ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ঢেউ ভাঙ্গা জীবন, নিয়তিবাদী চলা

প্রকাশিত: ২৩:০৬, ১ অক্টোবর ২০২০

ঢেউ ভাঙ্গা জীবন, নিয়তিবাদী চলা

মোরসালিন মিজান ॥ গোটা দুনিয়ায় এক স্রোত বইছে। আছড়ে পড়ছে অভিন্ন ঢেউ। তাই বলে জীবন স্থির বা স্থবির হয়ে নেই। বিরুদ্ধ সময়ের সঙ্গে লড়ে চলেছে। একদিকে ঢেউ ভাঙ্গা জীবন। অন্যদিকে নিয়তিবাদ। দুটোকে সঙ্গী করে নিউ নর্মাল বাঙালী। হ্যাঁ, কোভিডের ধাক্কায় এমন বদলে যাওয়া। তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিব রে...। করোনা যেন সেই ঢেউয়ের সাগর। প্রথম ঢেউয়ে কত মানুষ যে ভেসে গেছে! পৃথিবীজুড়ে সংক্রমণ। মৃত্যু। আর তার পর মনে করা হচ্ছিল, সঙ্কট থেকে মুক্তির সময় এসেছে। কিন্তু না। বরং পৃথিবীব্যাপী শুরু হয়েছে নতুন আলোচনা। আলোচনার নাম দ্বিতীয় ঢেউ। অর্থাৎ যেসব দেশ প্রাথমিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পেরেছে, তারা অতিমারীর কবলে পড়তে পারে আবারও। সত্যিই কি বাড়বে? নাকি জুজুর ভয়? সতর্ক অবস্থানে থেকে উত্তর খোঁজা হচ্ছে। বাংলাদেশ অন্য অনেক দেশের তুলনায় ভাল অবস্থায় আছে। ঘনবসতিপূর্ণ দেশে সংক্রমণ অনেক হলেও, মৃত্যু কম। সব দেখে বলা হচ্ছে, প্রথম ঢেউটা বাঙালী মোটামুটি সামলে নিয়েছে। জীবনযাত্রা প্রায় স্বাভাবিক এখন। করোনার প্রথম ঢেউ এসে আছড়ে পড়েছিল চলতি বছরের মার্চে। ৮ মার্চ প্রথমবারের মতো নোভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এর পর আর বেশি দেরি করা হয়নি। ২৫ মার্চ থেকে বন্ধ করে দেয়া হয় সবকিছু। টানা ৬৬ দিন ধরে চলে সাধারণ ছুটি। তার পর সংক্রমণ ও মৃত্যু না থামলেও, জীবন জীবিকার প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হয়ে আসতে থাকে মানুষ। বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকি সবই চালু আছে। স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করেছে দেশ। এই ফেরার সময়টিকে প্রথম ঢেউ মোকাবেলা করে ফেরা বলেই ধরে নেয়া হচ্ছে। বহু মানুষকে হারাতে হয়েছে। ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে ঘটে গেছে বড় অনেক পরিবর্তন। তদুপরি মৃত্যু সংখ্যা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকায় আছে স্বস্তিও। ক্ষীণ আশা ছিল, এভাবে চললে সহসাই কোভিড কালকে পেছনে ফেলা যাবে। কিন্তু বেশকিছু কারণে আশা ধরে রাখা মুুশকিল হয়ে যাচ্ছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় বাধাটি হয়ে আসছে শীত। শীতের কাল সেকেন্ড ওয়েবের ভয়ঙ্কর উৎস হয়ে উঠতে পারে। কারণ ঠা-া ও শীতল পরিবেশ কোভিড-১৯ ভাইরাসকে অধিক সময় সক্রিয় থাকতে সহায়তা করে। এখন চলছে মধ্য আশ্বিন। শেষ হতেই শিশির ভেজা হেমন্ত। হেমন্তে ঠা-া অনুভূত হবে। তার পরই শীত। সে বিবেচনায় দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর তেমন বাকি নেই। খ্যাতিমান চিকিৎসক এবিএম আব্দুল্লাহ বলছেন, শীতে এমনিতেই রোগ ব্যাধি বেড়ে যায়। সর্দি কাশি জ্বর ইত্যাদি হয়। যে কারণে এসব হয়, একই কারণে বাড়তে পারে করোনার প্রাদুর্ভাব। বাইরের যে দেশগুলোতে করোনা মহামারীর চূড়ান্ত রূপ দেখা গেছে, সেগুলোতে তখন শীত ছিল বলেও সতর্ক করে দেন তিনি। এদিকে, বিসিএসআইআর জিনোমিক রিসার্চ ল্যাবরেটরির এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস দ্রুত রূপ পরিবর্তন করছে। বিশ্বে রূপান্তরের হার প্রায় সাত শতাংশ হলেও বাংলাদেশে এ হার প্রায় ১৩ শতাংশ। এখন পর্যন্ত ৫ ধরনের করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের আর কোথাও নাকি এত পাওয়া যায়নি। তার মানে, এ অবস্থাটিও সেকেন্ড ওয়েবের অনুকূলে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে বাড়তি প্রস্তুতি নিয়ে রাখছে সরকারও। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসনিা সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। বলেছেন, যদিও এটা অনিশ্চিত একটা ব্যাপার, তারপরও আমাদের এ ব্যাপারে প্রস্তুতি নিতে হবে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও। বরং করোনার দ্বিতীয় পর্যায় মাথায় রেখে ইতোমধ্যে নতুন পরিকল্পনা সাজিয়েছেন তিনি। এ পরিকল্পনায় জানা যাচ্ছে, লকডাউন বা সাধারণ ছুটি নেই। জোর দেয়া হবে ভ্যাকসিন সংগ্রহে। করোনাভাইরাসে টিকা নিয়ে নয়টি কোম্পানির পরীক্ষা চূড়াান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এগুলোর চার থেকে পাঁচটি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাংলাদেশ সর্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছে। তার আগে পর্যন্ত সাধারণত যেসব ওষুধ ব্যবহার হচ্ছে, সেগুলোর পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে। পরীক্ষার সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে। একই চিন্তা থেকে এন্টিজেন টেস্টের নীতিগত সিদ্ধান্ত অনুমোদন করা হয়েছে। প্রথম ওয়েবের শেষ হয়েছে ইঙ্গিত দিয়ে মন্ত্রী এর আগে অনেক করোনা হাসপাতাল বন্ধ করেছিলেন এবং সেই তিনি এখন বলছেন, প্রয়োজন হলে ওই হাসপাতালগুলো আগের মতোই কোভিড রোগীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। এর বাইরে সংক্রমণ ও স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপর জোর দেয়া হবে। মন্ত্রী পূর্বাভাসÑ সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে কঠোর হতে পারে সরকার। জরিমানা ও শাস্তির ব্যবস্থাও রাখা হতে পারে এবার। সচেতন নাগরিকেরাও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পক্ষে। একেবারে প্রথম থেকেই এ অংশটি মাস্ক ব্যবহার করছে। ঘন ঘন সাবান পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নিচ্ছে তারা। যতটা সম্ভব সামাজিক দূরত্ব মানার চেষ্টা করছে। এভাবে জীবন এগিয়ে নেয়ার সংগ্রাম করছেন তারা। করোনাকে চ্যালেঞ্জ করেই কাজে নামছে প্রতিদিন। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, সাধারণ মানুষের বড় অংশটিই এখন নিয়তিবাদী। চলায় বলায় তাদের নিয়তিবাদী বলেই মনে হচ্ছে। এ অংশটি করোনা ঠেকাতে নিজেরা উদ্যোগী হতে একদম রাজি নন। তারা দৈব শক্তির ওপর সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়েছেন। এ কারণে অদ্ভুত সব কা- ঘটিয়ে চলেছেন তারা। কারও মাস্ক কানের লতিতে ঝুলছে। কারওটা পকেটে। কেউ কেউ এসব আর ব্যবহারই করছেন না। মানছেন না অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধিও। ঢাকার রাস্তায় এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলো। তাদের ছুঁতোর শেষ নেই। একেকজন একেক কথা বলছেন। তবে কথাগুলো দিন শেষে একই অর্থ প্রকাশ করে। এই যেমন ‘বাংলাদেশে করোনা হইবো না’, ‘করোনা বড়লোকগো অসুখ’, ‘গরিবের করোনা হয় না’, ‘করোনা কপালে থাকলে হইবোই’, ‘হইলে দেখা যাইবো’, ‘হইলে এতদিনে হইতো’, ‘করোনায় ধরলে আপনে আমি ফিরাইতে পরুম না।’ সব কথার সম্মিলিত অর্থ নিয়তিবাদ। নিয়তিবাদী চিন্তার ফল কী হবে তা এখই বলা যাবে না। তবে নিয়তিবাদীরা তাদের অবস্থানে দারুণ খুশি! অনেক বেশি কনফিডেন্ট। মুখে না বললেও, চোখে মুখে ডোন্ট কেয়ার ভাব। কেয়ার এবং ডোন্ট কেয়ারের এই কাল সত্যি অদ্ভুত। অন্যরকম।
×