ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মিহির কুমার রায়

কৃষক সহায়ক ঋণ নীতি

প্রকাশিত: ২৩:৫৯, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০

কৃষক সহায়ক ঋণ নীতি

সম্প্রতি ঘোষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালায় উল্লেখিত রয়েছে যে তফসিল ব্যাংকগুলোর জন্য চলতি ২০২০-২০২১ অর্থবছরের কৃষি ও পল্লী খাতে ২৬ হাজার ২৯২ কোটি টাকার ঋণ দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে যা গত বছরের তুলনায় ৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ বেড়েছে। গত বছর কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্য মাত্রা ছিল ২২ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা যার বিপরীতে বিতরণ করা হয়েছিল ২১ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা। এই টাকা দেশের অর্থনীতিতে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত মোট ঋণ বিতরণের মাত্র ২ শতাংশ যা থেকে অনুমান করা যায় ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এই খাতটি বরাবরই অবহেলিত রয়ে গেল। এই ঋণ বিতরণের ৫২ শতাংশ দেবে বেসরকারী ব্যাংক, সরকারী খাতের ব্যাংকগুলো দেবে ৩০ শতাংশ, বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো দেবে ১৫ শতাংশ এবং বিদেশী ব্যাংক দেবে ৩ শতাংশ । এখানে আরও উল্লেখিত যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে লক্ষ্যমাত্রার ৬০ শতাংশ বিতরণ হবে শস্য খাতে, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে বিতরণ হবে ১০ শতাংশ এবং বাকি আংশ হবে কৃষির অন্যান্য খাতে। এই সব ঋণের সুদের হার হবে ৯ শতাংশ হারে। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে সরকারের কৃষিবান্ধব নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অনুযায়ী দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুধামুক্তি ও সুস্বাস্থ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে নতুন নীতিমাল বা কর্মসূচী নেয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরে বেসরকারী ও বিদেশী বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের ৩১ মার্চ, ২০২০ ভিত্তিক নিট অগ্রিম ও ঋণের ২ শতাংশ হারে হিসাব ধরে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই লক্ষ্যমাত্রা আবশ্যিকভাবে বাস্তবায়িত করতে হবে এবং এর পরেও যে সকল ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে ব্যর্থ হবে তাদের অর্থবছর শেষে লক্ষ্যমাত্রার অনার্জিতের শেষ অংশের পরিমাণ অথবা ৩ শতাংশ হারে হিসাবকৃত অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের নিকট বাধ্যতামূলকভাবে জমা দিতে হবে। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর উপর কোন বারতি সুদ অরোপ করবে না। এই নীতিমালায় কাক্সিক্ষত কৃষি উৎপাদনের সহায়তার পাশাপাশি কৃষকের অনুকূলে ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন, পল্লী অঞ্চলের জনগণের জীবন মান উন্নয়ন এবং করোনাভাইরাসজনিত মহামারীর কারণে সৃষ্ট সঙ্কট কাটিয়ে উঠাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়। সার্বিকভাবে কৃষি খাতে পরিচালনা বরাদ্দ ১৯ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা, উন্নয়ন বরাদ্দ ১০ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা যা মোট বরাদ্দের ৩৪ শতাংশ যা গত অর্থবছরে ছিল মোট বরাদ্দের ৪০ শতাংশ। সংখ্যাত্মক বিচারে কৃষি খাতে উন্নয়ন ব্যয় কমানো হয়েছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। কৃষিমন্ত্রী বলেছেন করোনার বাস্তবতা মেনে নিয়ে জীবনের খাদ্য নিরাপত্তাসহ মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করনের লক্ষ্যেই প্রস্তাবিত হয়েছে আগামী বাজেট যেখানে কৃষি নীতি ২০১৮, ভিশন ২০১১ ও ২০৪১, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট, প্রেক্ষিত পবিকল্পনা, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ইত্যাদি স্থান পেয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে প্রণয়ন করেছে কর্মপরিকল্পনা ২০২০। চলতি বছরে শ্রমিক সঙ্কটের কারণে যান্ত্রিকীকরণের খাতে ভর্তুকি বাবদ ব্যয় করা হচ্ছে ২০০ কোটি টাকা এবং আগামী বছরে সারের ভর্তুকি বাবদ ৭০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকবে। চলতি বছরে কৃষি পুনর্বাসন সহায়তা খাতে ১২০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে আগামীতে ৩০০ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে এবং এক ইঞ্চি জমি যাতে পতিত না থাকে সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে যে বিএডিসি/ডিএই এর মাধ্যমে বাগান বাড়ি, বসতবাড়ি, শহরে কৃষি সম্প্রসারণে ৫০ কোটি টাকা বিতরণ করা হবে বীজ ও চারা বিতরণসহ কৃষি পরামর্শ কাজে। সম্প্রতিক এক তথ্য থেকে জানা যায় যে দেশের ৬১টি ব্যাংকের প্রায় ১০ হাজার শাখার অর্ধেকেরই বেশি গ্রামাঞ্চলে। কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ দিতে অনীহা রয়েছে। সরকারী এক হিসাবে দেখা যায় গ্রামে ঋণ গ্রহণকারী কৃষক পরিবারের শতকরা ৭৫ ভাগই চড়া সুদে ২০ থেকে ৩০ শতকরা হারে ঋণ নিয়েছে এনজিওদের কাছ থেকে। ব্যাংকগুলো কাগজে-কলমে গ্রামীণ শাখা খুললেও প্রকৃতপক্ষে সেগুলো শহরের মতো গ্রামীণ মানুষের বাণিজ্য, শিল্প ও ভোক্তাঋণ বিতরণ করছে। সরকারী এক হিসাবে বলা হয়েছে দেশে প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ কৃষক পরিবার রয়েছে যাদের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পেয়েছে মাত্র ২৫ শতাংশ যা সংখ্যায় ৬৫ লাখ মাত্র যাদের মধ্যে ৫০ লাখ ঋণ নিয়েছে বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থা এনজিও থেকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে দেশের ৪১ লাখ গ্রামের পরিবার ঋণের জন্য ব্যাংকে আবেদন করলেও সফল হতে পারেনি এবং এর কারণ হিসাবে ব্যাংকের অনীহা ও প্রচারের অভাবকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্ট মহল। এরপরও ঋণ প্রক্রিযায় জটিলতা, পদ্ধতিতে ত্রুটি ও অলিখিত লেনদেন খরচ ক্রমাগতভাবে বেড়ে যাওয়ায় কৃষক আর এই কৃষ্টির সঙ্গে নিজেদের মেলাতে পারছে না। অথচ কৃষকদের ঋণ সহায়তা প্রদানের জন্য সরকারের দুটি বিশেষায়িত ব্যাংক যেমন বিকেবি ও রাকাব রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, কৃষি ঋণ অকৃষি খাতে ব্যবহৃত হওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে যেখানে প্রকৃত কৃষকরা ঋণপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত যা তদারকির মাধ্যমে বন্ধ করার দাবি উঠছে। মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এনজিওগুলো থেকে যে কৃষি ঋণ বিতরণ হচ্ছে তার বেশি ভাগ কৃষি কাজে ব্যয়িত না হয়ে অন্য খাতে ব্যবহৃত হচ্ছে। আবার বিবিএসের তথ্যমতে মাত্র ১১ শতাংশ কৃষক তাদের ঋণের অর্থ কৃষি কাজে ব্যবহার করছে। আবার গৃহস্থালির অন্যান্য কাজে ঋণের অর্থ ব্যয় করছে প্রায় ৩৮ শতাংশ কৃষক পরিবার। এ তো গেল সনাতনি কায়দায় কৃষি ঋণ নীতিমালা বাস্তবায়ন ঋণ বিতরণ সংক্রান্ত রোজনামছা। এর একটি সংস্কার এখন সময়ে দাবি। একদিকে জমির স্বল্পতা অপরদিকে জনসংখ্যার চাপে প্রতিবছর এক শতাংশ হারে কৃষি জমি কমে যাওযার কারণে আধুনিক পদ্ধতিতে নিবিড় চাষ ছাড়া কোনভাবে কৃষি জাত পণ্যের বর্ধিত উৎপাদন ধরে রাখা সম্ভব নয়। তাই কৃষি নীতিমালায় কর্মসূচী ভিত্তিক কৃষি ঋণের পাশাপাশি প্রকল্পভিত্তিক কৃষি উদ্যোক্তা উন্নয়ন কর্মসূচীর প্রতি নজর দেয়া বাঞ্ছনীয়। এই পর্যায়ে জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে শস্য কিংবা শাকসবজি চাষের পদ্ধতিতে যে পরিবর্তন প্রয়োজন দেখা দিয়েছে তা মোকাবেলায় পরিবার ভিত্তিক খামার বিন্যাসের পরিবর্তে ব্যবসায়িক ভিত্তিক আধুনিক খামার কিংবা শস্য পর্যায়ের দিকে এগোতে হবে। এখন এই আধুনিক খামার যা হবে গ্রীন হাউজ ভিত্তিক প্রযুক্তিনির্ভর তার জন্য উদ্যোক্তা সৃষ্টি হতে হবে যার বড় কারখানা হলো দেশের সরকারী বা বেসরকারী পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত প্রায় ১৪৮টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রীধারী বিবিএ/এমবিএ ব্যক্তিবর্গ যাদের কোর্স কারিকুলামে উদ্যোক্তা উন্নয়ন বিষয়টি গঠিত হয় তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিকভাবে। কারণ মজুরি ভিত্তিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হওযায় স্বনিয়োজিত কর্মসংস্থানের সুযোগ বিদ্যমান যাকে কাজে লাগিয়ে অনায়াশেই কৃষিপণ্য উৎপাদন, খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচন সম্পন্ন করা যায় অথচ কৃষি ঋণ নীতিতে এ সকল বিষয়গুলোর স্বল্পতা রয়েছে। তাই আধুনিক কৃষক সৃষ্টির মাধ্যমে আগামী দিনের কৃষি উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে হবে।
×