ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

উদ্বিগ্ন অভিভাবক

বাড়ছে কিশোর গ্যাং কালচার

প্রকাশিত: ২২:১৯, ৫ অক্টোবর ২০২০

বাড়ছে কিশোর গ্যাং কালচার

রাজন ভট্টাচার্য ॥ নাইন স্টার বয়েজ থেকে মুক্ত ডন। এরসঙ্গে সমসাময়িক আরও নাম যুক্ত হয়েছে কয়েক বছর আগেই। এখন কিছু থেকে অগণিত, অসংখ্য। পাওয়ার বয়েজ, বিগ বস, নাইন এমএম বয়েজ, ডিসকো বয়েজ, পাটোয়ারী গ্রুপ, আতঙ্ক গ্রুপ, চাপায়-দে গ্রুপ, ফিল্ম ঝিরঝির গ্রুপ, লারা-দে গ্রুপ, গ্রুপ টোয়েন্টিফাইভ থেকে লেভেল হাই, ও দেখে-ল চিনে-ল সহ কোপাইয়া-দে গ্রুপ ...। এসব নাম দেখে যে কারও একটু ধাক্কা খাওয়া স্বাভাবিক। কিসের নাম এগুলো। কোন সিনেমা টিনেমা নয় তো...আবার। না। একেবারেই না। যারা অপরাধ বিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত বা অপরাধীদের নিয়ে কাজ করেন তাদের পক্ষে সহজেই বিষয়টি অনুমান করা সম্ভব। তবে সাধারণ মানুষের পক্ষে এসব নাম থেকে স্পষ্ট ধারণা নেয়া কঠিন। বলছি কিশোর গ্যাং-এর কথা। কিশোর গ্যাং। হ্যাঁ। দেশের বিপথগামী শিশু ও তরুণ সমাজের একটি বড় অংশ এখন গ্যাং কালচারের সঙ্গে যুক্ত। রাজধানী শহর থেকে এখন গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়েছে এমন অপরাধের ঢেউ। শিশুদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভয়ঙ্কর এই গ্যাং সংস্কৃতি। তাই ভবিষ্যত প্রজন্ম নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবক থেকে শুরু করে সমাজবিজ্ঞানী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। যদিও এই সংস্কৃতি শুধু বাংলাদেশেই নয়। বিশ্বের অন্য দেশের শিশুরাও নিজেদের যুক্ত করেছে বেপরোয়া গ্যাং কালচারের সঙ্গে। এফএইচবি, ফিফটিন, ব্লাক রোজ, কেনাইন, ডিসকো বয়েজ, পোটলা বাবু, আলতাফ জিরো, ক্যাসল বয়েজ, ভাইপার, সুজন ফাইটার, তুফান, থ্রি গোল গ্যাং সহ এ রকম বিভৎস নাম দিয়ে কিশোর অপরাধীরা পাড়া মহল্লায় নিজেদের আধিপত্য জানান দিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে গ্যাং পেজে অস্ত্র উঁচিয়ে মহড়া দেয়ার ছবি আপলোড করা হচ্ছে। সমবয়সী ১৫-২৫ জন কিশোর নিয়ে সড়কে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলার ছবিও দেয়া হয়। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার ছবিও দিয়েও নিজেদের শক্তি সম্পর্কে অন্যদের ধারণা দেয়া হচ্ছে প্রকাশ্যে! বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ছুটি’ গল্পে বলেছিলেন, ‘তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই। তাহার মুখে আধো-আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি এবং কথামাত্রই প্রগলভতা।’ সত্যি সত্যি এই বয়সের বখে যাওয়া শিশু-কিশোরেরা এখন অভিভাবকদের কাছে বালাই হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন তাদের মধ্যে এক ধরনের উন্মাদনা দেখা যায়। সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়। সামাজিক অবক্ষয়, সমাজ পরিবর্তন এবং সমাজের নানাবিধ অসঙ্গতি এবং অস্বাভাবিকতায় খেই হারিয়ে ফেলছে সমাজের কিশোর এবং তরুণেরা। প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে হুমকি-ধমকি। বড়দের অসম্মান করে কথা বলা। দেশী-বিদেশী অস্ত্রের মহড়া। শত্রুকে ঘায়েল করে ফেসবুকে ভিডিও আপলোড। প্রকাশ্যে মাদক গ্রহণ। