ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

৩৭ কর্মকর্তা জড়িত ॥ তদন্ত রিপোর্ট

কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার নির্মাণে দুর্নীতির প্রমাণ

প্রকাশিত: ২৩:০৬, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০

কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার নির্মাণে দুর্নীতির প্রমাণ

ফিরোজ মান্না ॥ কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ৩৭ কর্মকর্তা। গণপূর্ত অধিদফতরের দীর্ঘ তদন্তে এই কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্ট থাকার প্রমাণ বেরিয়ে এসেছে। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের নাম পদবির তালিকাসহ তদন্ত রিপোর্টটি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে। যদিও এই দুর্নীতিবাজ অনেক কর্মকর্তাই এখন অবসরে চলে গেছেন। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন প্রধান প্রকৌশলীও রয়েছেন। বাকিরা বহাল তবিয়তে এখনও চাকরি করে যাচ্ছেন। কাউকে শাস্তি হিসাবে দফতর বদল করে দেয়া হয়েছে মাত্র। আবার কেউ কেউ পদোন্নতিও পেয়েছেন। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৪ একর জমির ওপর ৪০৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৬ সালে কারাগারটির নির্মাণ কাজ শেষ করা হয়। কারাগার নির্মাণে অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়টি এতদিন ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল। আর এই কাজ করেছেন অতীতের বেশ কয়েকজন প্রধান প্রকৌশলী। বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল আলমের স্টাফ অফিসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (সংস্থাপন) নন্দিতা রানী সাহা স্বাক্ষরিত তদন্ত রিপোর্টটি গত জুলাই মাসে শেষ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। গণপূর্ত অধিদফতরের তদন্ত রিপোর্টের একটি কপি জনকণ্ঠের হাতে এসেছে। গণপূর্ত বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, তদন্তে কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার নির্মাণে নি¤œমানের সামগ্রী ব্যবহার এবং দেয়াল ভেঙ্গে পড়াসহ নানা কাজে বিপুল অনিয়ম পাওয়া গেছে। এই অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও গণপূর্ত বিভাগ একাধিক তদন্ত কমিটি করেছিল। কিন্তু কোন রিপোর্টই প্রকাশ হয়নি। এবার গণপূর্ত বিভাগের রিপোর্টটি মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে। এটিও প্রকাশিত হতো কিনা তা নিয়ে সংশয় ছিল। গোপনীয় এই নথি জনকণ্ঠের হাতে আসার পর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের স্বরূপ উন্মোচন হচ্ছে। তদন্তে বলা হয়েছে, বিভিন্ন ধরনের ত্রুটির কারণে ২০১৭ সালের ১৫ এপ্রিল গণপূর্ত বিভাগ থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি বার বার তদন্ত করে প্রধান প্রকৌশলীর কাছে জমা দেন। জমা দেয়া প্রতিবেদন তৎকালীন যত প্রধান প্রকৌশলী এসেছেন তারা ধামাচাপা দিয়ে রেখেছেন। এবারই প্রথম কোন তদন্ত প্রতিবেদনের রিপোর্ট গণপূর্ত বিভাগ থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তদন্তে মোট ৩৭ জন কর্মকর্তাকে দায়ী করা হয়েছে। ২০১১ সালের ১৬ জুলাই থেকে ২০১৭ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত যে সব কর্মকর্তা উক্ত কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী এ বিষয়ে তাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। ফলে তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্ণিত সময়ে দায়িত্ব পালনকৃত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তাদের নামের তালিকা প্রেরণ করা হলো। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে এই তালিকা সম্প্রতি জমা দেয়া হয়েছে। তদন্তে জড়িত কর্মকর্তারা হলেন, মোঃ কবির আহমেদ ভুইয়া, এএসএমএম রফিকুল আলম, মোঃ মহসিন মিয়া, মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, মুহাম্মদ জিয়াউল হাফিজ ও মোঃ আব্দুল হাই। এরা সবাই ঢাকা গণপূর্ত জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন। উৎপল কুমার দে ও ড. মোঃ মঈনুল ইসলাম পিইঞ্জ। এরা দুই জন ঢাকা মেট্রোপলিটন জোনে ছিলেন। এই কর্মকর্তারা অনেকেই অবসরে চলে গেছেন। কেউ সাসপেন্ট অবস্থায় রয়েছেন। মোঃ হাফিজুর রহমান মুন্সী, মোঃ আব্দুল হাই, মোঃ সেলিম খান, সারওয়ার আহমেদ, একেএম মনিরুজ্জামান উৎপল কুমার দে। এই কর্মকর্তারা সেই সময় ঢাকা গণপূর্ত সার্কেল-২ এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ছিলেন। একই সার্কেলের তৎকালীন কর্মকর্তা একেএম সোহরাওয়াদী, মোঃ খালেদ হুসাইন তারা এখনও চাকরিতে রয়েছেন। তারাও তত্ত্ববাধায়ক প্রকৌশলী। একেএম মনিরুজ্জামান, উৎপল কুমার দে, মোঃ উজির আলী, মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল, এবিএম হুমায়ুন কবির ও আ.