ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

শংকর লাল দাশ

ইলিশ ছড়াছড়ির নেপথ্যে

প্রকাশিত: ০০:০০, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০

ইলিশ ছড়াছড়ির নেপথ্যে

প্রায় সারাদেশ জুড়েই চলছে এখন কমবেশি ইলিশের ছড়াছড়ি। বিশেষত সাগরপাড়ের জেলাগুলোতে ইলিশের ছড়াছড়ি এ যাবতকালের সবচেয়ে বেশি। হাটবাজার থেকে শুরু করে মোকামের আড়ত সর্বত্র ইলিশের রুপালি ঝিলিক। ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাকডাকে সরগরম হয়ে উঠেছে জনপদ। আড়ত আর বরফমিলগুলোতে বেড়েছে কর্মব্যস্ততা। ইলিশনির্ভর মানুষগুলোর দম ফেলার ফুরসত নেই। আর সহজলভ্যতার কারণে ইলিশের দামও কমে এসেছে সাধারণের নাগালে। পটুয়াখালীর সাগর তীরবর্তী দুটো উপজেলার প্রতি লক্ষ্য করলেই এর সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যাবে। পটুয়াখালীর সাগরপাড়ের রাঙ্গাবালী ও গলাচিপা উপজেলা বরাবরই ইলিশের অন্যতম উৎসস্থল হিসেবে পরিচিত। এ বছর যেন তার সবকিছুই ছাপিয়ে গেছে। ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে গত ২৩ জুলাই থেকে সাগরে বর্ষাকালীন ইলিশ ধরার মৌসুম শুরু হয়েছে। মৎস্য দফতরের তথ্যানুযায়ী জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ এবং পরবর্তী আগস্ট মাসে কেবলমাত্র দুই উপজেলায় দুই হাজার মেট্রিকটনেরও বেশি ইলিশ ধরা পড়েছে। যা গত বছরের মৌসুমের চেয়ে প্রায় ৩০ ভাগ বেশি। মধ্য আগস্টে বিরূপ আবহাওয়ার কারণে জেলেরা ৮-১০ দিন ইলিশ ধরতে পারেনি। ওই সময়টাতে ইলিশ ধরা গেলে আহরিত মাছের পরিমাণ নিঃসন্দেহে আরও বাড়ত। মৎস্য বিভাগীয় কর্মকর্তা ও অভিজ্ঞ জেলেদের সঙ্গে কথা বলে এবং বাজার পর্যবেক্ষণে এবারের ইলিশের প্রধান দুটি বৈশিষ্ট্যে লক্ষ্য করা গেছে। এর প্রথমটি হচ্ছে-চলতি মৌসুমের এখন পর্যন্ত নদীর তুলনায় সাগরে বেশি ইলিশ ধরা পড়ছে। যার পরিমাণ শতকরা ৭৫ ভাগেরও বেশি। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে ইলিশের সাইজ। এবার শতকরা ৪৫ ভাগ ইলিশই এক কেজির ওপরের। এরমধ্যে ১৫ ভাগেরও বেশি আবার দেড় কেজির ওপরে। ইলিশের এ সাইজ বা আকার সকলকেই বিস্মিত করছে। এর প্রধান কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গলাচিপা সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা জানান, ইলিশ সম্পদ রক্ষা ও প্রাচুর্য বাড়াতে গত কয়েক বছরে সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যার অন্যতম হচ্ছে, জাটকা নিধন বন্ধ, প্রজনন মৌসুম নির্বিঘœ রাখা, জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানসহ বহুমুখী গবেষণা এবং সে সবের সফল বাস্তবায়ন। নদীর তুলনায় সাগরে ইলিশ বেশি ধরা পড়ার কারণ সম্পর্কে তিনি আরও জানান, সাগর থেকে ইলিশ নদীতে আসার জন্য যে অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রয়োজন, তা এ মুহূর্ত পর্যন্ত আসেনি। অর্থাৎ সাগরে প্রবল ¯্রােত তৈরি এবং বৃষ্টি হলে মিষ্টি পানির উদ্দেশ্যে সাগর থেকে ইলিশ নদীতে উঠে আসবে। আশা করা যায় শীঘ্রই এ অবস্থা তৈরি হবে। মৎস্য বিশেষজ্ঞের মতামতেও এর সত্যতা মিলেছে। ঢাকার শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ, এ্যাকোয়াকালচার এ্যান্ড মেরিন সায়েন্স অনুষদের শিক্ষক মীর মোহাম্মদ আলী এ প্রসঙ্গে বলেন, গত কয়েক বছরে ইলিশের প্রজনন মৌসুম নিরাপদ রাখা অনেকটাই সফল হয়েছে। যার ফলে দেশে