ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কক্সবাজারের সব পুলিশকে একযোগে সরানোর ঘটনা বিরল

প্রকাশিত: ২২:৫৯, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০

কক্সবাজারের সব পুলিশকে একযোগে সরানোর ঘটনা বিরল

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ টেকনাফের বাহারছড়ায় পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এক মেজর খুন হওয়ার ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এ ঘটনা নিয়ে ইতোমধ্যে মামলা, গ্রেফতার, টানা রিমান্ড, ক্রাইম সিন রিহার্সেলসহ দৃশ্যমান বহু ঘটনা জন্ম নিয়েছে। শেষ পর্যন্ত কক্সবাজার জেলার পুলিশের সকল সদস্যকে বদলি করে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে গত কয়েকদিন ধরে। প্রথমে রেঞ্জ ডিআইজি, এরপর এসপি এবং পরবর্তীতে এডিশনাল এসপি, এএসপি এবং আরও পরে ইন্সপেক্টর থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত মিলে প্রায় ১৪০০ পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আইজিপি বেনজীর আহমেদ প্রত্যাহারকৃত সকল ইন্সপেক্টরদের নতুন কর্মস্থলে যোগদানপূর্ব ব্রিফিং করবেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। একটি জেলা থেকে কয়েক দফা মিলে এসপি থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত একযোগে পুলিশের সকল সদসের বদলি করে দেয়ার ঘটনা দেশে এই প্রথম। গত ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফের বাহারছড়ায় এপিবিএন নিয়ন্ত্রিত একটি তল্লাশি চৌকিতে একজন পুলিশ ইন্সপেক্টরের গুলিতে মারা যান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এ ঘটনা বিদ্যুতগতিতে সারাদেশে জানাজানি হওয়ার পর বিভিন্ন মহলে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। যার ফলে সেনা প্রধান ও পুলিশ প্রধান একসঙ্গে ঢাকা থেকে কক্সবাজার গিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে প্রেস ব্রিফিং করেন। তারা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন, ঘটনা নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং এ নিয়ে যে কোন ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি কঠোর হস্তে দমন করা হবে। ঘটনা প্রবাহে ইতোমধ্যে সিনহা হত্যাকা- নিয়ে মামলা দায়ের হয়েছে। এ মামলায় এ পর্যন্ত ৮ পুলিশসহ ১৪ জন গ্রেফতার হয়েছে। যারমধ্যে টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ অন্যতম। এছাড়া গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ওসি প্রদীপ ছাড়া সকলেই হত্যাকা- নিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। এছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটিও তাদের রিপোর্ট পেশ করেছে। আসামিদের জবানবন্দী এবং তদন্ত কমিটির রিপোর্ট এখনও জনসম্মুখে প্রকাশ পায়নি। এরপরও বিভিন্নভাবে জানা গেছে, হত্যাকা- নিয়ে তদন্তে এবং তদন্ত কমিটির রিপোর্টে পুলিশী কার্যক্রমে ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা ধরনের ব্যত্যয়ের ঘটনা উঠে এসেছে। কক্সবাজার জেলার মধ্যে বিশেষ করে টেকনাফ এলাকায় পুলিশী কার্যক্রম সবচেয়ে বেশি সমালোচনার মুখে পড়ে। বিশেষ করে তৎকালীন ওসি প্রদীপের ২২ মাসের পুলিশিং কার্যক্রমে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা, মিয়ানমার থেকে মাদক ইয়াবার চালান আসা এবং সমুদ্র পথে মানব পাচারের ঘটনা চরম সমালোচনার মুখে পড়ে। অব্যাহতভাবে এসব ঘটনা চলে আসলেও সিনহা হত্যাকা-ের পর সোশ্যাল মিডিয়া ও মেইন স্ট্রিমের গণমাধ্যমে সীমান্ত সংলগ্ন থানা উখিয়া, টেকনাফে পুলিশ ও অন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রম মারাত্মকভাবে সমালোচিত হতে থাকে। এ অবস্থায় ঘটনার প্রায় দুইমাসের মাথায় এসে জেলার এসপি থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত সকলকে প্রত্যাহার করে অন্যত্র পোস্টিং দেয়ার ঘটনা ঘটে। পুলিশ সদর দফতরের পক্ষে এ ধরনের গণবদলি রুটিন বদলি হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেও এর নেপথ্যের কারণ কারও না বুঝার অবকাশ নেই যে, অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যার পর এ ঘটনা এবং জেলার পুলিশিং কার্যক্রম নিয়ে যেসকল চিত্র উঠে এসেছে তা নিয়ে পুলিশে গণবদলির এ ঘটনা ঘটল। এর আগে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুককেও অন্যত্র বদলি করে দেয়া হয়। মূলত রেঞ্জ ডিআইজির নিয়ন্ত্রণে বৃহত্তর চট্টগ্রামে পুলিশী কার্যক্রম চলে থাকে। এখন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে একটি জেলায় পুলিশের সকল সদস্যকে একযোগে বদলি অর্থাৎ গণবদলির ঘটনা উক্ত এলাকায় বৃহত্তর কোন সুফল বয়ে