ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

রুমেল খান

আয় বন্ধ, হতাশ রেফারি আকলিমা!

প্রকাশিত: ০০:০১, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০

আয় বন্ধ, হতাশ রেফারি আকলিমা!

ফুটবল ম্যাচ চলাকালীন সময়ে আইন প্রয়োগের একমাত্র ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি তিনিই। সহায়তাকারীদের কল এবং রায়গুলো পরামর্শ হিসেবে বিবেচনা করেন এবং প্রয়োজনে তা অগ্রাহ্যও করতে পারেন। হ্যাঁ, পাঠক এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন, আমি রেফারির কথাই বলছি। করোনা ভাইরাসের এই ক্রান্তিকালে মোটেও স্বস্তিতে নেই বাংলাদেশের ফুটবল এবং ফুটবলাররা। ভাল নেই ফুটবল রেফারিরাও। আজ বলব এক নারী ফুটবল রেফারির কথা, যিনি এক সময় এ্যাথলেট ছিলেন। পরে হ্যান্ডবল ও ফুটবল খেলেছেন। এখন তিনি রেফারি। কিন্তু আর্থিক অনটনে পড়া ভাগ্যাহত এক রেফারি। তার নাম আকলিমা খাতুন। জনকণ্ঠর সঙ্গে একান্ত আলাপনে আকলিমা বলেন, ‘করোনার কারণে দেশের ফুটবল পুরোপুরি বন্ধ। তাই আমাদের আয়ও বন্ধ। ফলে পুরোটাই লস। বসে আছি বাড়িতে বেকার অবস্থায়। অনেক কষ্টে সংসার চালাতে হচ্ছে। আগামী দিনগুলো যে কিভাবে চলবে, তা জানি না!’ আকলিমার বাড়ি যশোরের কাজীপাড়ায়। জন্ম ওখানেই। বাবা নেই, মা আছেন। বর্তমানে আকলিমারা তিন বোন, এক ভাই। আকলিমা চার ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয়। এছাড়া মোটর বাইক এ্যাক্সিডেন্টে এক ভাই মারা যায় ২০১৩ সালে (২৩ বছর বয়সে, নাম : ইমরান হোসেন অলি)। এর ছয় বছর পর (২০১৯ সালে) ৫৫ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান আকলিমার বাবা আব্দুল কুদ্দুস। তিনি যশোর ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় সিভিল প্রশাসনে কর্মচারী ছিলেন। মূলত তিনি মারা যাবার পর থেকেই আকলিমাদের পরিবারে নেমে আসে দুভার্গ্যরে কালো ছায়া। সেটা অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছিল আকলিমার রেফারিংয়ের আয় দিয়ে। কিন্তু করোনা এসে আবারও সবকিছু স্তব্ধ করে দিল! আকলিমার ছোট বোন শারমিন সুলতানা রিতা মাস্টার্স পরীক্ষার্থী। বড় বোন সানজিদা খাতুন বিবাহিতা। তিনি স্কুল শিক্ষিকা। ছোট ভাই জকলিলুর রহমান জলিল কিছুদিন আগে ঢাকার বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালে চাকরি পেয়েছেন ডাটা অপারেটর হিসেবে। তিনি এবং বড় বোন মাঝে মাঝে তাদের সাধ্যমতো সাহায্য করার চেষ্টা করেন আকলিমা ও তার পরিবারকে। মূলত তাদের অর্থ সাহায্যেই কোনমতে চলছে আকলিমাদের সংসার। তার ওপর আকলিমার গৃহিণী মা রেবেকা বেগম প্রায়ই অসুস্থ থাকেন। কিছুকাল আগে থাইরয়েডের অপারেশন হয়েছিল তার। বিএ পাস করা আকলিমাদের সৌভাগ্যই বলতে হবে, দাদির সূত্রে ছোটখাট একটি টিনশেড ঘর পেয়েছিলেন। ভাগ্যিস পেয়েছিলেন, নইলে আজ হয়ত পুরো পরিবারকেই ছিন্নমূল হতে হতো! আকলিমা সর্বশেষ রেফারিং করেছেন ২০১৯ সালে, যশোরে অনুষ্ঠিত আন্তঃউপজেলা ফুটবল প্রতিযোগিতায়। এর আগে তিনি ঢাকায় ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত বঙ্গমাতা অ-১৯ নারী আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট, জেএফএ (জাপান ফুটবল এ্যাসোসিয়েশন কাপ) কাপ ফুটবলে, ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে বঙ্গমাতা