ইলিশ ক্রমে বাড়ছে। এছাড়া জাটকা সংরক্ষণে সরকারের উদ্যোগও ফলপ্রসূ হয়েছে। নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার বন্ধ সরকার ক্রমে কঠোর হচ্ছে। এসব কারণেও ইলিশ বাড়ছে। আশা করা যাচ্ছে কিছুটা ঝড় বৃষ্টি হলেও নদীতেও প্রচুর ইলিশ মিলবে। এ প্রসঙ্গে তিনি ইলিশ নিয়ে আরও গবেষণার ওপর জোর দিয়ে বলেন, যত বেশি গবেষণা করা যাবে। ততই তার সুফল পাওয়া যাবে। এদিকে, ইলিশের ছড়াছড়ির কারণে বাজারে দামও কমে এসেছে এ যাবত কালের সর্বনি¤েœ। সর্বশেষ ১১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার স্থানীয় আড়তগুলোতে এক কেজি সাইজের ইলিশ সর্বোচ্চ সাড়ে ৭ শ’ থেকে ৮ শ’ এবং দেড় কেজি বা তার ওপরের ইলিশ প্রতি কেজি সাড়ে ৯ শ’ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। ৫ শ’ গ্রাম থেকে সাড়ে ৯ শ’ গ্রামের ইলিশ প্রতি কেজি সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় শ’ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। ৫ শ’ গ্রামের নিচের ইলিশ আরও কম দামে বিক্রি হয়েছে। সাগরের ইলিশের তুলনায় নদীর ইলিশের দাম এরচেয়ে কিছুটা বেশি। কেজি প্রতি অন্তত দেড়-দু’শ’ টাকা হেরফের হচ্ছে। বরিশালের পোর্টরোডের আড়তগুলোতে প্রাপ্যতার ভিত্তিতে কমবেশি এমন দামেই ইলিশ বেচাকেনা হচ্ছে। মৎস্য দফতর সূত্রে জানা গেছে, গলাচিপা ও রাঙ্গাবালী উপজেলায় ২৫ হাজার ৬৪১ জন নিবন্ধিত জেলে রয়েছে। যারা সকলেই ইলিশ ধরায় নিয়োজিত। লক্ষ্য করা গেছে, এর বাইরেও অনেক মৌসুমী ইলিশ জেলে রয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও বহু জেলে বছরের এ সময়ে এ অঞ্চলে এসেছে। এ ধরনের জেলের সংখ্যা কয়েক হাজার। দুই উপজেলায় ৮ হাজারের বেশি ইঞ্জিনচালিত নৌকা, ট্রলার ও ফিশিংবোট রয়েছে। এরমধ্যে প্রায় দুই হাজার সমুদ্রগামী বড় ট্রলার রয়েছে। চরমোন্তাজ, মৌডুবী, চরআন্ডা, সোনারচর, চরজাহাজমারা, চরকাজল, বাহেরচর, চরবিশ্বাস, পানপট্টি, গলাচিপাসহ বড় কয়েকটি ঘাটে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব ঘাটে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০টি ট্রলার ইলিশ নিয়ে সমুদ্র থেকে ফিরছে। প্রতিটি ট্রলারে উপচে পড়ছে ইলিশ। প্রতিদিন কি পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়ছে, এ সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে বেশ কয়েকজন জেলের সঙ্গে কথা হয়েছে। এরমধ্যে চরবিশ্বাসের ইলিশ জেলে নাসির গাজী জানান, তিনি সাগরে গিয়েছিলেন দিন দশেকের জন্য। কিন্তু মাত্র দু’দিনেই ট্রলার ভর্তি হয়ে গেছে। তাই ফিরে এসেছেন। ইলিশ বিক্রি করেছেন ১ লাখ ৪০ হাজার টাকায়। রাঙ্গাবালীর চরলতা গ্রামের নসু ফরাজী জানান, সাগর মোহনায় তিন দিনে তিনি ৯২ হাজার টাকার ইলিশ বিক্রি করেছেন। ভোলার চরফ্যাশন থেকে চরমোন্তাজে ইলিশ ধরতে আসা ফয়সাল মাঝি জানান, সাগরে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। আগে যেখানে সাগরে ৮-১০ দিন থাকতে হতো, এখন সেখানে তিন চার দিনেই হয়ে যাচ্ছে। চরমোন্তাজের ব্যবসায়ী আজাদ সাথী জানান, এ বছর সাগরে মনে হচ্ছে যেন পানির চেয়ে ইলিশ বেশি। আরও কয়েকজন জেলে ও ব্যবসায়ী একই ধরনের কথা বলেছেন। সাগরে ইলিশের ছড়াছড়ি প্রসঙ্গে পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোল্লা এমদাদউল্লাহ জানান, আগামীতে আরও বেশি ইলিশ ধরা পড়বে, তা অনেকটাই নিশ্চিত।
×