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা। প্রতিপক্ষকে দেখে নেয়ার হুমকি। দিনক্ষণ দিয়ে হত্যার ইশারা দিয়ে স্ট্যাটাস। পান থেকে চুন খসলেই সংঘাত-সংঘর্ষ। ইভটিজিং, মাদক ব্যবসা, ছিনতাই খুন-খারাবি ও চাঁদাবাজি হচ্ছে হরহামেশা চলছেই। মাদকাসক্ত হয়ে গভীর রাতে চলছে ভয়ঙ্কর গতির নেশা ও পার্টি। করোনাকালেও এভাবে সারাদেশে গ্যাং কালচারের ভয়াল বিস্তার হয়েছে কোমলমতি শিশুদের মধ্যেও। এরসঙ্গে যুক্ত শিশু কিশোরদের বয়স ১৩ থেকে ২০ বা ২১ এর মধ্যে। যাদের ওপর নির্ভর করে আগামীর দেশ। অথচ প্রায় প্রতিদিনই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কিশোর গ্যাংয়ের বিভিন্ন সংঘাতের খবর আসছে। শুধু সংঘাত নয়, প্রায়ই গ্যাং দ্বন্দ্বে খুনখারাবির মতো ঘটনাও ঘটছে। সমাজ ও অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন, পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে তালমিলিয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। তারা মূলত পশ্চিমা রীতিনীতি অনুসরণ করেই তাদের কর্মকান্ড পরিচালনা করছে। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে আকাশ সংস্কৃতি, তথ্য প্রযুক্তির অবাধ অপব্যবহারসহ পরিবার তথা অভিভাবকদের ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় তদারকির অভাব। কেউ কেউ বলছেন, যৌথ পরিবারগুলোর ভাঙ্গন শিশুদের বিপথগামী করে তোলার অন্যতম কারণ। অল্প বয়সে মোবাইল ফোনে আসক্তি, দেশী-বিদেশী টেলিভিশনে অপরাধ বিষয়ক নানা অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন শিশুদের অনেক সময় বিপথে টানতে উৎসাহ যোগাচ্ছে। সুস্থ ধারার সংস্কৃতির বিকাশ হ্রাস পাওয়ার কারণেও সামাজিক অবক্ষয় ঘটছে বলে মনে করেন অনেকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, দেশের কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের গতিবিধি, কর্মকান্ডের ওপর নজরদারি চলছে। গোয়েন্দা তথ্যমতে, দেশজুড়ে কিশোর গ্যাংয়ের দুই শতাধিক গ্রুপ সক্রিয়। এদের মধ্যে ছোটবড় মিলিয়ে দেড় শতাধিক দলের তৎপরতা দৃশ্যমান। তবে কিশোর গ্যাংয়ের বেশি তৎপরতা ঢাকায়। ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় শতাধিক গ্রুপের কমবেশি অস্তিত্ব ঢাকায় আছে। বিশেষ করে অভিজাত এলাকাগুলোতে এই তৎপরতা বেশি। যাদের আধিপত্যের খবরে অন্য এলাকার শিশুদের মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা ছড়াচ্ছে। উঠতি বয়সী তরুণদের দ্রুত টানছে এই ধরনের অপরাধ জগত। কোমলমতি শিশুদের অপরাধের মাত্রা দেখে অনেকে বিস্মিত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য বলছে, রাজধানীতে গত ৪ মাসে ১৩টি নৃশংস হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত এই কিশোর গ্যাং। সামাজিক সংগঠন কিংবা খেলাধুলার নামে তুরাগের দিয়াবাড়ি এলাকায় প্রকাশ্যে গড়ে উঠেছে কিশোরদের কিছু সংগঠন ও ক্লাব। ঢাকাসহ সারাদেশে যখন কিশোর গ্যাং এক আতঙ্কের নাম এই পরিস্থিতিকে সামনে রেখে এবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিশু দিবস। প্রতি বছরের অক্টোবর সামের প্রথম সোমবার দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। বিশ্ব শিশু দিবস এবং শিশু অধিকার সপ্তাহ ২০২০ উপলক্ষে আয়োজিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে অনলাইনে এবং সেটি উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এ বছর বিশ্ব শিশু দিবসের প্রতিপাদ্য ‘শিশুর সঙ্গে শিশুর তরে, বিশ্ব গড়ি নতুন