ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সাজ্জাদ কাদির

চলে গেলেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম

প্রকাশিত: ২০:৫৫, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০

চলে গেলেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম

করোনাকালে দেশে এই মুহূর্তে করোনা রোগীর চিকিৎসাক্ষেত্রে সবচেয়ে আস্থার নাম সিএমএইচ। দেশের তাবত হাসপাতাল যখন উন্নত চিকিৎসা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে তখন সিএমএইচ আশার বাতি জ¦ালিয়ে রেখেছে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ সরকারী-বেসরকারী হাসপাতালে প্রাথমিকভাবে ভর্তি হলেও অবস্থার উন্নতি না হলেই সিএমএইচের শরণাপন্ন হচ্ছেন। এই হাসপাতাল গত সাত মাসে প্রচুর করোনা রোগীকে বিশ^মানের চিকিৎসা সেবা দিয়ে সুস্থ করে বাড়িতে পাঠিয়েছে। আবার আমাদের অনেক জাতীয় ব্যক্তিত্ব গুরুতর অসুস্থ হয়ে সিএমএইচে ভর্তি হয়ে না ফেরারা দেশেও চলে গেছেন। কারণ হচ্ছে একবারে শেষ পর্যায়ে বা গুরুতর অবস্থায় গিয়ে শেষ ভরসাস্থল হিসেবে সিএমএইচে ভর্তি হন এবং যারা চলে গেছেন তারা বয়সেও সিনিয়র সিটিজেন। তাদের আগে থেকেই শরীরে নানা অসুখ বাসা বেঁধে ছিল। করোনা আক্রান্ত হওয়ার ফলে তাদের অনেকেই চিরবিদায় নিয়েছেন। এ জন্য কোন সিনিয়র সিটিজেনের সিএমএইচে ভর্তি হওয়ার খবর শুনলেই কেন যেন এক অজানা আশঙ্কা এসে ভর করে মনের মধ্যে। মনে হয় তিনি সুস্থ হয়ে ফিরবেন তো? আইন অঙ্গনের নিবেদিতপ্রাণ এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গত ৩ সেপ্টেম্বর রাতে জ¦রে আক্রান্ত হন। পরদিন সকালে টেস্ট রিপোর্টে তিনি করোনা পজিটিভ হন। তাকে ভর্তি করা হয় সিএমএইচে। অবস্থার আরও অবনতি হলে তাকে ১৮ সেপ্টেম্বর নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেয়া হয়। লাইফ সাপোর্টে রাখা হয় তাকে। ক’দিন থেকে মনের মধ্যে আশঙ্কা কাজ করছিল যে, তিনি সুস্থ হয়ে ফিরবেন তো? এর মধ্যেই ২৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টা ২৫ মিনিটে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ৭১ বছর বয়সে অবসান হয় এক বর্ণাঢ্য জীবনের। কেমন ছিল তার জীবন দেখে নেয়া যাক। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মুন্সীগঞ্জ জেলাধীন লৌহজং উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নেরর মৌছামণ্ডা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। তার পিতা মরহুম ওহাজউদ্দিন আহমেদ এবং মাতা মরহুমা মতিজান বিবি। ছয় ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। মাহবুবে আলম লৌহজংয়ের কাজীর পাগলা এটি ইনস্টিটিউটে শিক্ষা জীবন শুরু করেন। ১৯৬৩ সালে ঢাকার আর্মানিটোলা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৬৫ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে বিএ অনার্স ও ১৯৬৯ সালে একই বিশ^বিদ্যালয় থেকে লোক-প্রশানে এমএ পাস করেন। ১৯৭২ সালে ঢাকা সিটি ল কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রী অর্জন করেন এবং ১৯৭৯ সালে ভারতের দিল্লীর ইনস্টিটিউট অব কনস্টিটিউশনাল এ্যান্ড পার্লামেন্টারি স্টাডিজ থেকে আন্তর্জাতিক আইন ও সংসদীয় পদ্ধতি বিষয়ে ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করেন। মাহবুবে আলম ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৩ সালে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা এবং ১৯৬৯ সালে আয়ুব বিরোধী গণআন্দোলনে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালান। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে রমনা রেসকোর্স ময়দানে মিছিল নিয়ে অবস্থান করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করে নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহযোগিতা করেন। মাহবুবে আলম ১৯৭২ সালে তৎকালীন ঢাকার কায়েদে আজম কলেজ যেটি বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী কলেজ সেখানে নৈশ বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এই পেশাতেই নিয়োজিত ছিলেন। পাশাপাশি ১৯৭৩ সালে ঢাকা জজ কোর্ট ও ১৯৭৫ সালে সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ও ১৯৮১ সালে আপীল বিভাগে আইন পেশা শুরু করেন। আট বছর অধ্যাপনা করে শেষ পর্যন্ত আইন পেশাতেই থিতু হন। ১৯৯৮ সালে সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র এ্যাডভোকেট হিসেবে সনদ লাভ করেন। ওই বছরেরই ১৫ নবেম্বর থেকে ২০০১ সালের ৪ অক্টোবর পর্যন্ত রাষ্ট্রের অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মাহবুবে আলম। এর মধ্যে ১৯৯৩-৯৪ সালে তিনি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীদের সংগঠন সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০০৫-২০০৬ মেয়াদে তিনি আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। নবম জাতীয় সংসদে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ২০০৯ সালে তিনি এ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ লাভ করে আমৃত্যু অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে এই পদে দায়িত্ব পালন করেন। তার কর্ম জীবনে সংবিধানের পঞ্চম, সপ্তম, ত্রয়োদশ ও ষোড়শ সংশোধনী মামলার রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, জেল হত্যা মামলা, যুদ্ধাপরাধী মামলা, পিলখানা বিডিআর বিদ্রোহ মামলাসহ অসংখ্য চাঞ্চল্যকার মামলা পরিচালনা করে তিনি আমাদের ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠেছেন। অনেক চাঞ্চল্যকর মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকিতেও পড়েছেন কখনও কখনও। বিভিন্ন সময় তাকে শত্রুপক্ষ নানা রকম হুমকি ও প্রলোভন দেখিয়েছে। কিন্তু সবকিছু পেছনে ফেলে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে আমৃত্যু তিনি দায়িত্ব পালন করে গেছেন। আইন বিষয়ে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বাংলা একাডেমি কর্তৃক ফেলোশিপ লাভ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে স্ত্রী বিনতা মাহবুব, এক ছেলে সুমন মাহবুব, এক মেয়ে শিশির কণা ও নাতি-নাতনিকে নিয়ে ছিল তার পরিবার। এ দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় তিনি ছিলেন এক অগ্রনায়ক। ব্যক্তিগতভাবে তার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। শুধু তাই নয় তার স্ত্রীর সঙ্গেও যোগাযোগ আছে। মাহবুব-বিনতা এক চমৎকার দম্পতি ছিলেন। বাহির থেকে দেখেই বোঝা যেত স্বামী-স্ত্রী হিসেবে তাদের বন্ধন ছিল অত্যন্ত সুদৃঢ়। কিন্তু প্রকৃতির এক অমোঘ নিয়মে আজ তারা বিচ্ছিন্ন। ভাবতে খুব কষ্ট হচ্ছে একজনের অনুপস্থিতিতে অপরজনের বাকি জীবন কতটা মানসিক কষ্টে যাবে। তারা দুজনই যথেষ্ট আধুনিক। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একসঙ্গে চলতে পারতেন। ব্যক্তি মাহবুবে আলমকে যতটুকু দেখেছি তিনি ছিলেন অত্যন্ত আধুনিক একজন মানুষ। কথা বার্তা, কাজ-কর্মে অত্যন্ত মার্জিত ছিলেন। অল্প কথা বলতেন কিন্তু তার সেই অল্প কথায় অনেক কিছু প্রকাশ পেত। জ্ঞানের সব শাখায় তার অবাধ বিচরণ ছিল। কী নেই তাতে? আইন অঙ্গনের মানুষ হলেও শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি থাকত তার হৃদয় জুড়ে। প্রচ- রবীন্দ্র ভক্ত একজন মানুষ ছিলেন তিনি। তার সঙ্গে কথা বললে বোঝা যেত তিনি প্রচুর পড়ালেখা করা একজন মানুষ। ‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে,’ মাইকেল মধুসূদন দত্তের এই লাইনগুলো আমাদের এড়িয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। মৃত্যু অনিবার্য, চিরসত্য একটি বিষয়। কিন্তু কোন কোন মৃত্যু পৃথিবীকে দারুণভাবে নাড়া দিয়ে যায়। আর সেই মৃত্যু যদি হয় কোন বিশেষ রোগে তাহলে সেটি সত্যিই মেনে নেয়া কষ্টকর হয়ে পড়ে। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও মারা গেলেন বৈশ্বিক মহামারী করোনায়। ইতোমধ্যে আমরা আরও অনেক আপনজনকে হারিয়েছি এই রোগে। জানি না আরও কতজনকে হারাতে হবে। একটি বিশেষ সংক্রামক রোগে এমন একজন মহান মানুষের মৃত্যু মেনে নিতে সত্যিই খুব কষ্ট হচ্ছে। তিনি আজীবন বাংলাদেশের হৃদয়ে থাকবেন তার কর্মের মাধ্যমে। আমরা তার আত্মার চির শান্তি কামনা করছি। লেখক : গণমাধ্যমকর্মী [email protected]
×