ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যা মামলা

মিন্নিসহ ৬ আসামির ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে

প্রকাশিত: ২২:২৪, ৫ অক্টোবর ২০২০

মিন্নিসহ ৬ আসামির ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে

বিকাশ দত্ত ॥ নিম্ন আদালতের পর এবার উচ্চ আদালতে বরগুনার বহুল আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলার আইনী লড়াইয়ের পালা। ইতোমধ্যে এ মামলায় রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিসহ ছয় আসামির ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদন্ডদেশ অনুমোদন) হাইকোর্টে পৌঁছেছে। নিয়ম অনুয়ায়ী এ কাজগুলো এগিয়ে যাবে। এদিকে মিন্নির আইনজীবী জানিয়েছেন, চলতি সপ্তাহেই হাইকোর্টে আপীল দায়ের করবেন। অন্যদিকে মিন্নির বাবা বলেছেন, আমরা উচ্চ আদালতে আপীল করব। আশাবাদী আমার মেয়ে উচ্চ আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হবে। সুপ্রীমকোর্টের স্পেশাল অফিসার ও সুপ্রীমকোর্টের মুখপাত্র ব্যারিস্টার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেছেন, রবিবার হাইকোর্টে এ মামলার ডেথ রেফারেন্স এসেছে। মামলার রায়ের কপিসহ চার শতাধিক পৃষ্ঠার নথিপত্র হাইকোর্টে নিয়ে আসেন বরগুনা আদালতের জারিকারক জাহাঙ্গীর আলম পিকু। নিয়ম অনুযায়ী, মৃত্যুদন্ড অনুমোদনের জন্য (ডেথ রেফারেন্স) মামলার যাবতীয় কার্যক্রম উচ্চ আদালতে পাঠানো হয়। রায় হাইকোর্টে আসার পর আসামিরা সাত দিনের মধ্যে আপীল আবেদন করতে পারবেন। মূলত কোন আসামির মৃত্যুদন্ড হলে তা কার্যকরে হাইকোর্টের অনুমোদন লাগে, যা ‘ডেথ রেফারেন্স’ মামলা হিসেবে পরিচিত। তবে দন্ডিতরা বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে জেল আপীল ও আপীলের সুযোগ পাবেন। ওই নথি আসার পর হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সংশ্লিষ্ট মামলার পেপারবুক প্রস্তুত করে। পেপারবুক (মামলার বৃত্তান্ত) প্রস্তুত হলে মামলাটি শুনানির জন্য প্রস্তুত হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। তবে কোন কোন মামলার ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির নির্দেশে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক তৈরি করা হয়। পেপারবুক তৈরির পর তা যাচাই-বাছাই করা হয়। যাচাই-বাছাই শেষে তা প্রধান বিচারপতির নিকট উপস্থাপন করা হয়। তারপর শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতি বেঞ্চ গঠন করেন। চলতি সপ্তাহেই আপীল ॥ মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির আইনজীবী এ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না জনকণ্ঠকে বলেছেন, আমরা চলতি সপ্তাহের মধ্যেই আপীল দায়ের করব। রবিবার হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স এসে পৌঁছেছে। এখন নিয়ম অনুয়ায়ী কাজ চলবে। সে হিসেবে এ মামলায় এখন উচ্চ আদালতে আইনী লড়াই শুরু হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, মামলার কাগজপত্র সবেমাত্র পেয়েছি। দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই যেন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আগে মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন রায়ের কপি ও ওকালতনামা নিয়ে হাইকোর্টে জেড আই খানের চেম্বারে পৌঁছান। আইনজীবীরা জানান, ফৌজদারি মামলায় বিচারিক আদালত যখন আসামিদের মৃত্যুদন্ড দেয় তখন ওই দন্ড কার্যকরের জন্য হাইকোর্টের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। ‘আমি আশাবাদী মেয়ে নির্দোষ প্রমাণিত হবে’ ॥ আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর রবিবার সাংবাদিকদের বলেছেন, মিন্নি নির্দোষ। একটি কুচক্রীমহল ষড়যন্ত্র করে তার মেয়েকে এ মামলায় ফাঁসিয়েছে। একটি প্রভাবশালী মহলকে আড়াল করার জন্যই তার মেয়েকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে। এখন আইনজীবী জেড আই খান পান্না ও মাক্কিয়া ফাতেমা ইসলামের মাধ্যমে উচ্চ আদালতে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করব। আমি আশাবাদী আমার মেয়ে উচ্চ আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হবে। রবিবার দুপুরে হাইকোর্টে সাংবাদিকদের জানান, তার মেয়ে মিন্নি শুধু আব্বা শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ উচ্চারণ করতে পারেনি। কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে। বুধবার মিন্নিসহ ছয়জনের মৃত্যুদ-ের রায়ের পর তাদের বরগুনা কারাগারে নেয়া হয়েছে। সেখানে তাদের কনডেম সেলে রাখা হয়। তিনি বলেন, সকাল ১০টার দিকে কারাগার থেকে মিন্নি আমার ও আমার স্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছে। সে খুব কান্নাকাটি করেছে। কারাগারে মিন্নি ভাল নেই। তাকে একা একটি নির্জন কক্ষে রাখা হয়েছে। বরগুনা জেলা জজ ও দায়রা আদালতের রায় ॥ গত ৩০ সেপ্টেম্বর বুধবার বেলা পৌনে ২টার দিকে রায় ঘোষণা করেন বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোঃ আছাদুজ্জামান। এ মামলায় চারজনকে খালাস দিয়েছে আদালত। রায়ে ১০ আসামির মধ্যে মিন্নিসহ ছয়জনকে মৃত্যুদন্ডাদেশ প্রদান করা হয়। পাশাপাশি ছয় আসামিকে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদন্ড প্রদান করা হয়। রায়ে বলা হয়, মৃত্যুদন্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ ধারার বিধান মতে এ রায় ও দন্ডাদেশসহ হাইকোর্ট বিভাগে প্রেরণ করা হোক। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্তরা হলেন, মোঃ রাকিবুল হাসান রিফাত ওরফে রিফাত ফরাজী, আল কাইয়ুম ওরফে রাব্বী আকন, মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত, রেজোয়ান আলী খান হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয়, মোঃ হাসান ও আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি। খালাস পেয়েছেন মোঃ মুসা (পলাতক), রাফিউল ইসলাম রাব্বি, মোঃ সাগর এবং কামরুল ইসলাম সাইমুন। ২০১৯ সালের ২৬ জুন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বরগুনা সরকারী কলেজ রোডের ক্যালিক্স একাডেমির সামনে স্ত্রী মিন্নির সামনে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে জখম করে নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজীর সহযোগীরা। গুরুতর অবস্থায় রিফাতকে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রিফাত মারা যান। এরপর রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ বাদী হয়ে সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ডকে প্রধান আসামি করে ১২ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত পাঁচ-ছয়জনের বিরুদ্ধে বরগুনা থানায় হত্যা মামলা করেন। এ মামলায় প্রথমে মিন্নিকে প্রধান সাক্ষী করেছিলেন নিহত রিফাতের বাবা। ২ জুলাই ভোরে জেলা সদরের বুড়িরচর ইউনিয়নের পুরাকাটা ফেরিঘাট এলাকায় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ প্রধান আসামি নয়ন বন্ড (২৫) নিহত হন। ওই বছরের ১৬ জুলাই মিন্নিকে তার বাবার বাসা থেকে বরগুনা পুলিশ লাইনসে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে এ হত্যায় তার সংশ্লিষ্ট রয়েছে বলে মনে হওয়ায় ওইদিন রাতেই মিন্নিকে গ্রেফতার দেখায় পুলিশ। আদালতের পর্যবেক্ষণ ॥ বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোঃ আছাদুজ্জামানের রায়ে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে। যার মধ্যে রয়েছে, রিফাত শরীফকে হত্যা পরিকল্পনার মূল উদ্যোক্তা (মাস্টারমাইন্ড) ছিলেন তার স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি। নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজী যখন রামদা দিয়ে ভিকটিম রিফাত শরীফকে কোপাচ্ছিল তখন নয়নকে ঠেকাতে মিন্নির চেষ্টা ছিল অভিনয় মাত্র। এই অভিনয়ের আড়ালে সুকৌশলে আসামি রিফাত ফরাজী যাতে ভিকটিম রিফাত শরীফকে আঘাত করতে পারে সেই সহায়তা করে মিন্নি। হত্যাকান্ডের দুটি ভিডিও ফুটেজ এই মামলার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জীবন্ত সাক্ষ্য। মিন্নির কারণেই রিফাত নির্মমভাবে খুন হয়েছেন। মিন্নির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে তার তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তার বয়সী মেয়েদের বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। ‘কতিপয় ব্যক্তি মিলিয়া কোন অপরাধমূলক কাজ করিলে সেই অপরাধের জন্য তাহাদের প্রত্যেককে সমানভাবে দায়ী করা হইবে। সেই কারণেই দন্ডাদেশপ্রাপ্ত সকল আসামি সমানভাবে অপরাধী।’
×