ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন

সুপ্রীমকোর্ট প্রাঙ্গণে মাহবুবে আলমকে শেষ শ্রদ্ধা

প্রকাশিত: ২৩:০০, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০

সুপ্রীমকোর্ট প্রাঙ্গণে মাহবুবে আলমকে শেষ শ্রদ্ধা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন বাংলাদেশের প্রধান আইন কর্মকর্তা (এ্যাটর্নি জেনারেল) মাহবুবে আলম। বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান ও বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমানের সমাধিস্থলের পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়। সোমবার দুপুর ১টার দিকে তাকে সমাহিত করা হয়। এ সময় আপীল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ার, সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন, ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিকসহ আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া ছেলে সুমন মাহবুব ও মেয়ে শিশির কনাসহ আত্মীয় স্বজনেরা উপস্থিত ছিলেন। সুপ্রীমকোর্ট প্রাঙ্গণে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর প্রতিক্রিয়ায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, মরহুম এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের কর্মময় জীবন আগামী দিনের আইনজীবীদের জন্য এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হবে। মন্ত্রী বলেন, মরহুম মাহবুবে আলম অনেক কিছু শিক্ষণীয় দেখিয়েছেন, করে গেছেন এবং বলেছেন। তাই যারা মাহবুবে আলমকে দেখেনি, যারা তার সম্পর্কে জানে না তাদেরকে মাহবুবে আলমের আদর্শগুলো জেনে অনুসরণ করার চেষ্টা করার অনুরোধ জানান আনিসুল হক। আইনমন্ত্রী মাহবুবে আলমের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, আজ সুপ্রীমকোর্ট আছে কিন্তু এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম নেই। এটা তিনি মেনে নিতে পারছেন না। তার এই চলে যাওয়ায় সুপ্রীমকোর্ট তথা সারাদেশের আইন অঙ্গনে এক বিশাল শূন্যতা তৈরি হলো বলেও জানান আইনমন্ত্রী। আইনমন্ত্রী বলেন, এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে তিনি প্রায় ৪০ বছর যাবত চেনেন ও জানেন। তারা বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাসহ অনেক মামলা একসঙ্গে পরিচালনা করেছেন। তাই মরহুমের সঙ্গে তার অনেক স্মৃতি রয়েছে। নিজ কর্মগুণেই তিনি চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। জানাজা শেষে মাহবুবে আলমের কফিনে শ্রদ্ধা জানান আইনমন্ত্রী। এছাড়া আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মোঃ গোলাম সারওয়ার মাহবুবে আলমের কফিনে শ্রদ্ধা জানান। এর আগে সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতি প্রাঙ্গণে তার জানাজা সম্পন্ন হয়। জানাজা শেষে তার মরদেহ রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এছাড়া প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোঃ আখতারুজ্জামান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কনক কান্তি বড়ুয়া, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) বেনজীর আহমেদ প্রমুখ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়, ল রিপোর্টার ফোরামসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকেও শ্রদ্ধা জানানো হয়। এরপর মাহবুবে আলমের মরদেহ মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সোমবার সুপ্রীমকোর্ট নিয়মিত বিচারিক কার্যক্রমে বসেনি। গত রবিবার ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ইন্তেকাল করেন। সোমবার বেলা ১১টা ৩৫ মিনিটে সুপ্রীমকোর্ট প্রাঙ্গণে তার জানাজা শেষে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তার মরদেহ দাফন করা হয়। সুপ্রীমকোর্ট জামে মসজিদের খতিব জানাজায় ইমামতি করেন। জানাজায় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, আপীল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিগণ, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এমপি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ.ম রেজাউল করিম, রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ, সুপ্রীমকোর্ট বার সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন, সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজলসহ সমিতির নেতৃবৃন্দ, এ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের কর্মকর্তাগণ, সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসনের কর্মকর্তাগণ, সিনিয়র আইনজীবীগণসহ বিপুলসংখ্যক আইনজীবী ও অন্যরা জানাজায় অংশ নেন। জানাজার পূর্বে সুপ্রীমকোর্ট বার সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন ও এ্যাটর্নি জেনারেলের একমাত্র ছেলে সুমন মাহবুব সকলের উদ্দেশে কথা বলেন। তারা মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনায় সকলের দোয়া কামনা করেন। সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল জানাজার অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন। বেলা ১১টার দিকে তার মরদেহ সুপ্রীমকোর্ট প্রাঙ্গণে আনা হয়। হাসপাতালের হিমঘর থেকে সকাল ৮টার পর মাহবুবে আলমের মরদেহ মিন্টু রোডে তার সরকারী বাসভবনে নেয়া হয়। সেখানে এক আবেগ ঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। শ্রদ্ধা জানাতে আসা সমবেতদের উদ্দেশে সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘মাহবুবে আলম নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে গেছেন আইন পেশা ও আইনজীবীদের প্রতি দায়বদ্ধতা রক্ষার জন্য। সেই দায়বদ্ধতা রক্ষা করতে গিয়ে যদি কোন ভুল করে থাকেন, তবে আপনারা তাকে ক্ষমা করে দেবেন। আর যদি কারও কোন ধরনের পাওনা থেকে থাকে তাহলে তার (মাহবুবে আলমের) কন্যা আইনজীবী শিশির কনার সঙ্গে, অথবা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। মাহবুবে আলমের ছেলে সুমন মাহবুব কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘কোনভাবে যদি আমার বাবার দ্বারা কেউ কষ্ট পেয়ে থাকেন, তাহলে তাকে ক্ষমা করে দেবেন। আমার বোন আইনজীবী সমিতির সদস্য, তার প্রতি আপনারা খেয়াল রাখবেন। আমার আর কিছু বলার নেই।’ জানাজা শেষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয় মাহবুবে আলমের কফিনে। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সোমবার সুপ্রীমকোর্ট নিয়মিত বিচারিক কার্যক্রমে বসেনি। সকালে ভার্চুয়াল আপীল বেঞ্চের কাজ শুরু হলে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা ব্যথিত। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আজ আদালত বসছে না। গত ৪ সেপ্টেম্বর জ্বর নিয়ে ঢাকা সিএমএইচে ভর্তি হয়েছিলেন মাহবুবে আলম। সেখানে নমুনা পরীক্ষায় তার করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৮ সেপ্টেম্বর তার শারীরিক অবস্থার হঠাৎ অবনতি ঘটলে সেই দিনই তাকে আইসিইউতে নেয়া হয়। তবে সর্বশেষ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরীক্ষায় ফল নেগেটিভ এসেছিল বলে জানিয়েছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। মাহবুবে আলম ২০০৯ সালে এ্যাটর্নি জেনারেলের পদে নিয়োগ পান। পদাধিকার বলে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি। এ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে সর্বোচ্চ আদালতে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার বিচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন মাহবুবে আলম। এছাড়া সংবিধানের পঞ্চম, সপ্তম, ত্রয়োদশ ও ষোড়শ সংশোধনী মামলা পরিচালনাও করেন তিনি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকা-ের মামলায়ও যুক্ত ছিলেন মাহবুবে আলম। আলোচিত বিডিআর বিদ্রোহ হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবীর দায়িত্বে ছিলেন তিনি। তিনি এক মেয়াদে সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এবং এক মেয়াদে সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। মাহবুবে আলমের জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মৌছামান্দ্রা গ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৮ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স এবং ১৯৬৯ সালে লোক প্রশাসনে ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি। পরে ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রী নেন। ছাত্র জীবনে বাম আন্দোলনে যুক্ত মাহবুবে আলম পরে বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের সহসভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টিতে বিভক্তির পর রাজনীতি ছেড়ে আইন পেশায় পুরোদমে সক্রিয় হন মাহবুবে আলম। অবশ্য তিনি বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে তালিকাভুক্ত হয়ে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য হয়েছিলেন ১৯৭৩ সালেই। ১৯৭৫ সালে সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে এবং ১৯৮০ সালে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে আইন পেশা পরিচালনার অনুমতি পান মাহবুবে আলম। ১৯৯৮ সালে তিনি আপীল বিভাগের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে ১৯৯৮ সালের ১৫ নবেম্বর থেকে ২০০১ সালের ৪ অক্টোবর পর্যন্ত অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন মাহবুবে আলম। ২০০৭ সালে দেশে জরুরী অবস্থা জারির আগে তিনি সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলেন। সেনা নিয়ন্ত্রিত ওই সরকার আমলে শেখ হাসিনা গ্রেফতার হওয়ার পর শীর্ষ আইনজীবীদের অনেকে পিছুটান দিলেও আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর পক্ষে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মাহবুবে আলম। দৃশ্যত সেই কারণেই তার ওপর আস্থাবান ছিলেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর ২০০৯ সালের ১৩ জানুয়ারি এ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান মাহবুবে আলম। তার পর থেকে টানা ১১ বছর তিনি এ দায়িত্বে ছিলেন। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে জন্মস্থান মুন্সীগঞ্জ থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন মাহবুবে আলম। তবে তাকে প্রার্থী না করে এ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্বই চালিয়ে যেতে বলা হয়। রবীন্দ্র সাহিত্যের বিশেষ অনুরাগী মাহবুবে আলমের স্ত্রী বিনতা মাহবুব একজন চিত্রশিল্পী। তাদের দুই সন্তানের মধ্যে ছেলে সুমন মাহবুব দীর্ঘদিন সাংবাদিকতায় ছিলেন, মেয়ে শিশির কনা আইন পেশায় রয়েছেন। ঢাবি উপাচার্যের শোক ॥ বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার জানান, এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের মৃত্যুতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। রবিবার এক শোক বাণীতে উপাচার্য বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী, সিন্ডিকেট সদস্য ও রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম ছিলেন একজন খ্যাতিম্যান আইনজ্ঞ ও শিষ্টাচারবোধ সম্পন্ন বিনম্্র চরিত্রের প্রকৃত ভদ্রলোক। অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন এই বিজ্ঞ মানুষের মৃত্যুতে জাতি শুধু একজন বিশিষ্ট আইনবিদকে হারায়নি বরং একজন ভালমানুষকে হারাল। অন্যদিকে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)। বিইউপির উপাচার্য মেজর জেনারেল আতাউল হাকিম সারওয়ার হাসান , এসবিপি, এসজিপি, এনডিসি, এএফডব্লিউ সি, পএসসি, পিএইডি এক শোকবার্তায় জানান, তার মৃত্যুতে আইন অঙ্গনে বাংলাদেশের অপূরণীয় ক্ষতি হলো।
×