ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

লাগামহীন বাজার ॥ এক কেজি চালের সর্বনিম্ন দাম ৫০ টাকা

প্রকাশিত: ২২:৪৬, ৪ অক্টোবর ২০২০

লাগামহীন বাজার ॥ এক কেজি চালের সর্বনিম্ন দাম ৫০ টাকা

এম শাহজাহান ॥ বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের বেঁধে দেয়া দাম কার্যকর করেননি চালকল মালিকরা। এতে বাড়ছে সব ধরনের চালের দাম। পাইকারি বাজারে জাত ও মানভেদে প্রতিবস্তায় দাম বেড়েছে ২০০-৩০০ টাকা পর্যন্ত। এর প্রভাব খুচরায়। সাধারণ ভোক্তাদের বাড়তি দাম দিয়ে চাল সংগ্রহ করতে হচ্ছে। কষ্ট বাড়ছে নি¤œ আয়ের মানুষের। সরকারী কোন পদক্ষেপেই সিন্ডিকেট মুক্ত হতে পারছে না চালের বাজার। এ অবস্থায় চালের অসাধু ব্যবসায়ী, মজুদদার ও সিন্ডিকেট চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। মূল্য নিয়ন্ত্রণে খাদ্য মন্ত্রণালয় গঠিত সাতটি মনিটরিং টিম মাঠে রয়েছে। এরপরও সিন্ডিকেট মিলমালিকদের কারসাজি বন্ধ হয়নি। অস্থির হয়ে উঠছে চালের বাজার। দাম বাড়ার পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন এরকম মিলারদেরও খুঁজে খুঁজে লাইসেন্স বাতিল করার চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার। এছাড়া চুক্তি অনুযায়ী সরকারকে ধানচাল সরবরাহ না করা এবং অবৈধ মজুদের কারণে মিলমালিকদের কালো তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এর পাশাপাশি চাল আমদানি উন্মুক্ত করে দিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহার করার কথা ভাবা হচ্ছে। জানা গেছে, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে ৪-৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। সবচয়ে কম দামের মোটা স্বর্ণা খ্যাত চাল বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজিতে। আর সরু মিনিকেট ও নাজিরশাইল চাল ৬২-৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। পুরান ঢাকার কাপ্তান বাজারের নুরু রাইছ এজেন্সির স্বত্বাধিকারী মোঃ নূরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, এক সপ্তাহের ব্যবধানে খুচরা কাজারে চালের দাম কেজিতে ৪-৫ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। বিশেষ করে মোটা চালের দাম একটু বেশি। এছাড়া মানভেদে মিনিকেট ৫০ কেজির বস্তা ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর মোটা চালের বস্তা ২ হাজার ৪৫০ থেকে ২ হাজার ৫৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তিনি বলেন, পাইকারি বাজারে চালের দাম বেশি হওয়ার কারণে খুচরায়ও দাম বেশি। চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের কষ্ট বেড়েছে। একেবারে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ ও দিনমজুর মানুষের খাবারের ভরসা মোটা চাল। স্বর্ণা ও চায়না ইরি খ্যাত মোটা চাল গত ১৫ দিন আগে পর্যন্ত রাজধানীতে প্রতিকেজি ৪২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এখন বাড়তে বাড়তে ৫০ টাকায় উঠে গেছে দাম। এ প্রসঙ্গে খিলগাঁও সিটি কর্পোরেশন মার্কেটের চাল বিক্রেতা জামশেদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিকেজি পাইজাম ও লতা চাল ৫২-৫৫, স্বর্ণা চাল ৫০ টাকা, নাজিরশাইল ৫৬-৬০ এবং মিনিকেট মানভেদে ৬২-৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। হঠাৎ করে বাজারে চালের দাম বেড়ে গেছে। কেন বাড়ছে জানতে চাইলে তিনি জানান, শুনেছি ধানের দাম বাড়ার কারণে মিলগেটে চালের দাম বেড়েছে। আর এ কারণে পাইকারি বাজারেও দাম বাড়তি। মজুদকৃত চাল বাজারে না আসলে দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সরকার নির্ধারিত মূল্য কার্যকর না হওয়ায় চাল আমদানি উন্মুক্ত করে দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। মূল্য বাস্তবায়ন না হলে আগামী ১০ দিনের মধ্যে সরকার সরু চাল আমদানির অনুমতি দেবে বলে জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। এর আগে গত মঙ্গলবার খাদ্য ভবনের সম্মেলন কক্ষে চালকল মালিক ও চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। ওই বৈঠকে পঞ্চাশ কেজি ওজনের ভাল মানের এক বস্তা মিনিকেট চালের দাম মিল গেটে ২৫৭৫ টাকা এবং মাঝারি মানের চালের দাম ২১৫০-২২৫০ টাকা নির্ধারণ করে দেয় সরকার। এতে নতুন দর অনুযায়ী, মিল গেটে মিনিকেট চালের প্রতিকেজির দাম পড়বে ৫১ টাকা ৫০ পয়সা। আর মাঝারি চালের দর মিল গেটে পড়বে প্রতি কেজি ৪৫ টাকা দরে। কিন্তু বাজারে এই দাম কার্যকর হয়নি। ওই সময় মন্ত্রী আরও জানান, সবাইকে এই দাম কার্যকর করতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে ১০ দিনের মধ্যে সরু চাল আমদানি করা হবে? একই সঙ্গে ভোক্তা অধিকার আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোন ক্রমেই আগামী এক মাস চালের দাম বাড়ানো যাবে না বলে ব্যবসায়ীদের হুঁশিয়ার করেন সাধন মজুমদার, পারিবারিকভাবে যিনি নিজেও চালকলের মালিক। খাদ্যমন্ত্রী বলেন, র‌্যাব, ভোক্তা অধিদফতর, এনএসআই অভিযানে গেলে আপনাদের মানসম্মান নষ্ট হয়। কিন্তু নওগাঁয় যারা চাল স্টক করে রেখেছিল, তারা ডিসির সঙ্গে বসে বলেছেন, এসব ধান বাজারে ছাড়ার ব্যবস্থা করছি অভিযান বন্ধ রাখুন। ধান তো মজুদ আছে, এই ধান বের করতে হবে। বাজার বাড়ানো যাবে না। চালের পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলেছেন, ১০ দিন ধরে চালকল মালিকরা মিনিকেট এবং মাঝারি চালের দাম কেজিপ্রতি প্রায় ৮ থেকে ৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছেন। তারা বলছেন, এখন মৌসুমের শেষ এবং এ বছরের বন্যার সুযোগ নিয়ে চালকল মালিকরা দাম বাড়ানোর ফলে খুচরা বাজারেও ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। ঢাকার বাদামতলীর পাইকারি চাল ব্যবসায়ী নিজাম উদ্দীন জানিয়েছেন, ৫০ কেজির সরু মিনিকেট চালের বস্তা আড়াই হাজার টাকার জায়গায় কয়েক দিনে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। আর অন্যান্য চালের দামও একই হারে মিলগুলো বাড়িয়েছে। এ কারণে তারা যখন বেশি দরে চাল কিনেছেন, সেটা তাদের খুচরা বিক্রেতাদের কাছে আরও বাড়তি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। ফলে সরু মিনিকেট চালের দাম খুচরা বাজারে প্রতিকেজি ৬২-৬৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। ঢাকা, বগুড়াসহ বিভিন্ন স্থানে পাইকারি চাল ব্যবসায়ীরা চালের মূল্য বৃদ্ধির জন্য মিলমালিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন। চালের দাম বাড়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সম্প্রতি এ অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, দেশে শত শত চালের মিলের মধ্যে ৫০টির মতো মিল বাজার প্রভাবিত করে থাকে। এই বছরেও মৌসুমের শেষে এবং বন্যার কারণে তাদের বাজার প্রভাবিত করার বিষয়টি দৃশ্যমান হয়েছে। এ প্রসঙ্গে চালকল মালিকদের সমিতির সাধারণ সম্পাদক কে এম লায়েক আলী বলেছেন, আমরা যদি নির্ধারিত দামে চাল বিক্রি করি, এরপরে সেটা যখন পাইকারি ও খুচরা বাজারে যাবে তখন দাম আরও বেড়ে যাবে, সেটাও যেন মনিটর করা হয়। সব জায়গায় সরকারী নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন। চালকল মালিকরা বলছেন, বর্তমান বেঁধে দেয়া দরে চাল বিক্রি করতে তারা রাজি আছেন। তবে সে জন্য ধানের দাম কমাতে হবে ও সরবরাহ বাড়াতে হবে। বিভিন্ন ফড়িয়া ও ব্যবসায়ীদের কাছে বিপুল পরিমাণে ধান মজুদ আছে। এসব মজুদ বাজারে আনতে হবে। তাতে ধানের দাম কমবে। এতে চালকল মালিকেরা সরকার নির্ধারিত দামে চাল বিক্রি করতে পারবেন। চালকল মালিকদের দাবি, এখন ধানের যে দাম তাতে সরকারের বেঁধে দেয়া দামে চাল বিক্রি করতে গেলে তাদের লোকসান হবে। তবে প্রতিবস্তা ধানের দাম ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা কমানো সম্ভব, আর তা করলে চালের দামও কমবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অটো মেজর এ্যান্ড হাস্কিং মিলমালিক সমিতির সভাপতি আব্দুর রশীদ জনকণ্ঠকে বলেন, বাজারে সরু ও মাঝারি মানের প্রতি মণ ধানের দাম এক হাজার ৩০০ থেকে দেড় হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এই দামে ধান কিনে চাল বিক্রি করতে গেলে তাদের লোকসান হয়ে যাবে। তবে সরকার সহযোগিতা করলে ও মজুদদারদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ধানগুলো মুক্ত করলে বাজারে সরবরাহ বাড়বে। এতে দামও কমবে। চালও সরকার নির্ধারিত দামে তারা বিক্রি করতে পারবেন। তবে সরকার দর নির্ধারণ করে দেয়ার পরেও খুচরা বাজারে চালের দাম না কমার বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজধানীর বাবুবাজার-বাদামতলী চাল আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিজামউদ্দিন জানিয়েছেন, এর পেছনে মিলারদের কারসাজি রয়েছে। মিলাররা সরকারী বৈঠকে নির্ধারিত দরের বিষয়ে সম্মতি দিয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু তারা নির্ধারিত দরে তারা চাল বিক্রি করছেন না। ফলে পাইকারি ও খুচরা বাজারে কোন প্রভাব পড়েনি। ২৫ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহার করে চাল আমদানি চালুর চিন্তাভাবনা ॥ সবমিলিয়ে চাল আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্কারোপ করা হয়েছে। মূলত ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার স্বার্থে সরকার এই শুল্কারোপ করে। এতে কৃষক ভাল দামও পান। কিন্তু আমদানি বন্ধের সুযোগ নিয়েছে অসাধু মিলমালিক ও চালের সিন্ডিকেট চক্র। আর এ কারণে চালের দাম বেড়ে গেছে। তবে খাদ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে চাল আমদানির সুযোগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে আমদানির উপর থেকে ২৫ শতাংশ প্রত্যাহার করা হতে পারে। সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)-এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী নবেম্বর পর্যন্ত চাহিদা মিটিয়ে ৫.