ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

চলতি বছরে ১৩টি আলোচিত ঘটনা প্রতিদিন গড়ে সারাদেশে চার থেকে পাঁচটি প্রকৃত ঘটনা ঘটে বছরে গড়ে নারী ও শিশু নির্যাতন এবং ধর্ষণ সংক্রান্ত ষোলো হাজার থেকে সাড়ে ষোলো হাজার মামলা হয় এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার তাগিদ

থামছেই না ধর্ষণ ॥ সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে

প্রকাশিত: ২২:৪১, ২ অক্টোবর ২০২০

থামছেই না ধর্ষণ ॥ সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ দিন দিন সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিচ্ছে। কোন কিছুতেই এই ব্যাধি সারানো যাচ্ছে না। শুধু ধর্ষণের মধ্যেই এই অপরাধ সীমাবদ্ধ নেই। ধর্ষণের মতো অপরাধ আড়াল করতে ধর্ষিতাকে বেশিরভাগ সময়ই নির্মমভাবে হত্যার ঘটনা ঘটছে। চলতি বছর খোদ রাজধানীতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণ থেকে শুরু করে সারাদেশে মোট তেরোটি আলোচিত ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষক মজনুর বিচার চলছে। এছাড়া রাজধানীতেই অসুস্থ স্বামীকে রক্ত দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে স্ত্রীকে ধর্ষণ, সিলেটের এমসি (মুরারী চাঁদ) কলেজের সামনে স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীকে তুলে নিয়ে ছাত্রাবাসে গণধর্ষণ ও রাজশাহীর তানোরে গীর্জায় তিনদিন আটকে রেখে এক কিশোরীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর বাইরে রামপুরায় দুই বোনকে বাবুর্চির ধর্ষণ, ঈদে নতুন জামা কাপড় দেয়ার কথা বলে তুরাগের কামারপাড়ায় শিশু ধর্ষণ, খিলক্ষেতে বেড়াতে আসা এক নারীকে ধর্ষণ, বিমানবন্দরের কাওলায় এক তরুণীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ, ঢাকার দোহার উপজেলায় হত্যার ভয় দেখিয়ে কিশোরীকে একাধিকবার ধর্ষণ, চিকিৎসার কথা বলে গাজীপুরের শ্রীপুরে এক রোগীকে বাংলোতে নিয়ে ধর্ষণ এবং সর্বশেষ মিরপুরে গৃহকর্মী ধর্ষণের দায়ে ছাত্রলীগ নেতা সবুজকে পাঁচদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ঘটনা এখন টক অব দি কান্ট্রি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতিদিন দেশে গড়ে চার থেকে পাঁচটি প্রকৃত ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। আর বছরে গড়ে নারী ও শিশু ধর্ষণ, নির্যাতনসহ অন্যান্য অপরাধে মামলা হয় ষোল থেকে সাড়ে ষোল হাজার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানা মাধ্যমে ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশও হচ্ছে। ধর্ষকরা গ্রেফতারও হচ্ছে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও হচ্ছে। তারপরেও কিছুতেই যেন থামানো যাচ্ছে না ধর্ষণের মতো অপরাধ। ভাইরাসের মতো সমাজের সকল স্তরে এই ব্যাধি বাসা বাঁধছে। পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ ধর্ষণ বা নির্যাতনের ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তে গাফিলতি করলে তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের চাকরিচ্যুত করার আগাম ঘোষণাও দিয়েছেন। পাশাপাশি ভিকটিমের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলেছেন। একইসঙ্গে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে মিথ্যা মামলা দায়েরকারীকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছেন। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একমাত্র সচেতনতাই পারে এ ধরনের অপরাধ কমিয়ে আনতে। সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব না হলে এ ধরনের অপরাধ সমাজ থেকে দূর করা কঠিন হবে। ধর্ষণ ও ধর্ষণজনিত খুনের মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এতে ভয়ে হলেও সমাজ থেকে এ ধরনের অপরাধ কমে আসবে। এ ধরনের অপরাধের শিকার হওয়া ব্যক্তি বা তার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। দোষীদের নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। এতে করে কেউ এ ধরনের অপরাধের শিকার হলে মুখ খুলবে। আইনের আশ্রয় নেবে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর প্রায় সকল ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। রিমান্ড শেষে প্রায় সবাই আদালতে অভিযোগ স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, প্র্রতিদিন সারাদেশে নারী, শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণ সংক্রান্ত গড়ে শতাধিক মামলা হয়। যার মধ্যে অধিকাংশ মামলাই ভুয়া। মূলত প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্যই এসব মামলা দায়ের করা হয়। তদন্তে শেষ পর্যন্ত অধিকাংশ মামলারই সত্যতা মেলে না। তবে প্রতিদিন সারাদেশে গড়ে চার থেকে পাঁচ নারী বা শিশু ধর্ষণের প্রকৃত ঘটনা ঘটে। কোন কোনটি মিডিয়ার কল্যাণে সামনে আসে। আবার কোন কোনটি সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে ভিকটিম বা তার পরিবার সামনে আনতে ভয় পায়। প্রভাবশালীদের চাপের কারণেও অনেকেই মামলা দায়ের করেন না। এমনকি নূন্যতম অভিযোগও করেন না। আবার উভয়পক্ষ নিজেদের মধ্যে বসে দেনবার করে মিটিয়ে ফেলে। অনেক ক্ষেত্রে বিয়ের মাধ্যমে