ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নীরবে চলছে প্রস্তুতি

পূজার পসরা উৎসবের রং

প্রকাশিত: ২১:৫৪, ৫ অক্টোবর ২০২০

পূজার পসরা উৎসবের রং

মোরসালিন মিজান ॥ পূজার ঢাক, না, এখনও বাজেনি। সুর তুলেনি শঙ্খ। উমার মর্ত্যলোকে আসার ঢের বাকি। তবে বদলে যাওয়া প্রকৃতি উৎসবের আগমনী ঘোষণা করছে ঠিকই। ইতোমধ্যে কাশফুলে ভরে উঠেছে নদীর ধার। শিউলিরা মিষ্টি ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে। বাকি যে ক’টা দিন, দেখতে দেখতে চলে যাবে। আগামী ৬ কার্তিক ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে শুরু হবে সনাতনী উৎসব। সপ্তমী অষ্টমী নবমী এ তিন দিন পুরোদমে চলবে। দশমীর দিন বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে উদ্যাপন। তার আগে চলবে প্রতিমা দর্শন। এক মন্ডপ থেকে আরেক মন্ডপে ঘুরে বেড়ানো। মূলত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উৎসব। যোগ দেবেন অন্যরাও। বরাবরের মতোই অসাম্প্রদায়িক বাঙালী চেতনায় বিশ্বাসী সকল মানুষের হয়ে উঠে শারদীয় উৎসব। তবে পূর্ব প্রস্তুতি নিতে হয় কেবল সনাতনীদেরই। এখনই সে সময়। প্রতিমা গড়া, মন্ডপ সাজানো ছাড়াও কত রকমের কাজ! পূজার কেনাকাটাও বহুবিধ। একটু আগেভাগে শুরু না করলেই নয়। তাই করোনা সংক্রমণের ভয় দু’হাতে দূরে ঠেলে অনেকে নেমে পড়েছেন। ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে পূজার রং। বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের তথ্য মতে, এবার সারাদেশে ৩০ হাজারের বেশি পূজা আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। গত বছর প্রায় ৩১ হাজার ৫০০ পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। রাজধানী শহরে ছিল ২৩৭টি আয়োজন। এবার ২৩২টি স্থানে উৎসব আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। অর্থাৎ করোনাকালে এসেও সংখ্যা খুব একটা কমছে না। তবে স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপর বিশেষ জোর দেয়া হচ্ছে। এ সম্পর্কে পরিষদের সভাপতি নির্মল কান্তি দত্ত বলছিলেন, আমরা এখন বেশি ভাবছি কোভিড পরিস্থিতি নিয়েই। গত ২৬ আগস্ট আমরা যেসব নির্দেশনা দিয়েছিলাম সেগুলো মেনেই উৎসব আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। সবকিছুই এবার একটু সংক্ষিপ্ত আকারে করা হবে। স্থায়ী মন্ডপগুলোর ব্যবস্থাপনা কী হবে তা নিয়ে সংশ্লিষ্টরা কাজ করছেন। কোন কোন অস্থায়ী মন্ডপের অনুমোদন পাওয়া যায়নি এখনও। পাওয়া হয়ে গেলে সেগুলো ঘিরেও উৎসব পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি। নতুন ঢাকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় উৎসবটি যে বনানীতে হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। বিরাট কর্মযজ্ঞ চলছে সেখানেও। বিগত বছরগুলোর মতো এবারও স্বতন্ত্র শিল্প ভাবনাকে প্রাধান্য দিয়ে প্রতিমা গড়া হচ্ছে। এখানকার আয়োজকরা মন্ডপ নির্মাণের কাজটি খুব গুরুত্ব দিয়ে করেন। এবারও ব্যতিক্রম হচ্ছে না। বনানী খেলার মাঠের বিশাল এলাকাজুড়ে মন্ডপ নির্মাণ করা হচ্ছে। একইভাবে কলাবাগান, সিদ্ধেশ্বরী, উত্তরা, খামারবাড়িসহ কয়েকটি পরিচিত স্থানে প্রস্তুত হচ্ছে মন্ডপ। প্রাথমিক কাজ শেষ হওয়ার পর মন্ডপে আলোক সজ্জা করা হবে। এইসব মন্ডপ ঘিরেই চলবে বর্ণাঢ্য উৎসব। প্রতিমা গড়ার কাজ শুরু হয়েছিল আরও আগে। সাধারণত আষাঢ়ে রথযাত্রার পর পরই প্রতিমা গড়ার কাজে হাত দেন শিল্পীরা। এবার কিছুটা আগে পড়ে হয়েছে বটে। থেমে থাকেনি। বর্তমানে পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, লক্ষ্মীবাজার, বাংলাবাজারসহ বিভন্ন এলাকায় দিন রাত প্রতিমা গড়ার কাজ হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে জানতে কথা হয় বাংলা বাজার জমিদার বাড়ির প্রতিমা শিল্পী বলাই পালের সঙ্গে। বাপ-দাদারা দেবী গড়ার কাজ করতেন। এখন তিনি করছেন। কথা প্রসঙ্গে বললেন, করোনার কারণে এবার কাজ কিছুটা কমেছে। তারপরও সকাল ১০টা থেকে অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করছি। অধিকাংশ প্রতিমার মূল কাঠামো নির্মাণ শেষ হয়ে গেছে। এরপর রং করা হবে। জড়ির শাড়ি, কৃত্রিম চুল, বাহারি গহনা দিয়ে সাজানো হবে প্রতিমাকে। সব ঠিক থাকলে নির্ধারিত সময়ের আগেই যাদের প্রতিমা তাদের বুঝিয়ে দিতে পারবেন বলে আশা করছেন তিনি। ঘরে ঘরেও চলছে প্রস্তুতি। বয়স্করা আচার পালনের প্রস্তুতিটাই নিচ্ছেন মূলত। পূজাতে কত কী দরকার হয়! খুঁটিনাটি সব তালিকা করে কিনছেন। এখান থেকে পরিবারের নারী সদস্যরা নতুন করে শাঁখা গড়ে নিচ্ছেন। ছোট ছোট দোকানগুলোতে মেয়েদের প্রাণোচ্ছল উপস্থিতি। কেউ শাখা হাতে পরছেন। কেউ খুলছেন। চলছে দরদাম। আর উৎসবপ্রেমীরা ভিড় করছেন ঢাকার মার্কেট ও শপিংমলগুলোতে। বসুন্ধরা সিটি শপিংমল, এলিফ্যান্ট রোড, বেইলি রোড, আজিজ সুপার মার্কেটসহ বেশ কয়েকটি মার্কেট শপিংমল ঘুরে কেনাকাটার এ দৃশ্য চোখে পড়েছে। কোভিডের কাল হওয়ায় সাধারণ ক্রেতারা কম আসছেন। এ সুযোগে নিরিবিলি পরিবেশে কেনাকাটা সারছেন সনাতনীরা। বিভিন্ন বয়সী মানুষ শোরুম ও দোকান ঘুরে পোশাক পছন্দ করছেন। বসুন্ধরা শপিংমলের ‘দেশী দশ’ -এ কথা হচ্ছিল শিপ্রা ও শিখার সঙ্গে। দুই বোন জানালেন, করোনার কারণে পূজা করতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সংশয়ে ছিলেন। এখন পরিস্থিতি ভালর দিকে। তাই মনে শক্তি পেয়েছেন। কেনাকাটা করতে এসে পূজার আনন্দটাও পেতে শুরু করেছেন বলে জানান তারা। দেশীয় পোশাকের জন্য আলাদা সুনাম আছে আজিজ সুপার মার্কেটের। যে কোন উৎসবকে ধারণ করার, রঙিন করে তোলার কাজটি বলা চলে সচেতনভাবে করেন এখানকার বুটিক বাটিক শপের মালিকেরা। দুর্গোৎসব সামনে রেখেও চমৎকার করে সাজানো হয়েছে শোরুমগুলো। প্রায় প্রত্যেকটি শোরুম ও দোকানে পূজার পসরা। থ্রিপিস শাড়ি পাঞ্জাবি সবকিছুতেই পূজার মোটিফ। ‘আবির্ভাব’ নামের একটি শোরুমে ঢুকে তো মনে হলো, শুরুই হয়ে গেছে উৎসব! এখানে টিশার্টের বড় সংগ্রহ। টিশার্ট বটে। শিল্পকর্মের মতো উপস্থাপন করা হয়েছে। সামনের অংশে দেবী দুর্গার প্রতিমা, সুসজ্জিত মুকুট, ত্রিশূল, আলপনা ইত্যাদির মোটিফ ব্যবহার করা হয়েছে। বেশ লাগে দেখতে। শোরুমের কর্ণধার শিশির বললেন, বাঙালীর ঐতিহ্যবাহী সব উৎসব নিয়েই কাজ করি আমরা। দুর্গোৎসবও এর বাইরে নয়। এ উপলক্ষে টিশার্টের অনেকগুলো ডিজাইন এনেছি আমরা। এভাবে শুধু ব্যবসা নয়, উৎসবটিকে রাঙিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন বলে জানান তিনি।
×