ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

ধর্ষণ ও হিংস্রতা ॥ ক্ষমতার উন্মত্ত প্রকাশ

প্রকাশিত: ২০:৫৩, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০

ধর্ষণ ও হিংস্রতা ॥ ক্ষমতার উন্মত্ত প্রকাশ

ধর্ষণকে কি বলা যায়, প্রতিহিংসা নাকি প্রতিশোধপরায়ণতা? প্রকারান্তরে ধর্ষণের পেছনে থাকে রাজনীতি। ক্ষমতাবানের দম্ভ প্রকাশ। সাভারে রীনা রায় ধর্ষণ ও হত্যা, খাগড়াছড়ির আদিবাসী নারীকে গণধর্ষণ, সিলেট এমসি কলেজে স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে আসা সদ্য বিবাহিত নারী ধর্ষণ- এ সবগুলো ঘটনার সঙ্গে কোন না কোনভাবে জড়িয়ে আছে রাজনীতি। ক্ষমতার দম্ভ। মানুষের প্রতিশোধপরায়ণতা কত ভয়ঙ্কর হতে পারে তার অনেক নিদর্শন রয়েছে গ্রীক নাটক ও পুরাণে। এমন কি শেক্সপিয়ারের নাটকেও। ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’ বিশেষ করে ‘টাইটাস এ্যান্ড্রোনিকাস’-এর অন্যতম উদাহরণ। মার্চেন্ট অব ভেনিসের ইহুদী ব্যবসায়ী শাইলাকের ওপর প্রতিশোধ, ‘টাইটাস এ্যান্ড্রোনিকাস’-এর বর্বরতা প্রতিমুহূর্তে লোমহর্ষক। আপাত নাটকীয়তায় পূর্ণ মনে হলেও এর গভীরে রয়েছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। ক্ষমতাবানের অবদমন মানসিকতা। সফোক্লিসের নাটকের ওপর ভিত্তি করে রচিত ‘মেটামরফসিস’ কাব্যের বিষয়বস্তুও বীভৎস প্রতিশোধপরায়ণতায় ভরা। সভ্যতার কেন্দ্র এথেন্সকে চারদিক থেকে ‘বর্বর’রা ঘিরে ধরলে আক্রান্ত এথেন্সের এক রাজা প্যান্ডিয়ান বর্বর থ্রেসিয়ান রাজা টেরিউসের সাহায্য চায়। টেরিউস এথেন্স রক্ষা করলে প্যান্ডিয়ান নিজের মেয়ে প্রকনিকে টেরিউসের সঙ্গে বিয়ে দেয়। পাঁচ বছর টেরিউসের সঙ্গে ঘর করার পর প্রকনি এথেন্সে নিজের পরিবার বিশেষ করে বোন ফিলোমেলকে দেখার জন্য যেতে চায়, টেরিউস সম্মত হয় না। সে জানায়, বড়জোর সে এথেন্সে গিয়ে তার বোনকে এনে দিতে পারে। প্রকনি অগত্যা তাতেই রাজি হয়। টেরিউস এথেন্সে যায় এবং ফিলোমেলকে নিয়ে ফেরার পথে তাকে ধর্ষণ করে। এ ঘটনা যাতে কাউকে বলতে না পারে সে জন্য টেরিউস ফিলোমেলের জিভ কেটে নেয়। কিন্তু কথা বলতে না পারলেও বোনের বাড়ি এসে নকশি কাপড়ে ছবি এঁকে ফিলোমেল বোনকে পুরো ঘটনা জানায়। প্রকনি ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিশোধ নিতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তার এবং টেরিউসের প্রিয় পুত্র আইটিসকে হত্যা করে টেরিউসকে রেঁধে খাওয়ায়। এতসব নির্মমতার পেছনেও ওই ক্ষমতা ও আভিজাত্যের দম্ভ। গ্রীক সভ্যতার কেন্দ্র এথেন্স উন্নত সংস্কৃতির ধারক। উন্নততর সভ্যতার রাজা প্যান্ডিয়ান ইতর সভ্যতার টেরিউসের সহায়তা নিয়ে প্রাথমিকভাবে এ দূষণ ঘটিয়েছে। এরপর