এমন সমস্যার সমাধান হওয়ার ভূরি ভূরি নজির আছে। আর বছরে সারাদেশে নারী, শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণের অভিযোগে গড়ে ১৬ হাজার থেকে সাড়ে ১৬ হাজার মামলা হয়। এসব বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান খ্যাতিমান অপরাধ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, শিশু, কিশোর, কিশোরী, তরুণীসহ নানা বয়সী মানুষের যৌন নিপীড়ন বা ধর্ষণের পর নির্মমভাবে হত্যাকা-ের বিষয়টি প্রায়ই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটি একটি মানসিক বিষয়। অনেক অপরাধ পরিবেশ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ঘটে বা করে থাকে। কিন্তু ধর্ষণ, নারীদের উত্ত্যক্ত করার মতো অপরাধ পুরোটাই মানসিক বিষয়। সচেতনতা বাড়ানো ছাড়া সমাজে এ ধরনের অপরাধ কমিয়ে আনা কঠিন কাজ। মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। নিজের পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের সচেতন ও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। ধর্ষণ করা বা ধর্ষণের পর তার ভিডিও ধারণ করে তার সুযোগ নিয়ে বার বার সুবিধা নেয়ার বিষয়টিও নিছক এক ধরনের বিকৃত মানসিকতা। তিনি আরও বলেন, ধর্ষণের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে প্রয়োজনে পাড়া-মহল্লায় সভা সমাবেশ করে মানুষকে বুঝানো প্রয়োজন। আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও পাঠদানের মাধ্যমে এসব বিষয় সম্পর্কে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সমাজের মানুষদের সচেতনতা বাড়ানো দরকার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের রীতিমতো এসব বিষয়ে সতর্কতামূলক শিক্ষা দেয়া এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি পিতা-মাতা ও পরিবারের সদস্যদের শিশু, নারী বা অন্য যারা পরিবারের সদস্য তাদের সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, তার সন্তানের ওপর আশপাশের কারও কোন কুনজর আছে কিনা তা খেয়াল রাখতে হবে। তাদের সন্তানকে কে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে। সন্তান কোন কোন জিনিস বা বিষয়ের প্রতি দুর্বল তা জানতে হবে। প্রয়োজনে পরিবারকে সন্তানের সেসব চাহিদা সাধ্য মোতাবেক পূরণ করতে হবে। সন্তানদের নানা বিষয়ে সতর্কতামূলক বিষয়াদি শেখাতে হবে। তাহলেই এ ধরনের অপরাধ কমিয়ে আনা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, সমাজ পরিবর্তিত হচ্ছে। আজ প্রযুক্তির কারণে অনেক খারাপ জিনিস হাতের নাগালে চলে এসেছে। যার কারণে বিশ্বের অন্য দেশের মতো পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থায় এ ধরনের অপরাধের ঘটনা ঘটছে। প্রযুক্তির কারণে মানুষ যেন নীতি, নৈতিকতা, ধর্মীয় অনুশাসন, সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা ভুলে না যায়, তা শেখাতে হবে। ছেলে-মেয়েরা যাতে পরিবারের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতে পারে, এমন পরিবেশ সৃষ্টি করে রাখা প্রয়োজন প্রতিটি পরিবারের। এতে করে ছেলে মেয়েদের বিপদগামী হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। যখন কোন সন্তান তার পরিবারের কাছে ব্যক্তিগত অভাব বা ব্যক্তিগত বিষয়াদির কথা প্রকাশ করতে না পারে, তখন স্বাভাবিক কারণেই সে বন্ধু বা বান্ধবী বা পরিচিতদের কাছে যায়। আর তখনই তার বিপদগামী বা ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ধর্ষণের মতো অপরাধগুলো সংঘটিত হয় এভাবেই। সম্প্রতি আদালত এ ধরনের ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকা উচিত। তাহলে ভবিষ্যতে ধর্ষণ বা নিপীড়নের মতো অপরাধ দিন দিন কমে যাবে। পুলিশ বা অন্য আইনশৃঙ্খলাবাহিনী এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিশেষ করে তারা যখন বিভিন্ন সভা সমাবেশে যান, তারা এসব বিষয়ে বক্তব্য দিয়ে এবং পাশাপাশি আইনে কঠোর শাস্তির কথা জানালে এ ধরনের অপরাধ কমে আসার ক্ষেত্রে আরও সুফল পাওয়া যাবে। মামলা দায়েরকারী বা ভিকটিমের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং দোষীদের নিয়মিত মনিটরিং করা জরুরী। এটি ধর্ষণের মতো অপরাধ সমাজ থেকে কমিয়ে আনতে কিছুটা হলেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, প্রায়ই ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনা যখন ঘটছে, তখন খুবই তোলপাড় হচ্ছে। মামলার আসামিরা গ্রেফতারও হচ্ছে। অথচ আসামিরা অনেক সময়ই প্রভাব খাটিয়ে উপযুক্ত প্রমাণাদির অভাবে জামিনও পেয়ে যাচ্ছে। তাদের বিষয়ে আর মনিটরিং করা হয় না বা আসামিদের যাদের মনিটরিং করার কথা, তারা সে কাজটি ঠিকমতো পালন করেন না। পুলিশ প্রধান ড. বেনজীর আহমেদ এ ধরনের অপরাধের তদন্তের ক্ষেত্রে কারও গাফিলতি প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা ছাড়াও তাকে প্রয়োজনে চাকরিচ্যুত করার ঘোষণা দিয়েছেন। পাশাপাশি ভিকটিমের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। একইসঙ্গে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে মিথ্যা মামলা দায়েরকারীকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেছেন।
×