ন.ম মাজহারুল ইসলাম। এই কর্মকর্তারা ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন। তখন তাদের কর্মস্থল ছিল ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ-৩। মুহাম্মদ হাফিজুল ইসলাম, স্বর্ণেন্দ শেখর ম-ল, ইমতিয়াজ আহমেদ, শেখ নবীব আলী, মুহাম্মদ হাফিজুল ইসলাম, আবু শামস কায়সার চৌধুরী, অর্নব বিশ্বাস, সাজিদা খানম, এএসএম তাশফিক ইব্রাহিম। এই কর্মকর্তারা তখন উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তখন তারা ঢাকা গণপূর্ত উপ বিভাগ-৪ এ কর্মরত ছিলেন। মোঃ জামিল হোসেন, এবিএম সাজেদুল ইসলাম, মোঃ কামরুজ্জামান ফারুকী, মোহাম্মদ জাকির হোসেন, মোঃ রবিউল ইসলাম, সাজেদুল হক। এই কর্মকর্তারা গণপূর্ত বিভাগ-৩ উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (সিভিল) হিসাবে কর্মরত ছিলেন। মোঃ নাসিরউদ্দীন আহমেদ, মোহাম্মদ আলমাছ উদ্দীন, মোঃ আব্দুল মজিদ। এই তিন জন কর্মকর্তা ছিলেন ইএম জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী। মোঃ আব্দুল মজিদ, সুবাস কুমার ঘোষ, জাফর আহমেদ, মোঃ নুরুল ইসলাম, মোঃ আবুল কালাম, মোঃ তৈমুর আলম। এই কর্মকর্তারা ছিলেন গণপূর্ত ইএম সার্কেল-১ এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী। আ.খ.ম আক্কাস আলী, মোঃ আবুল কালাম, সৈয়দ জিয়াউল আহসান, মোঃ আলী আসগর, মোঃ আলমগীর খান, নিয়াজ মোঃ তানভীর আলম। এই কর্মকর্তারা তখন গণপূর্ত ইএম বিভাগ-৩ এর নির্বাহী প্রকৌশলী হিসাবে কর্মরত ছিলেন। বিদিপ রঞ্জন সাহা রায়, ফারহানা আহমেদ, রুবাইয়াত ইসলাম, কাজী মাশফিক আহমেদ। এই কর্মকর্তারা তখন গণপূর্ত ইএম উপবিভাগ-৬ এর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হিসাবে কর্মরত ছিলেন। মোঃ সামাদ আজাদ, আব্দুল খালেক আকন্দ ও বাপ্পী চাকমা গণপূর্ত ইএম বিভাগ-৩ এর উপ-সহকারী প্রকৌশলী গণপূর্ত ইএম বিভাগ-৩ কর্মরত ছিলেন। মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, তালিকাটি তাদের হাতে এক মাসের বেশি সময় আগেই এসেছে। তবে এখন পর্যন্ত কারো বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এদের বিরুদ্ধে দুদুকে মামলা করার সুপারিশ করা হবে কিনা এ বিষয়েও কিছু বলেনি। বিষয়টি নিয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। এদিকে, তৎকালীন কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন প্রশ্ন তোলেন, ভবনগুলো ব্যবহার করতে গিয়ে দেখা গেছে নির্মাণকাজ খুবই নিম্নমানের। অবকাঠামোগত ত্রুটি বন্দীদের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। একই অবস্থা বন্দীদের বসবাসের তিনটি ভবন ও কারারক্ষীদের একটি ব্যারাকেরও খুবই খারাপ বলে সেই সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে উত্থাপন করেন। তৎকালীন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক মোঃ জাহাঙ্গীর কবিরও ওই বৈঠকে উল্লেখ করেন, পাঁচটি ভবনের খসে পড়া পলেস্তারা এবং মূল দেয়ালের বিভিন্ন স্থানে ফাটলের জায়গায় আস্তর দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, বৃষ্টি হলেই ভবনের দেয়াল ভেতর থেকে ভিজে ওঠে। কারারক্ষী ব্যারাকের জানালা ভেঙ্গে পড়েছিল, সেগুলো মেরামত করা হয়েছে। মাস দুয়েক আগে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তিনটি আবাসিক ভবনে ঢোকার তিনটি লোহার গেট ভেঙ্গে পড়েছিল। সেগুলো গণপূর্ত অধিদফতর মেরামত করে দিয়েছে। নির্মাণে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করায় বন্দীদের দুটি ভবন তখনও বুঝে নেয়া হয়নি। বন্দীদের দুটি ভবনের জানালা-দরজা ঠিকমতো লাগানো যায় না। কিছু দরজা বাঁকা হয়ে গেছে। ফাঁসির মঞ্চে ওঠার সিঁড়ি এত খাড়া ও অপ্রশস্ত যে তার ওপরে ওঠা যায় না। বন্দীদের সাক্ষাৎকারের জায়গাও খুবই সংকীর্ণ। সেখানে একসঙ্গে একাধিক ব্যক্তি কথা বলতে থাকলে তা ঠিকমতো শোনা যায় না। নিরাপত্তার জন্য কারাগার চত্বরে ২৬০টি বৈদ্যুতিক খুঁটি রয়েছে। সামান্য ঝড়ো বাতাসে সাতটি খুঁটি ভেঙ্গে পড়েছিল। এর আগেও তিনটি খুঁটি পড়ে যায়। আবার ভেঙ্গে পড়া খুঁটিগুলো বদলে যেসব খুঁটি বসানো হয়েছে। এ গুলোও নিম্নমানের। অল্প দিনেই এতে জং ধরেছে। কয়েকটি খুঁটি লোহার পাইপ দিয়ে ঠেকা দিয়ে রাখা হয়েছে। তৎকালীন অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল ইকবাল হাসান ওই সময় স্বরাষ্ট্র ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিযে উন্নতমানের খুঁটি বসাতে বললেও তা করা হয়নি। ওই চিঠিতে বলা হয়, এ অবস্থায় প্রাণহানিসহ বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা আছে, নিরাপত্তা ঝুঁকি তো আছেই। কারা প্রশাসনিক ভবন, হাই সিকিউরিটি সেল, চারটি আবাসিক ভবনসহ বেশ কিছু স্থাপনা তৈরি করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খান এ্যান্ড সন্স। এই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
×