নিজের মেয়েকে তার সঙ্গে বিয়ে দেয়ায় উন্নত রক্তের সঙ্গে ইতর রক্তের সংমিশ্রণ ঘটল। তাতেই একের পর এক মানবিক সম্পর্কের বিপর্যয় এবং বিকৃতি। টেরিউসের সঙ্গে বিয়ে মেনে নিলেও প্রকনি কখনই ভুলতে পারেনি তার শরীরে বইছে উন্নত সংস্কৃতির রক্ত। এত তীব্র তার জাত্যাভিমান যে বোনের ওপর সংঘটিত অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে নিজের সন্তানকে অবলীলায় হত্যা করতে বাধেনি। ঘটনাগুলো এখন ঠিক এভাবে না ঘটলেও অন্তর্গত মানসিকতা একই। পরিবর্তিত সময় ও সমাজ বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঘটনার বহির্প্রকাশেও পরিবর্তন এসেছে। শেক্সপিয়ারের সময় সভ্য-অসভ্য নিয়ে তর্ক চলেছে। অটোম্যান তুর্কীরা সে সময়ের ইউরোপের আধুনিকতম নগরী ভেনিসের কর্তৃত্ব থেকে সাইপ্রাস দখলে নিলে এ তর্ক আরও তীব্র হয়। এরপর গোটা পূর্ব ইউরোপ দখল করলে তখন পর্যন্ত জানা পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ অটোম্যানদের কর্তৃত্বে চলে যায়। ইউরোপীয়দের কাছে যা ছিল ভীতিকর। এর বিজয়াভিযানকে দেখা হয়েছিল সভ্য পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে অসভ্য বা তাদের ভাষায় বর্বর প্রাচ্যের আক্রমণ হিসেবে। রেনেসাঁসের সময় প্রবলভাবে মনে করা হতো খ্রীস্টান জগত হচ্ছে সভ্যতার কেন্দ্র আর এর সীমার বাইরের জনগোষ্ঠী হচ্ছে অসভ্য বা বর্বর। প্রাক খ্রীস্টান যুগেও এ মনোভাব ছিল। অহেলেনীয় মাত্রই বর্বর বলে গণ্য হতো। সভ্যতার কেন্দ্র থেকে যে জনগোষ্ঠী যত বেশি দূরে তারা তত বেশি বর্বর। তাই তাদের সঙ্গে সভ্যদের রাজনৈতিক ও সামাজিক মিশ্রণকে ভীষণভাবে দোষের মনে করা হতো। উনিশ শতকের আমেরিকায় গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে কৃষ্ণাঙ্গরা ক্রীতদাসত্ব থেকে মুক্তি পেলেও স্বাধীন মানুষ হিসেবে তাদের গতিবিধির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। শ্বেতাঙ্গদের এলাকায় তারা চাকরি, ব্যবসা বা অন্য কোন ধরনের কাজ করতে পারত না। বাস করার তো প্রশ্নই ওঠে না। তাদের ব্যবহার করা জলাশয়, পার্ক, বাস-ট্রেনসহ অন্য যানবাহন, হাসপাতাল, কবরস্থান, ব্রোথেল ইত্যাদিতে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল। এ নিষেধ অমান্য করলে প্রকাশ্যে জীবিত পুড়িয়ে মারা হতো তাদের। বিশ শতকের শুরুতে আমেরিকার কয়েকটি রাজ্যের প্রায় ত্রিশ হাজার মানুষকে ‘দূষিত রক্ত’ বহনের অপরাধে নির্বীর্য করা হয় এবং ভার্জিনিয়া ও ক্যালিফোর্নিয়ার মতো বড় বড় রাজ্যে এদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ রাখা হতো। অনেক গবেষক মনে করেন হিটলার ‘ঘেটো’র ধারণা পেয়েছিল এখান থেকে। সামাজিকভাবে আমেরিকায় যখন বর্ণবাদের সপক্ষে সুকৌশল প্রচারণা চলছে, অর্থনীতিতেও তখন চলছে নবতর সংযোজন। বাজারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া, ব্যক্তি মালিকানার অনুমোদন, অবাধ প্রতিযোগিতার নিশ্চয়তা এবং রাষ্ট্রের তথাকথিত নিরপেক্ষ ভূমিকা-এই চার মূলনীতি নিয়ে অগ্রযাত্রার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ ছক অনুযায়ী পথ চলতে শুরু করে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এগোতে এগোতে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর তা দুর্ধর্ষ গতিবেগে ছড়িয়ে পড়ে। সহ¯্রাব্দের শুরু থেকে এর প্রভাব মানুষকে চূড়ান্ত আত্মকেন্দ্রিক করে তুলেছে। আত্মকেন্দ্রিকতা বা নিজের স্বার্থ পূরণের যে আদিম মনোবৃত্তি মানুষের মধ্যে সুপ্ত থাকে, প্রতি মুহূর্তে তা উস্কে দিচ্ছে বর্তমান বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। সূক্ষ্মভাবে মানুষের মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে অহেতুক অভাববোধ। যাতে মনে হয় ভোগের যাবতীয় আয়োজন তার জন্য অপরিহার্য। একদিকে গণতান্ত্রিক অধিকার হারিয়ে সে বঞ্চিত ও শোষিত হয়, অন্যদিকে পণ্যের গ্রাহক হয়ে নিজের অজান্তে পুঁজিপতিদের মুনাফার পাহাড় গড়তে সাহায্য করে। এই যে চারপাশে ঘটা নানা রকম বীভৎসতা, এর মূল দায় এই বাজার অর্থনীতির, বিশ্বময় এই গণতন্ত্রহীনতার রাজনীতি। এ ব্যবস্থা মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতাকে সযতেœ লালন করে প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে এমনভাবে উপস্থাপন করে যাতে মনে হয়, সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য স্বার্থপরতাই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ মানবিক গুণ। এ মানসিকতা জন্ম দেয় বিকৃত প্রতিযোগিতার। যেখানে সৎ, মেধাবী, আদর্শবান কর্মঠ মানুষ পিছিয়ে পড়েন। প্রতিভা থাকার পরও প্রতিষ্ঠিত ও বিত্তবান হতে না পারায় চারপাশের মানুষ তাদের করুণা করে। যেন বিত্ত অর্জনই প্রতিভা পরিমাপের ব্যারোমিটার। মেধা প্রতিভা জ্ঞান পণ্যের মোড়কে উপস্থাপিত না হলেই তা হয়ে পড়ে মূল্যহীন। এই ভোগপ্রবণ মানসিকতা ও অসুস্থ প্রতিযোগিতা সমাজে যে অস্থিরতা সৃষ্টি করে তা থেকে বিষাদগ্রস্ততা, হতাশা ইত্যাদি নানা ধরনের মানসিক উপসর্গ ছোঁয়াচে রোগের মতো ছড়িয়ে পড়ে। যার বিকৃত বহির্প্রকাশ ইদানীং বড় বেশি করে দেখছি আমরা। এও দেখছি, আঁতকে ওঠার মতো একেকটা ঘটনা হঠাৎ আলোচনার শীর্ষে উঠে ক’দিনের মধ্যেই হারিয়ে যায়। সবাই যে যার মতো ভুলে গিয়ে নিজ কাজে মনোযোগী হয়। পুঁজিবাদের এ অসুস্থ প্রতিযোগিতা যতদিন থাকবে, মানবিক সম্পর্কের বিপর্যস্ততাগুলোও ততদিন এর উপসর্গ হিসেবে নির্দিষ্ট বিরতি দিয়ে প্রকট হয়ে উঠবে।
×