৫৫ মিলিয়ন টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। তাই দেশে খাদ্য ঘাটতির কোন আশঙ্কা নেই। এ গবেষণায় দেখা গেছে, চালের উৎপাদন গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩.৫৪ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বোরো ও আমন মৌসুমের উদ্বৃত্ত উৎপাদন থেকে হিসাব করে, জুন পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে ২০.৩১ মিলিয়ন টন চাল ছিল। আগামী নবেম্বর পর্যন্ত ১৬.৫০ কোটি মানুষের চাহিদা মিটানোর পরেও ৩৬-৭৮ দিনের চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। এছাড়া নবেম্বরের মধ্যে দেশের ফুড বাস্কেটে নতুনভাবে আউশ ও আমনের উৎপাদন যুক্ত হবে। আর সরকারের গুদামে এখনও ১০ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুদ আছে। ফলে দেশে আপাতত খাদ্য ঘাটতির কোন আশঙ্কা নেই। এছাড়া বন্যায় আউশ, আমনের ক্ষতির কথা বলা হলেও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, বন্যার এই ক্ষতি সামগ্রিক খাদ্য উৎপাদনে বড় কোন নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। আর প্রয়োজন হলে চাল আমদানি করা হবে। প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালে হাওড়ে ফসল বিপর্যয়ের পর মোটা চালের দাম বেড়ে কেজিতে ৫০ টাকা হয়েছিল। বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য তখন সরকার চালের আমদানি শুল্ক কমিয়ে শূন্যের কোটা নামিয়ে আনে। হাওড়ের বন্যায় সরকারী হিসাবে ৬ থেকে ১০ লাখ টন চালের উৎপাদন কম হলেও বেসরকারী আমদানিকারকেরা ২০১৭-১৮ সময়ে প্রায় ৪০ লাখ টন চাল আমদানি করেন। এতে ধান ও চালের দাম অনেক কমে যায়। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সেই দাম সরকার নির্ধারিত সংগ্রহমূল্যের চেয়ে কম ছিল। এই পরিস্থিতিতে সরকার এ বছর কৃষককে ন্যায্যমূল্য দিতে প্রায় ১৯ লাখ টন ধান চাল সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু মার্চ থেকে করোনা সংক্রমণ শুরু হয়ে গেলে চালের দাম বেড়ে যায়। নওগাঁয় মজুদদারদের বিরুদ্ধে অভিযান ॥ নওগাঁ থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, নওগাঁয় বাজার নিয়ন্ত্রণে ধান-চালের অবৈধ মজুদদারদের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে জেলা প্রশাসন। গত এ দিনে অভিযান চালিয়ে অবৈধ মজুদের দায়ে ১৯ ব্যবসায়ীকে সাড়ে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। জেলা প্রশাসন ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৩ দিনে অভিযান চালিয়ে ১৬ চালকল মালিক ও তিনজন ধানের আড়তদারকে ধান ও চালের অবৈধ মজুদের দায়ে ৫ লাখ ৫২ হাজার টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এসব চালকল মালিক ও ধানের আড়তদারদের দ-প্রাপ্তির দিন থেকে সাত দিনের মধ্যে তাদে মজুদকৃত ধান ও চাল বাজারে বিক্রির নির্দেশ দেয়া হয়। এর আগে ২৯ সেপ্টেম্বর নওগাঁর মহাদেবপুরে পাক্ষিক ছাঁটাই ক্ষমতার অতিরিক্ত ধান ও চাল মজুদের দায়ে ২ লাখ টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এদিকে অবৈধ মজুদদারদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের হঠাৎ এই অভিযানে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন মিলমালিক ও আড়তদাররা। ধান-চালের অবৈধ মজুদবিরোধী