ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সফল চাষী সানোয়ার

মধুপুর যেন এক টুকরো ‘কফির রাজ্য’

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০

মধুপুর যেন এক টুকরো ‘কফির রাজ্য’

ওয়াজেদ হীরা, মধুপুর থেকে ফিরে ॥ কফির রাজ্য বলা হয় ব্রাজিলকে। ইউরোপের অনেক দেশে কফি হয়। এছাড়াও উৎপাদন এবং রফতানিতে ভিয়েতনামের কফির সুনাম রয়েছে বিশ্বে। সেই কফি চাষ হচ্ছে বাংলাদেশে। গাছের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত শাখা-প্রশাখায় কফিফলে ভরপুর। অনেকেই কফি দেখতে ভিড় করছেন। যারা কফি চেনেন না তারা নানা নাম জুড়ে দিচ্ছেন, আর যারা কফিবাগান দেখেছেন তাদের মনে হচ্ছে এক টুকরো কফির রাজ্য ব্রাজিল বা ভিয়েতনাম। টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলায় এই কফি চাষ হচ্ছে। মধুপুরসহ দেশের কয়েকস্থানে শখের বশে বা বাণিজ্যিক চাষাবাদ করছেন কফির। আর চাষাবাদে সফলও হচ্ছেন। তাতে দেশের মাটিতে কফি চাষে দেখা গেছে বিরাট সম্ভাবনা। কৃষকের আগ্রহ কাজে লাগিয়ে কফি চাষেও বিপ্লব ঘটে যেতে পারে। দেশের চাহিদা মেটাতে বিদেশ থেকে আর আমদানি করতে হবে না। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকেও নানা উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে প্রতিবছর ৫৫ হাজার কেজি কফি উৎপাদনের বিপরীত চাহিদা রয়েছে কয়েকগুণ বেশি। প্রতিবছর ১ হাজার টন আমদানিও করতে হচ্ছে বলে জানা গেছে। দেশে কফি চাষ বাড়লে আমদানি কমার পাশাপাশি কর্মসংস্থানও বাড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। সরেজমিনে এক টুকরো কফির রাজ্য মধুপুরে দেখা গেছে, কফির জন্য উর্বর, উপযুক্ত হওয়ায় দেশের মাটিতে ফলনও ভাল। ফলে ফলে ভরপুর প্রতিটি গাছ। মধুপুরে মহিষমাড়া গ্রামে নিজের বাড়ির পেছনে কফির বাগানটি করেছেন সানোয়ার হোসেন (৫০)। ১৯৯২ সালে বিএ পাস করার পর চারবছর সিলেটের একটি হাইস্কুলে ইংরেজীতে শিক্ষকতা করেন। পরে শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে বাবার কৃষিতে হাত লাগাতে ফেরেন মধুপুরে আর সফলও তিনি। কফিসহ কমপক্ষে ১০ ধরনের ফলের চাষাবাদ হচ্ছে তার বাগানে। নিরাপদ ফল উৎপাদনে এলাকার মানুষের কাছে তিনি আদর্শ। অনেকেই প্রতিদিন আসেন কফি বাগান দেখতে। কেউ আসেন বিভিন্ন চাষাবাদের পরামর্শ নিতে। সরেজমিনে দেখা গেছে, সানোয়ার হোসেনের ৫০০টি কফি গাছ রয়েছে। প্রতিটি গাছের গোড়া থেকে প্রত্যেক শাখা-প্রশাখা ফলে ভরপুর। কিছু কিছু পাকতেও শুরু করেছে। কফির পাশাপাশি ২৮০টি ড্রাগন পিলার, ১৯টি সৌদি খেজুর, ৫শ’ পেঁপে, এক হাজার মাল্টা, ৫শ’ লেবু, আনারস, ওষুুধি, কলা, জাম্বুরা গাছে ভরপুর তার বাগান। এরমধ্যে সম্প্রতি সাড়া জাগানোর কারণে প্রতিদিন অনেক মানুষ আসেন নতুন ফল কফি দেখতে। সানোয়ার হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, চা-কফি খাওয়ার নেশা থেকে এই কফি চারা লাগাই। রায়খালী বান্দরবান পাহাড়ী কৃষি গবেষণা কেন্দ্র থেকে ২০১৭ সালে ২০০ চারা কিনে আনি। দুই বছর পর গতবছর কিছু ফল আসে। আর এ বছর প্রচুর ফল এসেছে যা দেখে আমি সত্যি মুগ্ধ। তিনি গতবছরের অভিজ্ঞতায় বলেন, প্রতিগাছে ২ কেজির মতো ফল এলেও শুকিয়ে প্রায় ২৫০ গ্রাম পাওয়া যায়। ছোট ছোট গোল গোল সবুজ লাল কফিতে ভরপুর তার বাগান। সবুজ কফিগুলো পেকে লাল। এর পর কালো হচ্ছে। জানা গেছে, এগুলো নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় শুকালে কফির বিন পাওয়া যায়। পরে মেশিনে গুঁড়া করা হয়। বাগানে দুই জাতের কফি চাষ হচ্ছে। এক রোভাস্টা এবং এ্যারাবিকা। জানা গেছে, কফি চাষে খরচও কম। পাঁচ শ’ কফিতে সানোয়ার হোসেনের খরচ সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা। শুধু আগাছা পরিষ্কার এবং ছত্রাকনাশক দিতে হয়। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমি ভিয়েতনামে অসংখ্য কফির বাগান দেখেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে ভিয়েতনামের চেয়ে আমাদের বাগানে ফল উৎপাদন বেশি। তাহলে কেন আমি বাইরের চারা নিতে যাব? তিনি বলেন, দেশের যে কোন হর্টিকালচার সেন্টার কফির চারা করতে পারবে। আমাদের দেশের কৃষি অনেক উন্নত। ছয়মাসের মধ্যেই কফির চারা তৈরি করা যায় বলেও জানান তিনি। এক সময়ের ইংরেজীর শিক্ষক সানোয়ার এখন সফল কৃষক। নতুন নতুন চাষাবাদে তার আগ্রহও বেশি। ইতোমধ্যেই ১৫ একর জমিতে চাষ হচ্ছে হরেক রকমের ফল। বছরে শুধু কৃষিতে চাষাবাদে আয় হচ্ছে ৭ লাখ টাকার ওপর। কেউ কোন পরামর্শ চাইলে হাসিমুখে দিয়ে থাকেন। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, মধুপুরে দুই ব্যক্তি কফি করছেন। তার মধ্যে সানোয়ার হোসেনের বেশি কফি গাছ রয়েছে। নতুন নতুন ফসলে তার অনেক আগ্রহ। অনেকদিন লেগেছে। এখন সফলতা পাচ্ছে। গতবারও ভাল কফি এসেছিল। এবছর প্রচুর পরিমাণে কফি এসেছে। এই কর্মকর্তা বলেন, কফির রোগবালাই বেশি হয়। ‘কফিরাস্ট’ নামে একটি রোগ কফির প্রধান শত্রু। এটি রোধ করে এগিয়ে যেতে হবে। এশিয়া, ইউরোপের অনেক দেশে এই রোগের কারণে কফি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কৃষকদের প্রযুক্তিগত সহায়তা দিলে কফির এক বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে আমাদের দেশে। চারা সরবরাহ, প্রাথমিক ট্রেনিংÑ যদি শেখাতে পারি তবে অনেক কৃষক যেমন আকৃষ্ট হবে তেমনি সফলও হবে। মধুপুরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা এরশাদ আলী বলেন, যেহেতু এটি দেশের জন্য একটি নতুন ফসল। তাই আমাদেরও এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ জরুরী; যাতে কৃষককে সঠিক পরামর্শ সেবা দেয়া যায়। জানা গেছে, চলতি মাসের ১৮ তারিখ সানোয়ারের কফি বাগান দেখে মুগ্ধ ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মোঃ কামরুল হাসান। এটি দেশের জন্য সম্ভাবনাময় বলেও জানিয়েছেন। জানা গেছে, টাঙ্গাইলের বাইরেও কিছু কিছু জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে কফি চাষ হচ্ছে- নীলফামারী, বান্দরবানের বিভিন্নস্থানে কেউ হাতেগোনা কয়েকটি চারাগাছ, কেউ আবার এক বা দু’শ’ চারাগাছ লাগিয়েছেন। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক জনকণ্ঠকে বলেন, ইতোমধ্যেই ‘নর্থ এন’ নামে একটি বেসরকারী কোম্পানি প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠান হয়েছে। প্রসেসিংয়ে কোন সমস্যা নেই। প্রতিষ্ঠানটি চাষিদের কাছ থেকে সরাসরি কফি কিনে আনেন। এছাড়া কফি কাঁচা হিসেবে বিদেশেও রফতানি করা যাবে। আমরা এর জন্য আরও উদ্যোগ নিচ্ছি এবং নেব। দেশের সম্ভাবনাময় বিষয়গুলোকে আমরা সামনে আনতে চাই। অপ্রচলিত ফসল জনপ্রিয় করতে চাই। সারাবছর ফল চাষ প্রকল্পের পরিচালক মেহেদী মাসুদ জনকণ্ঠকে বলেন, এটি ব্যাপক আকারে চাষ হয় না। কেউ কেউ বাড়িতে করছেন। হাতেগোনা কিছু চাষি একটু বেশি গাছ লাগিয়েছেন। নর্দান কফি হাউজ কৃষকদের কফি কিনছেন। এখন পর্যন্ত ১ হাজার টন আমদানি করতে হচ্ছে। আর আমাদের দেশে ৫৫ হাজার কেজি হচ্ছে মাত্র। এটি বিরাট সম্ভাবনা আমাদের দেশের জন্য।
×