ও বঙ্গবন্ধু স্কুল ফুটবলে, যশোরে অনুষ্ঠিত জেলা ফুটবল লীগে, ইউনিয়ন কাপ ফুটবলে, প্রথম ও দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে এবং অনুর্ধ-১৭ ফুটবল টুর্নামেন্টে রেফারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রেফারিং করে কেমন পারিশ্রমিক পেতেন আকলিমা? ‘ঢাকায় ম্যাচ হলে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা এবং যশোরে হলে ম্যাচপ্রতি ৫০০ টাকা করে পেতাম। আমাদের তো আর মাসিক হিসেবে পারিশ্রমিক দেয়া হয় না, পারিশ্রমিক পেতাম খেলা পরিচালনা অনুযায়ী।’ নিজের রেফারিংকে আরও শাণিত করার লক্ষ্যে আকলিমা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) থেকে করেছেন রেফারিং কোর্স। এছাড়া ভবিষ্যতে কোচ হওয়ার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য করেছেন বেসিক কোচেস কোর্স। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে আকলিমা বলেন, ‘এই করোনাকালে বাফুফে থেকে এখনও কোন সাহায্য পাইনি। তবে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি) থেকে গত ৬ আগস্ট ২৪ হাজার টাকা অর্থ সাহায্য পেয়েছিলাম। এছাড়া যশোরের সাচ্চু ফুটবল কোচিং সেন্টার থেকে পেয়েছিলাম চাল ও ডাল। ওগুলো দিয়েই পুরো পরিবারটা চলছে আমাদের।’ ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি উচ্চতার অধিকারী আকলিমা এক সময় ছিলেন বেশ দক্ষ-কুশলী ফুটবলার। ছিলেন রক্ষণভাগের অতন্ত্রপ্রহরী। তার পজিশন ছিল স্টপার ব্যাক। এর আগে বাংলাদেশে যে দুবার মহিলা ফুটবল লীগ অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তার সবগুলোতেই অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ২০১১ সালের লীগ খেলেছিলেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে। আর ২০১৩ সালের লীগে অংশ নিয়েছিলেন আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের জার্সি গায়ে চাপিয়ে। এছাড়া ওই সময়ই অনুষ্ঠিত একমাত্র মহিলা কর্পোরেট লীগেও অংশ নিয়েছিলেন। ওই লীগে তার দল ছিল বাংলাদেশ জুট মিলস্ কর্পোরেশন (বিজেএমসি)। ওই সংস্থার হয়ে ২০১৩-২০১৫ সাল পর্যন্ত চাকরি করারও অভিজ্ঞতাও হয়েছিল আকলিমার। এছাড়া ২০০৯-২০১৩ সাল পর্যন্ত আকলিমা খেলেছেন যশোর জেলা মহিলা ফুটবল দলের হয়েও। এখানেই শেষ নয়। আকলিমাকে শুধু ফুটবলার হিসেবে ভাবলেই ভুল করবেন। তিনি দক্ষতার সঙ্গে খেলেছেন হ্যান্ডবলও। যশোর এবং ঢাকার লীগে সর্বসাকুল্যে মোট তিন বার লীগ খেলেছেন। স্কুল ও কলেজ জীবনে আকলিমা ছিলেন সফল এ্যাথলেটও। ১০০ ও ২০০ মিটার দৌড়ে, উচ্চ ও দীর্ঘ লাফে বরাবরই তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। প্রথম স্থান অধিকার করে জিতেছেন বহু পুরস্কার। রেফারিংয়ে আকলিমার আদর্শ হচ্ছেন জয়া চাকমা, যিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম মহিলা-ফিফা রেফারি। আগামী ১ অক্টোবর ৩৪ বছর পূর্ণ করতে যাওয়া আকলিমার এখনও বিয়ের পিঁড়িতে বসা হয়নি। কারণটা কী? জনকণ্ঠকে আকলিমা জানান, ‘খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় এবং সংসারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই আসলে এখনও বিয়েটা করা হয়ে ওঠেনি।’ এখন দেখার বিষয়, আগামীতে করোনা-সঙ্কট কাটিয়ে আবার রেফারিংয় ফিরতে পারেন কি-না আকলিমা।
×