চলমান অভিযান সম্পর্কে নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, ‘খাদ্যপণ্য মজুদের আইন সম্পর্কে অনেক ব্যবসায়ীই সচেতন নয়। সাধারণত মিলমালিকরা ভরা মৌসুমে বেশি করে ধান কিনে থাকেন। সেগুলো গুদামে রেখে পরে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ধীরে ধীরে চাল উৎপাদন করে বাজারে বিক্রি করেন। কিন্তু মিলের পাক্ষিক ছাঁটাই ক্ষমতার পাঁচগুণের বেশি ধান-চাল মজুদ রাখা বেআইনী এটা অনেকই জানেন না। অনেকেই অজান্তে আইন অমান্য করে থাকেন। এ অবস্থায় হঠাৎ করে অবৈধ মজুদবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ায় প্রায় সব ব্যবসায়ীরাই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন। অভিযানের ভয়ে তাঁরা আতঙ্কে রয়েছেন। কারণ কোন ব্যবসায়ী চাইলেই তাঁর গুদামের সব পণ্য দুই বা তিন দিনের মধ্যে বিক্রি করতে পারবেন না। অভিযান শুরুর আগে গুদামে থাকা অতিরিক্ত ধান ও চাল বিক্রির জন্য কিছু দিন সময় দেয়া উচিত ছিল।’ এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘খাদ্যপণ্যের বাজার পরিস্থিতি নিয়মিত মনিটরিংয়ের অংশ হিসেবে সম্প্রতি কয়েকটি চালকল ও ধানের আড়তে অভিযানে গিয়ে অবৈধ মজুদের দায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে ব্যবসায়ীদের জরিমানা করা হয়েছে। লাইসেন্স সক্ষমতার বাইরে কোন মিল কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত খাদ্যপণ্য মজুদ রাখা খাদ্যপণ্যের উৎপাদন, আহরণ, সরবরাহ ও সংরক্ষণ আইনের পরিপন্থী এবং দ-নীয় অপরাধ। বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ের অংশ হিসেবে এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে। অতি সম্প্রতি ঢাকায় চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার এমপি বাজারে কারসাজির জন্য ব্যবসায়ীদের দায়ী করে বক্তব্য দেন। মন্ত্রী আক্ষেপ করে বলেন, দুদিন গোপন সার্ভে করে তাঁর নির্বাচনী এলাকায় নওগাঁতে ৫০টি মিলের খোঁজ পেয়েছেন। এসব মিলে নি¤েœ ২০০ টন, সর্বোচ্চ ৩ হাজার টন ধানের মজুদ রয়েছে। এমনকি বন্ধ মিলেও ধান কিনে মজুদ করে রাখার তথ্যও পাওয়া গেছে। এভাবে সারাদেশে সার্ভে করলে এ ধরনের শত শত অবৈধ মজুদদারের তথ্য পাওয়া যাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এদিকে আবাদ উদ্বৃত্ত উত্তরের নওগাঁ জেলার বাজারগুলোতে দিন দিন বাড়ছে চালের দাম। দেশের অন্যতম প্রধান চালের মোকাম নওগাঁয় পাইকারিতে সরু মিনিকেট চাল সরকারের বেঁধে দেয়া দামে বিক্রি হয়েছে। তবে মাঝারি মানের কাটারি ও বিআর-২৮ চাল প্রতি বস্তায় ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হয়েছে নওগাঁর মোকামে। শুক্রবার নওগাঁ শহরের বাঙ্গাবাড়িয়া ও পার নওগাঁ এলাকার কয়েকটি চালকলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরু মিনিকেট চাল সরকারের বেঁধে দেয়া দাম অনুযায়ী প্রতি বস্তা ২ হাজার ৫৭৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মাঝারি মানের কাটারি ও বিআর-২৮ বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৩০০ থেকে ২ হাজার ৩৫০ টাকায়। সরকারের বেঁধে দেয়া দাম অনুযায়ী মাঝারি মানের চাল প্রতি কেজি ৪৫ টাকা কেজি দরে প্রতি বস্তা ২ হাজার ২৫০ টাকায় বিক্রি করার কথা। শুক্রবার নওগাঁ শহরের বিশিষ্ট চাল ব্যবসায়ী (খুচরা) শ্যামল কুমার বিশ^াসসহ স্থানীয় কয়েক চাল ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চালের পাইকারি মূল্য নির্ধারণের আগেও নওগাঁতে সরু মিনিকেট চাল ২ হাজার ৫৫০ থেকে ২ হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তবে মাঝারি মানের কাটারি ও বিআর-২৮ চাল প্রতি বস্তা ২ হাজার ৩০০ থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এদিন বাজরে জিরাশাইল চাল বিক্রি হয়েছে ৫২ টাকা কেজি। যা এক সপ্তাহ আগেও বিক্রি হয়েছে ৪৫ টাকা কেজি। সরু মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫২ টাকা কেজি। এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ৪৭ থেকে ৪৮ টাকা কেজি। কাটারি এখন ৫০ টাকা কেজি এবং আগে ছিল ৪৫ টাকা কেজি। বিআর-২৮ বিক্রি হচ্ছে ৪৩ টাকা কেজি। গত সপ্তাহে ছিল ৩৬ টাকা কেজি। তবে বিআর-২৮ জাতের মোটা চাল বাজারে খুব একটা মিলছে না। নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, ‘চালের পাইকারি মূল্য নির্ধারণের ফলে নওগাঁর ব্যবসায়ীদের খুব একটা লাভ-ক্ষতি হবে না। কারণ সরকারের বেঁধে দেয়া দামেই সম্প্রতি নওগাঁতে পাইকারিতে চাল বিক্রি হয়েছে। সরকার নির্ধারিত পাইকারি মূল্য মেনেই লাভ করা সম্ভব বলে আমি মনে করি। নওগাঁ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোঃ ফারুক হোসেন পাটওয়ারী জনকণ্ঠকে বলেন, বোরো মৌসুমে জেলায় ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৩২ হাজার ৩৪০ টন। সংগ্রহের শেষ তারিখ ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংগ্রহ হয়েছে ৪ হাজার ৬১ টন। সিদ্ধ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৯ হাজার ২৬০ টন। সেখানে সংগ্রহ হয়েছে ৩৩ হাজার ৮০৭ টন। আতপ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ হাজার ৫১ টন। সেখানে সংগ্রহ হয়েছে ২ হাজার ৬১১ টন। চালের বাজার মূল্য বেশি হওয়ায় সরকারী সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। ঠাকুরগাঁওয়ের গুদামে একমুঠো চালও দেননি ৮৫৭ মিলমালিক ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা, ঠাকুরগাঁও থেকে জানান, চুক্তি অনুযায়ী জেলার ৯৯৩ জন চালকল মালিক সরকারী গুদামে চাল সরবরাহ করেননি। এদের মধ্যে আংশিক সরবরাহ করেছে ১৩৬ জন। অবশিষ্ট ৮৫৭ জন গুদামগুলোতে কোন চালই সরবরাহ করেননি। মিলমালিকদের চাল দেয়ার সময় বাড়িয়ে দিয়েও বোরো ধান ও চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি ঠাকুরগাঁও খাদ্য বিভাগ। চালের বাজার মূল্য বেশি হওয়ায় চেপে গেছেন মিলমালিকরা। এদিকে সাধারণ জনগণের অভিযোগ, মিলমালিকদের কারসাজিতেই বাজারে বেড়েছে চালের মূল্য। চালকল মালিকরা বলছেন, সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বাজারে চালের দাম বেশি হওয়ায় তারা গুদামে চাল সরবরাহ করতে পারেননি। এদিকে খাদ্য বিভাগ জানিয়েছে, যারা চুক্তি অনুযায়ী চাল সরবরাহ করেননি তাদের বিরুদ্ধে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। ঠাকুরগাঁও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এবার বোরো মৌসুমে ২৬ টাকা দরে জেলায় ১১ হাজার ৩০৯ টন ধান ও ৩৬ টাকা দরে ৩২ হাজার ৮৬৭ টন সেদ্ধ চাল সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। গুদামে ২৬ এপ্রিল ধান ও ৭ মে চাল সংগ্রহ শুরু হয়। চাল সংগ্রহের আগে গত মে মাসে চাল সরবরাহের জন্য চালকলের এক হাজার ৬৫৯ জন মালিকের সঙ্গে চুক্তি করে খাদ্য বিভাগ। চলতি মৌসুমে খাদ্য বিভাগের ধান-চাল সংগ্রহের শেষ দিন ছিল গত ৩১ আগস্ট। সেইদিন পর্যন্ত জেলার ১৩টি সরকারী খাদ্যগুদামে ধান সংগ্রহ হয় দুই হাজার ৮৩ টন, যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১৮.