ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কুষ্টিয়ায় ২০ কোটি টাকার জমি জালিয়াতি করে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ

প্রকাশিত: ২২:১৮, ৩ অক্টোবর ২০২০

কুষ্টিয়ায় ২০ কোটি টাকার জমি জালিয়াতি করে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ

নিজস্ব সংবাদদাতা, কুষ্টিয়া ॥ কুষ্টিয়ায় শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী নাট্য সংগঠন ‘পরিমল থিয়েটার’ এর অন্তত ২০ কোটি টাকা মূল্যের নিজস্ব মালিকানা সম্পত্তি জালিয়াতি করে রেজিস্ট্রি করে দিয়েছে প্রভাবশালী একটি চক্র। নির্বাহী পরিষদকে পাশ কাটিয়ে ভুয়া রেজুলেশন তৈরি করে মোট জমির মধ্যে প্রায় ১০ শতক জমি থিয়েটারের সভাপতির ভাতিজা এবং নিজের স্ত্রীর নামে রেজিস্ট্রি করে দেয় জালিয়াত চক্রের হোতা পরিমল থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের। শহরের প্রাণকেন্দ্র ও বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত পরিমল থিয়েটার ভেঙ্গে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন। অভিযোগ রয়েছে, অস্ত্র ঠেকিয়ে নির্বাচিত কমিটিকে হঁটিয়ে রাতের আঁধারে পরিমল থিয়েটারের দখল নেয় কমিটির দুই নেতা। পরে তারা জালিয়াতি করে ওই জমিতে ১০তলা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করে। এ ভবন নির্মাণেও চলছে হরিলুট। নির্মাণ ব্যয় থেকে শুরু করে দোকানঘর বিক্রিতে আত্মসাত করা হয়েছে কোটি কোটি টাকা। এদিকে দেশের ঐতিহ্যবাহী নাট্য থিয়েটারের এমন দশায় ক্ষুব্ধ জেলার সংস্কৃতি কর্মীরা। তারা প্রভাবশালীদের দখলমুক্ত করে পরিমল থিয়েটারের সংস্কৃতি ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, ১৯১২ সালে জেলার কিছু সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কুষ্টিয়ার শিল্প-সাহিত্য বাঁচিয়ে রাখতে পরিমল থিয়েটার স্থাপনের উদ্যোগ নেন। পরে শহরের প্রাণকেন্দ্র এনএস রোডের পাশে ১৯ শতক ৩৭ পয়েন্ট জায়গার ওপর গড়ে তোলা হয় বিশাল থিয়েটার ভবন। সেখানে নিয়মিত চলত সাংস্কৃতিক চর্চা। পরিমল থিয়েটার থেকেই অভিনেতা রাজু আহমেদ, আহমেদ শরীফ, মিজু আহমেদ, কায়েস ও সুজাতা এবং গায়ক আব্দুল জব্বার, খালেদ হোসেন, ফরিদা পারভীন, সোহরাব হোসেন, আনোয়ার উদ্দিন ও নার্গীস পারভীন ছাড়াও অসংখ্য অভিনেতা-অভিনেত্রী, গায়ক-গায়িকা, কবি-সাহিত্যিক উঠে এসেছেন বলে জানান এর প্রবীণ সদস্যরা। একাধিক সূত্র জানায়, নির্বাচিত কমিটি শত বছর ধরে থিয়েটারটি পরিচালনা করে আসছিল। ২০১২ সাল পর্যন্ত নির্বাচিত কমিটির সভাপতি ছিলেন কুষ্টিয়া সদর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ স ম আখতারুজ্জামান মাসুম ও সাধারণ সম্পাদক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মতিউর রহমান মতি। কিন্তু রাতের আঁধারে অস্ত্রের মুখে নির্বাচিত ওই কমিটিকে হঁটিয়ে পরিমল থিয়েটার দখলে নেয় ওই সময়ে শহরের ত্রাস ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন সবুজ। তিনি নিজেই বনে যান থিয়েটারের উপদেষ্টা। তারই দোসর আবু তাহেরকে সাধারণ সম্পাদক করে রাতারাতি ২১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করা হয়। সে সময় এই সন্ত্রাসীদের ওপরই ছিল পুরো শহরের নিয়ন্ত্রণ। প্রশাসন থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদেরও আস্থাভাজন ছিলেন তারা। যার ফলে ভয়ে থিয়েটারের তিন শতাধিক সদস্যের কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়নি। সাবেক সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান মতি বলেন, জমি আত্মসাত করতে নির্বাচিত কমিটিকে হঁটিয়ে রাতারাতি দেশের ঐতিহ্যবাহী নাট্য সংগঠনটির দখল নেয় প্রভাবশালীরা। জালিয়াতি করে থিয়েটারের শত বছরের পুরাতন নিজস্ব সম্পত্তি বিক্রি করেই ওরা ক্ষান্ত হয়নি। আট বছরে বহুতল ভবন নির্মাণের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সাবেক যুগ্ম সম্পাদক খাদেমুল ইসলাম বলেন, সন্ত্রাসীদের থাবায় দেশের ঐতিহ্যবাহী নাট্য সংগঠনটি হারিয়ে গেছে। থিয়েটারটি এখন বহুতল ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। জেলা রেজিস্ট্রি অফিস সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই দুটি দলিলের মাধ্যমে পরিমল থিয়েটারের মোট ১৯ শতক ৩৭ পয়েন্ট জমির মধ্যে প্রায় ১০ শতক জমি দু’জনের নামে রেজিস্ট্রি করে দেয় সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের। যার দলিল নং ৬৯৫৩/১৪ এবং ৬৯৫৪/১৪। এর মধ্যে প্রথম দলিলে সভাপতি সানোয়ার উদ্দিন রিন্টুর ভাতিজা পরিমল থিয়েটারের উপদেষ্টা ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন সবুজের নামে ৮ শতক ৭১ পয়েন্ট এবং দ্বিতীয় দলিলে নিজের (আবু তাহের) স্ত্রী মোছাঃ আয়েশা খাতুনের নামে ৯৭ পয়েন্ট জমি রেজিস্ট্রি করে দেয় সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের। দলিলে শনাক্তকারী ছিলেন থিয়েটারের সভাপতি সানোয়ার উদ্দিন রিন্টু। দলিলের ৬নং পৃষ্ঠায় বলা হয়, পরিমল থিয়েটারের ২০১৪ সালের ১১ জুলাই বার্ষিক সাধারণ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে থিয়েটারের জমি বিক্রির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। সেই রেজুলেশনের কপিও দলিলের সঙ্গে জমা দেয়া হয়। তবে এ ব্যাপারে পরিমল থিয়েটারের সভাপতি সানোয়ার উদ্দিন রিন্টু বলেন, জমি রেজিস্ট্রির সময় আমি গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলাম। হাসপাতালের বেডে শোয়া অবস্থায় সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের ও উপদেষ্টা সাজ্জাদ হোসেন সবুজ দুটি দলিল নিয়ে গিয়ে আমাকে স্বাক্ষর করতে বলে। আমি স্বাক্ষর দিতে অসম্মতি জানালে অনেকটা জোরপূর্বক আমার কাছ থেকে স্বাক্ষর নেয়া হয়। তিনি আরও বলেন, পরিমল থিয়েটারের কোন বার্ষিক সাধারণ সভায় জমি বিক্রির কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। দলিল রেজিস্ট্রির সময় যে রেজুলেশন জমা দেয়া হয়েছে সেটি ভুয়া রেজুলেশন। আমার স্বাক্ষর জাল করে রেজুলেশন জমা দেয়া হয়েছে। সভাপতি বলেন, সাধারণ সদস্য দূরের কথা আমি সভাপতি নিজেই একটি ইটের হিসাবও জানি না। সবই করেছে সাধারণ সম্পাদক ও উপদেষ্টা দুজন মিলে। এখানে কারো কোন কথা বলার সুযোগ ছিল না। শহরের নিয়ন্ত্রক হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়নি। এদিকে প্রভাবশালীদের দখল থেকে দেশের ঐতিহ্যবাহী থিয়েটারকে সংস্কৃতি ব্যক্তিদের মাঝে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি তুলেছে সাংস্কৃতিক কর্মীরা।
×