্তদের মধ্যে এখনও বেশিরভাগই ২৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী। উল্লেখ্য, এখনও পর্যন্ত ইউরোপ মহাদেশে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৪৯ লক্ষের বেশি মানুষ। মৃত্যুর মুখে লুটিয়ে পড়েছেন ২ লাখ ২৬ হাজারের বেশি। ফ্রান্সে সংক্রমণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে আইসিইউ শয্যা নিয়ে সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ব্রিটেনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানকক জানিয়েছেন, করোনার নতুন সংক্রমণ আছড়ে পড়ায় প্রতি আট দিনে হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হচ্ছে। চীনের উহান শহর থেকে প্রাণঘাতী করোনার সংক্রমণ-বিস্তারের প্রাদুর্ভাব পুরো বিশ্বকে অব্যাহত বিপন্ন করে তুলেছে। উন্নত-অনুন্নত ও ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে পৃথিবী নামক এই গ্রহে প্রতিটি দেশ-অঞ্চলে এই সংক্রমণের প্রসারমানতা এবং প্রাণ সংহারের পরিসংখ্যান বিরল অধ্যায় রচনা করেছে। সম্প্রতি করোনায় দেশে প্রাণহানির সংখ্যা চীনকেও ছাড়িয়ে গেছে। আগামী শীত মৌসুমে দেশে এই সংক্রমণের দ্বিতীয় তরঙ্গের আঘাত সম্পর্কে নতুন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। গত মাসে এই সংক্রমণের বিস্তার কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে উপনীত হওয়ার বিবেচনায় অর্থনৈতিক চাকা সচল করার লক্ষ্যে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা উন্মুক্ত করা হয়েছে। গত ৩১ আগস্ট থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যান্য সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে ঘোষিত সাধারণ ছুটির শিথিল প্রক্রিয়ায় নিয়মিত কার্যক্রমে ফিরে আসার পরিক্রমা প্রশস্ততা লাভ করেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, সংক্রমণ প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা প্রতিপালনে জনসচেতনতার প্রচ- ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। করোনায় প্রতিদিনের মৃত্যুহার স্বস্তির চৌহদ্দি নির্মাণ করতে অপারগ। এরই মধ্যে ইতালি, ফ্রান্সসহ উন্নত বিশ্বে অনেক দেশে করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বিশ্বের সব নাগরিকের মতো ভ্যাকসিনসহ নানাবিধ উপকরণ আবিষ্কার করোনা প্রতিরোধ এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে এটি জয় করার সম্ভাবনা আমাদেরও প্রাণিত করেছে। কিন্তু দ্বিতীয় তরঙ্গের অনাদৃত ভীতি কেন জানি আমাদের আনন্দ উপভোগের যাত্রাকে রুদ্ধ করে দিচ্ছে। করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গ নিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি-সংস্থার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি এখন থেকেই নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন অপরিহার্য। এখনও দেশে সংক্রমণের হার প্রায় ১২-১৪ এবং মৃত্যুর হার ১.৩৯ শতাংশ। কোভিড-১৯ এর কারণে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিণতির মুখোমুখি হচ্ছে বিশ্বের সব স্তরের শিশু-কিশোর। ইউনিসেফ সূত্রমতে, ৮০ মিলিয়নেরও বেশি শিশু চরম দারিদ্র্যের সম্মুখীন, ১.৬ বিলিয়ন শিশু স্কুলের বাইরে রয়েছে এবং এক বছরের কম বয়সী ৮০ মিলিয়ন শিশু জীবন রক্ষাকারী ভ্যাকসিন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এরই মধ্যে ক্ষুধার্ত শিশুর সংখ্যা ৩৬ মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। দ্রুততার সঙ্গে সম্ভাব্য সঙ্কট উত্তরণে মনন ও সৃজনশীল চিন্তা-ভাবনার সমন্বয়ে নতুন উদ্ভাবনী পন্থায় কর্মকৌশলের দৃশ্যমান কার্যকর বাস্তবায়নে সময় ক্ষেপণের কোন সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। একদিকে করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গের পূর্বাভাস এবং অন্যদিকে এর অদমনীয় বিস্তার প্রতিকূলে সংক্রমণ মুক্তির লক্ষ্যে ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও বিক্রয়, উন্নত বিশ্বের কতিপয় দেশের ক্রমবর্ধমান স্নায়ুযুদ্ধ, স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ ও সরঞ্জামাদির বাণিজ্যিকীকরণের অশুভ-অসম প্রতিযোগিতার লুম্পেন দৃশ্যপটে বিশ্ববাসী চরম উদ্বিগ্ন। আর্থ-সামাজিক ও সামগ্রিক মানব-প্রতিবেশের ওপর এর নিদারুণ বৈরী প্রভাব জগজ্জনে অনাকাক্সিক্ষত-অনভিপ্রেত পরবাদ সুদৃঢ় করছে। সামগ্রিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে প্রায়োগিক কোন পন্থা