৪১ শতাংশ। আর চালকল মালিকেরা সরবরাহ করেন ১৫ হাজার ৩৪৫ টন চাল, যা লক্ষ্যমাত্রার ৪৬.৬৮ শতাংশ। প্রয়োজনীয় ধান-চাল সংগ্রহ না হওয়ায় ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারী গুদামে ধান-চাল সংগ্রহের মেয়াদ বাড়ানো হয়। এ সময়ের মধ্যে দুই হাজার ১৩২.৮০০ টন ধান ও ১৭ হাজার ২২২.৭১ টন চাল সংগ্রহ হয়, যা ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার ১৮.৮৫ শতাংশ। আর চাল লক্ষ্যমাত্রার ৫২.৭২ শতাংশ। জেলার এক হাজার ৬৫৯টি চুক্তিবদ্ধ চালকলের মধ্যে ৬৬৬টির মালিক চুক্তি অনুযায়ী গুদামে চাল সরবরাহ করেছেন। চুক্তি অনুযায়ী চাল দেননি চালকলের ৯৯৩ জন মালিক। এদের মধ্যে আংশিক চাল সরবরাহ করেছেন চালকলের ১৩৬ জন মালিক এবং কোন চাল দেননি ৮৫৭ জন। চাল সংগ্রহ নিয়ন্ত্রণ আদেশ ২০০৮’-এ বলা হয়েছে, ‘এই আদেশের অধীন লাইসেন্সপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি তাহাকে প্রদত্ত লাইসেন্সের শর্ত বা এই আদেশের কোন বিধান লঙ্ঘন করিলে সরকার উক্ত ব্যক্তির লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল করিতে পারিবে। চুক্তিবদ্ধ কয়েক চালকল মালিক বলেন, এবার মৌসুমের শুরুতেই বাজারে ধানের দাম চড়া ছিল। এ অবস্থায় চালকল মালিকেরা ধান সংগ্রহ করতে পারেননি। পরে বাজারে ধানের দাম আরও বাড়তে থাকে। পরে এর প্রভাব চালের বাজারে পড়ে। ধান ও চালের বাজারদর কমলে, গুদামে চাল সরবরাহ করবে, এমন আশায় থাকা অনেক ব্যবসায়ী গুদামে আর চাল দিতে পারেননি। বর্তমানে বাজারে মোটা জাতের হাইব্রিড ধান প্রতিকেজি ২২ থেকে ২৪ টাকা, তাও আবার চাহিদামতো পাওয়া যাচ্ছে না। এ দামে মোটা জাতের ধান কিনে প্রতি কেজি চাল উৎপাদনে ৪০ টাকার ওপর খরচ হচ্ছে। জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হাসান বলেন, এবার বোরো মৌসুমের শুরু থেকেই ধানের বাজার উর্ধগতি হওয়ায় আশানুরূপ ধান কিনতে পারেননি চালকল মালিকেরা। পাশাপাশি অস্বাভাবিক বৃষ্টিও চাল উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। এতে অনেক চালকল মালিক চুক্তি করেও গুদামে চাল সরবরাহ করতে পারেননি। প্রতিকূল আবহাওয়া ও করোনা পরিস্থিতি বিবেচনা করে সরকার তাঁদের প্রতি নমনীয় হবে বলে তিনি আশা করেন। এদিকে স্থানীয় খুচরা কয়েক ক্রেতা অভিযোগ করে বলেন, মিলমালিকরা যদি গুদামে চাল নিয়ে দিয়ে থাকেন তবে এই ধান-চালগুলো গেল কই! এখন চালের বাজারে আগুন। হয়তো মিলমালিকদের কারসাজিতেই এমনটি ঘটেছে। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মনিরুল ইসলাম বলেন, ধান-চাল সংগ্রহের সময়সীমা ১৫ সেপ্টেম্বর শেষ হয়েছে। কিন্তু চালকল মালিকদের চাল সরবরাহে তাগাদা দিয়েও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হয়নি। জেলার যেসব মালিক চাল সরবরাহ করেননি, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×