করে’। বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ উপলক্ষে ঢাকায় বাংলাদেশ শিশু একাডেমিসহ দেশব্যাপী নানা ধরনের কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। আজ সোমবার থেকে ১১ অক্টোবর সপ্তাহব্যাপী শিশুর সুরক্ষা, বিকাশ ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিষয়ভিত্তিক কর্মসূচী অনলাইনে পালন করা হবে। চলমান কোভিড পরিস্থিতির কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় শিশু অধিকার সপ্তাহের সব অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে অনুসরণ করা হবে। প্রতিবছর নতুন নতুন প্রতিপাদ্য নিয়ে বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ পালন করা হয়। কিন্তু শিশুরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের বদলাচ্ছে। ভালর কিছুর পাশাপাশি নতুন অপরাধের জগত গ্রাস করছে তাদের। ফলে শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ থেকেই যাচ্ছে। সম্প্রতি ঢাকার উত্তরায় ‘অপু ভাই’ নাম খ্যাত টিকটক ভিডিও নির্মাতা একটি রাস্তা অবরোধ করে ৭০-৮০ কিশোর মিলে ভিডিও তৈরি করছিল। সেই মুহূর্তে রবিন নামক এক প্রকৌশলী গাড়ি নিয়ে সড়ক পার হতে গেলে অপু ভাইসহ তার দল মিলে মারপিট করে ওই ব্যক্তির মাথা ফাটিয়ে দেয়। দেশজুড়ে এ নিয়ে তুমুল হইচই হয়। ধরা পরে কিশোর অপরাধীরা। পুলিশী তদন্তে বেরিয়ে আসে কিশোর অপরাধের বিভৎসতা। নিজেদের সন্তান নানা ধরনের কিশোর অপরাধে যুক্ত হওয়ায় অনেক অভিভাবক উদ্বিগ্ন। কিন্তু আত্মসম্মানের ভয়ে নিজেদের গুটিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন তারা। শিক্ষাবিদরা বলছেন, কিশোরদের গ্যাং কালচার এবং কিশোর অপরাধ বর্তমান সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যা। নিরসনে দরকার সর্বসম্মতিক্রমে সামাজিক আন্দোলন। এক্ষেত্রে পরিবারকে সচেতন থাকতে হবে বেশি। কারণ তাদের ছেলেমেয়ে কার সঙ্গে মিশছে, কীভাবে বড় হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখতে হবে। কেননা পরিবার মানুষের আদি সংগঠন এবং সমাজ জীবনের মূলভিত্তি। পরিবারের সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধে কিশোরদের গড়ে তুলতে সচেষ্ট হতে হবে। শিশু-কিশোরদের জন্য কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা এবং তাদের সংশোধনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার থাকতে হবে। কিশোরদের সমাজের ইতিবাচক কাজে সম্পৃক্ত রাখতে হবে। তাই এর জন্য সমাজ ও দেশের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা রাখা চাই। এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শফিকুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি গণমাধ্যমে বলেছেন, কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বন্ধে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছি। সাম্প্রতিক সময়ে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় পুরনো তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে। শীঘ্র্রই তাদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের অভিযান চালানো হবে। কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বন্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন সময়ে দৃশ্যমান কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এ ধরনের অভিযান অব্যাহত না