এখনও সমধিক সুস্পষ্ট নয়। চলমান দরিদ্রতা, ক্ষুধা ও কর্মহীনতার নির্মম মহামারীর করুণ পদধ্বনি মানব-সঙ্কট সমাধানে অতিশয় অবিশ্বাস ও অনাস্থার প্রেক্ষিত রচনা করে চলেছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি অক্সফাম ইন্টারন্যাশনাল সূত্র জানিয়েছে যে, এখন থেকেই যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়া হলে বছরের শেষ পর্যায়ে বিশ্বে দিনে ১২ হাজারের বেশি মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করতে পারে। সবচেয়ে বেশি সঙ্কটাপন্ন ও চরম ক্ষুধার হটস্পট হিসেবে ১০টি দেশ অনুমিত হয়েছে। ইয়েমেন, ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, আফগানিস্তান, ভেনিজুয়েলা, পশ্চিম আফ্রিকান সাহেল, ইথিওপিয়া, সুদান, সাউথ সুদান, সিরিয়া ও হাইতি অন্যতম। এমনকি এশিয়া, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোন দেশ এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত না হলেও এতদঞ্চলে কর্মচু্যুত জনগোষ্ঠীর হাহাকার পুরো অঞ্চলকে অতিশয় অস্থিতিশীল করে তুলবে-নিঃসন্দেহে তা বলা যায়। অতিসম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলন অনুসারে, বছরের শেষ দিকে বিশ্বে প্রায় দশ কোটি মানুষ চরম দরিদ্রতার নিষ্ঠুর শিকারে নিপতিত হবে। বিভিন্ন বৈশ্বিক এবং দেশীয় প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অচিরেই বিশ্বে বিশ-পঁচিশ কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে। এর মধ্যে আমাদের এই মহাদেশ ও উপমহাদেশে সাড়ে বারো কোটি লোকের কর্মহীনতার অশনিসঙ্কেতও প্রক্ষেপিত হচ্ছে। করোনার বিপর্যস্ত অতিক্রান্তকালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিরোধ-বিচ্ছেদ-সংঘাত এবং উপার্জন ও জীবন নির্বাহের কঠোর বৈষম্য নতুন বৈশ্বিক রূপ পরিগ্রহ করেছে। সম্প্রতি বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে দুঃসাধ্য দাবানলের বিপরীতে ভারত-চীনসহ অনেক দেশে ভয়াবহ বন্যার নতুন ধ্বংসযজ্ঞ প্রকীর্ণ হয়েছে। বদ্বীপ খ্যাত ক্ষুদ্র আয়তনের আমাদের দেশেও এর নেতিবাচক প্রভাব বিরাজমান বিপন্নতায় নতুন মাত্রিকতা যোগ করেছে। সম্প্রতি বিআইজিডি ও পিপিআরসির যৌথ গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে করোনাকালে নতুন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে দেশে দারিদ্র্যের হার ৪২ শতাংশ। আয়মূলক কর্মহীন পরিবারের সংখ্যা ১৭ শতাংশ। ব্যাপক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিকের কর্মহীনতার হার সবচেয়ে বেশি। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশে আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল থামছেই না। মহামারী এ করোনার থাবা কখন শেষ হবে সেটাও কেউ বলতে পারছে না। যেসব দেশ ভাইরাসটিকে ইতোমধ্যে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে, তাদের মধ্যেও সংক্রমণ দ্বিতীয় দফায় (সেকেন্ড ওয়েব) ফিরে আসা নিয়ে ভীতি রয়েছে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার সেকেন্ড ওয়েব বাংলাদেশে আসলে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। এ অবস্থায় বর্তমান অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সেকেন্ড ওয়েব মোকাবেলায় আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয়া জরুরী। সবারই কম-বেশি জানা, বাংলাদেশের হেলথ ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম খুবই দুর্বল ও সেকেলের। ফলে আমরা জানি না ঠিক এই মুহূর্তে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের অবস্থান ঠিক কোথায়। আমরা প্রথম ঢেউয়ের কোন অবস্থানে আছি, দ্বিতীয় ঢেউ আসবে কিনা, আসলে সেটা কবে নাগাদ আসবে-এর কোন কিছুই আমরা বিজ্ঞানসম্মত তথ্যের ভিত্তিতে জানি না। অনেকে অনেক মন্তব্য করে থাকেন, কিন্তু মন্তব্যগুলো শুধু নিজস্ব অনুমানের ভিত্তিতে করা, যার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় প্রস্তুত কথাটি বলতে পারছি না। জনগণকে করোনার ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক এখনও করা যায়নি, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ পরিষ্কার-পরিছন্ন থাকার বিষয়টি এখনও দেশের বেশিরভাগ মানুষ আমলে নিচ্ছেন না, করোনা শনাক্তকরণ এবং কন্টাক্ট ট্রেসিং করার ক্ষেত্রে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য সাফল্য এখনও দেখা যাচ্ছে না। লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক [email protected]
×