আনবে কিনা? নতুন যাদের কক্সবাজার জেলায় পোস্টিং দেয়া হয়েছে তারা অতীতে কক্সবাজারতো দূরের কথা চট্টগ্রাম বেল্টেও কাজ করেননি। এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠেছে, বিশে^র বৃহত্তম সাগর সৈকত কক্সবাজারে বছরে প্রায় কোটি পর্যটকের আনাগোনা এ কক্সবাজারে। বিশে^র বৃহত্তম শরণার্থী শিবির কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে। এ কক্সবাজার বেল্টে রয়েছে সেনাবাহিনীর একটি ক্যান্টনমেন্ট, রয়েছে বিজিবির ৩টি ব্যাটালিয়ন। কক্সবাজার লাগোয়া মহেশখালীর দ্বীপে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক বিনিয়োগের যে কার্যক্রম চলছে তন্মধ্যে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ অন্যতম। এছাড়া রয়েছে এলএনজি প্রজেক্ট, কয়লা তাপ বিদ্যুত প্রকল্প ইত্যাদি। এ মহেশখালীতে সোশ্যাল অব ক্রাইম সবচেয়ে বেশি। এসব ছাড়াও কক্সবাজার অঞ্চল দিয়ে মাদক ও মানব পাচার বড় ধরনের একটি উদ্বেগ উৎকণ্ঠার বিষয় হয়ে আছে। সাড়ে ১২ লাখেরও বেশি আশ্রিত মিয়ানমারের বাসিন্দা রোহিঙ্গাদের নিয়ে বড় ধরনের মাথাব্যথা হয়ে আছে প্রশাসনের। এসব কিছুর সঙ্গে পুলিশিং কার্যক্রম জড়িত। যে কারণে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে যারা স্পেশালাইজড তারা নিশ্চিতভাবে সুফল বয়ে আনতে সক্ষম হবেন এ ধারণা বিভিন্ন মহলের। কক্সবাজার জেলা থেকে একযোগে প্রায় ১৪০০ পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করে বিভিন্ন রেঞ্জে পোস্টিং দেয়া হয়েছে। পুলিশসহ সরকারী চাকরিতে বদলি একটি রুটিন কার্যক্রম। কিন্তু গোটা কক্সবাজার অঞ্চল থেকে সব পুলিশকে একযোগে বদলি করার ঘটনা গোটা দেশে বিরল। এ ঘটনা কাক্সিক্ষত সুফল বয়ে আনবে কি আনবে না তা ভবিষ্যত বলে দেবে। তবে এক্ষেত্রে আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্য, পর্যটন শিল্প, মাদক ও মানব পাচার, জলদস্যুতা, বিদেশী বিনিয়োগে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় পুলিশের সংশ্লিষ্টতা সবচেয়ে বেশি। এ কারণেই বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে টেকনাফে সিনহা হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুলিশ সদর দফতর বড় একটি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে। এ জেলার আওতাধীন একেক থানার আইনশৃঙ্খলার পরিবেশ একেক ট্রেন্ডের। পুলিশী কার্যক্রম ভিন্ন ধাঁচের চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ধাপে ধাপে ডিআইজি থেকে শুরু করে একেবারে কনস্টেবল পর্যন্ত বদলি করে দেয়া হয়েছে। এখন নতুনদের অধিকাংশ যোগ দিয়েছেন। পুরনোদের মধ্যে কয়েকমাস আগে যোগ দিয়েছেন এমন কর্মকর্তাদেরও সরানো হয়েছে। প্রসঙ্গত, কক্সবাজার অঞ্চল থেকে ১ হাজার ৩৪৭ জনকে বদলি করে দেয়ার মধ্যে রয়েছে পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ৫১ পরিদর্শক, ১৩৯ উপপরিদর্শক, ৯২ সহকারী উপপরিদর্শক ও ১০০০ হাজার কনস্টেবল। বদলির এ ঘটনাটিকে কারও মতে শুদ্ধি অভিযান। আবার কারও মতে গণবদলি। যদিও পুলিশ সদর দফতর রুটিন বদলি হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। তারপরও এটি নিশ্চিত যে, টেকনাফে সিনহা হত্যাকা-, বন্দুকযুদ্ধে অসংখ্য প্রাণহানির ঘটনা, মানব ও মাদক পাচারের ঘটনা নিয়ে পুলিশের অনিয়ম, দুর্নীতি এবং ক্ষেত্রবিশেষে এসব অপকর্মের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে চরম সমালোচনার মুখে এমন গণবদলির ঘটনা ঘটেছে বলে প্রতীয়মান। মূলত, কক্সবাজার দেশের অন্য অঞ্চলের চেয়ে কিছুটা ব্যতিক্রম। এখানে সাগর, নদী, পাহাড় রয়েছে। রয়েছে মিয়ানমারের সঙ্গে স্থল, নদী ও সাগর সীমানা। এসবগুলোর সঙ্গে পুলিশী কার্যক্রম নিহিত। প্রায়শ জন্ম নেয় পুলিশী কার্যক্রমের সফলতা, ব্যর্থতাসহ বিভিন্ন চিত্র। পর্যটন নগরী হিসেবে কক্সবাজারের খ্যাতি যেমন রয়েছে, তেমনি এ জেলার সঙ্গে রয়েছে মিয়ানমার সীমান্ত। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা এ জেলার টেকনাফ ও উখিয়ায় এসে আশ্রয় গ্রহণ করার ঘটনা বিশ^ব্যাপী আলোচিত। আবার আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ৩৪ শিবিরে মিয়ানমারের বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অপতৎপরতা উদ্বেগজনক। এক্ষেত্রে পুলিশকে সর্বাগ্রে তৎপরতা চালাতে হয়। এছাড়া অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের নির্ধারিত কার্যক্রম চালিয়ে থাকে। সঙ্গত কারণে পর্যটন জেলা কক্সবাজারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষকসহ অন্য কার্যক্রম সুচারুরূপে পরিচালনার ক্ষেত্রে পুলিশী তৎপরতা অন্যতম একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে থাকে সর্বদা।
×