থাকলে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে। কিশোররা যেন অপরাধে জড়াতে না পারে সেজন্য অভিভাবকদেরই বেশি সচেতন হতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অভিযানের পাশাপাশি শিক্ষক-অভিভাবকসহ সবাই সোচ্চার না হলে গ্যাং কালচার বন্ধে কাক্সিক্ষত সুফল মিলবে কিনা, এ নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। প্রশ্ন হলো অভিভাবকদের সামনে কিভাবে কিশোররা অপরাধে জড়াচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে নেত্রকোনার সদর উপজেলার বাংলা গ্রামের এক অভিভাবক বলেন, আমার দুই সন্তানের মধ্যে ছেলে বড়। ছদ্মনাম ‘মানিক’। এসএসসি পাস করার আগেই তাকে মোবাইল ফোন কিনে দিতে হয়েছে। সন্তানের ভালর জন্য সব ধরনের বায়না পূরণ করা হয়েছে। এইচএসসি পড়া অবস্থায় তার মোটরসাইকেল দুটি। পরিবারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে দামী ক্যামেরা কিনে পাহাড়ে গিয়ে মডেল এনে গান চিত্রায়ন করেছে। বাধা দেইনি। আস্তে আস্তে তার স্বভাবে পরিবর্তন আসে। বহু কিশোর দিনভর সঙ্গে থাকে। সারাক্ষণ ফোনে ব্যস্ততা। এ পাড়া ও পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ। আধিপত্য নিয়ে একের পর এক মারামারি। যখন হ্রাস টেনে ধরার চেষ্টা করি তখন ছেলের মাথায় বিয়ে করার সর্বনাশা ভূত। বিভিন্ন এলাকা থেকে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার বিচার আসতে থাকে। দলবল নিয়ে পছন্দের মেয়েদের বাড়ি থেকে তুলে আনার চেষ্টার অভিযোগও পাই। স্কুলে গিয়ে নাবালিকা মেয়ের সিঁথিতে সিঁদুর পরানোর ঘটনায় এলাকায় বের হওয়ার মতো অবস্থা ছিল না আমাদের। এভাবে তিন বান্ধবীকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে বিয়ে করার জন্য বাড়ি নিয়ে আসে সে। সব সমস্যার সমাধান করি ঠান্ডা মাথায়। শেষ পর্যন্ত বিয়ে না করানোর কারণে বাবা-মা-দাদাসহ পরিবারের সবার গায়ে হাত তোলে বখে যাওয়া এই কিশোর...। দেয়া হয় পুলিশে...। মতিঝিল মডেল স্কুলের ছাত্র অভিকের বাবা দিনবন্ধু বলেন, সমাজ বদলে গেছে। পাড়া মহল্লায় ছোট ছোট ছেলেদের আচরণ দেখে অবাক লাগে। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকলেও ছেলেকে নিয়ে টেনশনে থাকি। বিভিন্ন সময় বাইরে যায়। কখন বিপথগামী হয়ে যায়...। ভয় করে। উত্তরার নামী দামী একটি স্কুলের ছাত্রের অভিভাবক আমিনুর রহমান বলেন, লজ্জায় ছেলের কর্মকান্ড কাউকে বলতে পারি না। ১৪ বছর বয়সে ছেলে রাত ১২টার পর বাসায় ফিরে। গা থেকে সিগারেটের গন্ধ। যখন তখন যা ইচ্ছে করে বেড়াচ্ছে। শুধু টাকা চায়। মানসম্মানের ভয়ে প্রতিবাদ করার সাহস করি না। যদি...। অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট আরিফ জেবতিক মনে করেন, শিশুদের বেড়ে ওঠার যথাযথ পরিবেশ তৈরি করতে না পারা এবং অভিভাবকদের দায়িত্বশীলতার অভাবে কারণে পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। তিনি বলেন, ‘গ্যাং কালচার আগেও ছিল, এখনও আছে। তবে এখন দুর্ঘটনা বেশি, সহিংসতাও বেশি। বাচ্চারা প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে বেড়ে উঠছে। তাকে সবকিছুতে সেরা হতে হবে, এই তাগাদা অভিভাবকদের দিক থেকে দেয়া হয়। এই প্রতিযোগিতা শিশু-কিশোরদের আগ্রাসী করে তুলছে উল্লেখ করে এই অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট বলেন, এতে তার মধ্যে দেখিয়ে দেয়ার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু যখন সে কিছু দেখিয়ে দিতে পারছে না, তখন তার সেই হতাশা মস্তানি আকারে বের হচ্ছে। সমাজ ও প্রতিবেশ তাকে যেভাবে বিকৃত করে তুলছে, তার প্রতিক্রিয়ায় এটা হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।’ কিশোরদের সহিংস মানসিকতাকে নিছক শিশু-কিশোরদের ফ্যান্টাসি বলে উড়িয়ে দিতে চান না অপরাধ বিশ্লেষক ড. জিয়া রহমান। তিনি বলছেন, ‘মনে রাখতে হবে, এই বয়সী ছেলেমেয়েরা প্রভাবিত হয় সহজে। জীবনের এই সময়টাতে যেভাবে আপনি ‘হিরোইজম’কে শেখাবেন, সেভাবেই তারা শিখবে। আমাদের সমাজ এর নিজের দুর্নীতিপরায়ণতার কারণে কিশোরদের ইতিবাচক শিক্ষা দেয়ার অধিকার হারিয়েছে। ফলে সে ক্ষমতা বলতে যা শেখে, তা প্রকৃতপক্ষে তাকে সহিংসতার পথে নিয়ে যায়। সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থা কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে ১২ দফা সুপারিশ করেছে। এরমধ্যে অন্যতম সুপারিশ হলো- কিশোরদের ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা দেয়া, তাদের নিয়মিত কাউন্সিলিং করা। প্রতিবেদনটি এরইমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে পাঠানো হয়েছে। সম্প্রতি রাজধানীর চকবাজারে মাদক ব্যবসায় বাধা দেয়ায় এক ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে গুরুতর জখম করে পুরান ঢাকার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য ন্যাডা বাবু ও পিচ্চি হান্নান। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা জানান, চকবাজার, শহীদনগর ও আশপাশ এলাকায় মাদক, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে এ চক্রটি। সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তৌহিদুল হক বলেন, দেশে গ্যাং কালচারের বর্তমান পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। যখন দেশে নিজস্ব সংস্কৃতির ধারা ও সামাজিক ঐতিহ্যের নিয়মকানুন চর্চা না করে বিদেশী উগ্র সংস্কৃতি সমর্থন ও চর্চা করা হয় তখনই কিশোররা বয়সগত কারণে নিজ দেশের সুস্থ সংস্কৃতি বাদ দিয়ে উগ্র সংস্কৃতির চর্চা শুরু করে। বিদেশী বিভিন্ন সিনেমা, ভিডিও দেখে তাদের চলাফেরা, পোশাক, কর্মকান্ডে ভিন্নতা আসে। এমনকি তাদের মধ্যে অপরাধমূলক কর্মকান্ডের প্রতি উৎসাহ বাড়ে। কিশোর অপরাধের প্রেক্ষাপট দেশ, বয়স, সমাজ ভেদে একেকরকম। অন্য দেশে যে আচরণ স্বাভাবিক বলে গণ্য হয় আমাদের দেশের আইনে সেটি অপরাধ বলে গণ্য হয়। আমাদের কিশোররা দেশের নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো বা একাত্ম করতে পারছে না। তিনি বলেন, পরিবারগুলোকে তার সন্তানদের সঠিক পথে রাখার জন্য সর্বোচ্চ সতর্কতা, শিক্ষা অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে। পাশাপাশি আমাদের রাজনৈতিক দলের নেতাদের একটা কমিটমেন্ট থাকতে হবে যে কিশোরদের কোনভাবেই রাজনৈতিক কর্মকান্ডে ব্যবহার করা যাবে না। যদি কোন নেতা কিশোরদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন তবে তার দল তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। সর্বোপরি রাষ্ট্র ও সমাজকে কঠোর হতে হবে। যেসব কারণে কিশোর অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে সে সব কারণ চিহ্নিত করতে হবে। তা না হলে আমাদের দেশে কিশোর অপরাধ একটি সাধারণ আচরণে পরিণত হবে। এর বাইরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কিশোর অপরাধ দমনে আরও কঠোর হতে হবে।
×