ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পুলিশে শুদ্ধি অভিযান

প্রকাশিত: ২২:৫৩, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০

পুলিশে শুদ্ধি অভিযান

শংকর কুমার দে ॥ জনবান্ধব ও ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে তোলার পরিকল্পনা নিয়ে পুলিশ বাহিনীতে শুদ্ধি অভিযান শুরু করছে সরকার। শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে কক্সবাজার জেলায় একযোগে দেড় হাজার পুলিশকে বদলি ও দেড় হাজার পুলিশকে নিয়োগসহ তিন হাজার পুলিশের বদলি করার বিষয়টি প্রশংসার জোয়ারে ভাসছে। সারাদেশে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, মাদকাসক্ত, মাদক কারবারসহ বিভিন্ন ধরনের পুলিশ সদস্যদের তালিকা তৈরি করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পুলিশে কর্মরত মাদকাসক্তদের ডোপটেস্ট করার শুরুতেই ঢাকা মহানগর পুলিশে ২৬ জনের পজিটিভ পাওয়ার পর তাদের চাকরিচ্যুত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে পুলিশ প্রশাসন। মানবিক পুলিশ হিসেবে বিদেশের মডেলে ঢেলে সাজানো হচ্ছে পুলিশ বাহিনী। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এ খবর জানা গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রাণঘাতী করোনার সময়ে মানবিক পুলিশ হিসেবে সুনাম কুড়িয়ে উন্নত ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে পুলিশ বাহিনীর। কিন্তু কক্সবাজারে সেনাবাহিনীর মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকা-, কক্সবাজার জেলার মাদকের সঙ্গে এক শ্রেণীর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সম্পৃক্ততা, মাদক বা ইয়াবা কারবারের নামে ক্রসফায়ার বা বন্ধুকযুদ্ধের ঘটনাবলী ইমেজ সঙ্কটের মধ্যে ফেলে। কিন্তু কক্সবাজার জেলায় একযোগে তিন হাজার পুলিশকে বদলি ও নিয়োগ দানের মতো সাহসী পদক্ষেপের ঘটনাটি পুলিশ প্রশাসন তথা সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। ’৭১ সালে দেশের স্বাধীনতার পর বিগত ৪৯ বছরে দেশের কোন জেলায় একযোগে এত বিপুলসংখ্যক পুলিশকে বদলি ও নিয়োগদানের ঘটনাটি পুলিশ বাহিনীতে অপরাধে জড়িত পুলিশ সদস্যদের জন্য কঠোর বার্তা বলে মনে করা হচ্ছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, গত ৩১ জুলাই ঈদ-উল-আজহার আগের রাতে কক্সবাজারের মেরিনড্রাইভ রোডে পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে হত্যাকা-ের পর পুলিশের ভাবমূর্তি উদ্ধারের প্রয়োজন দেখা দিলে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ দাশ, পরিদর্শক লিয়াকতসহ ১১ জনকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। মামলা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই একযোগে এত ব্যাপক সংখ্যক পুলিশের বদলি ও নিয়োগ দেয়ার ঘটনাটি পুলিশ বাহিনীতে একটি মাইল ফলক হিসেবে দেখা হচ্ছে। পুলিশ বাহিনীর অনেক সুনাম, অনেক অর্জন এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গঠিত এই বাহিনীটি দেশের মানুষের জানমালের হেফাজত, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণসহ প্রাত্যহিক অনেকগুলো দায়িত্ব পালন করে। পুলিশের মূলমন্ত্র যেটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন, তা হচ্ছে- পুলিশ হবে জনগণের বন্ধু। কিন্তু বাস্তবতা হলো কিছু কিছু ক্ষেত্রে দু’একজন পুলিশ কর্মকর্তার দুর্নীতি, অনিয়ম এবং অপকর্মের কারণে পুলিশের ভাবমূর্তি সঙ্কটের মধ্যে পড়ে। এর সর্বশেষ উদাহরণ হলো ওসি প্রদীপসহ টেকনাফে কর্তব্যরত যে সকল পুলিশ ছিলেন তারা। এই রকম ঘটনার ফলে পুলিশের যে অর্জন, সততা, নিষ্ঠা তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। আর এই কারণেই পুলিশের নবনিযুক্ত আইজি বেনজীর আহমেদ পুলিশে শুদ্ধি অভিযানের উদ্যোগ শুরু করেছেন বলে জানা গেছে। পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, করোনাভাইরাসের সময়ে জীবন বাজি রেখে মানুষজনের পাশে দাঁড়িয়ে সেবা করেছে পুলিশ সদস্যরা। এতে অনেক পুলিশ সদস্য প্রাণ দিয়েছেন, আক্রান্ত হয়েছেন। তারপরও পুলিশ মানবিক সেবা থেকে পিছু হঠেনি। তখন সবাই পুলিশের প্রশংসা করেছে। এখন কক্সবাজারে সৃষ্ট সেই সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টার মধ্য দিয়ে পুলিশ বাহিনীকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। কক্সবাজার জেলায় কনস্টেবল থেকে শুরু করে পুলিশ সুপার পদ পর্যন্ত মোট ১ হাজার ৪৮৭ জনকে বদলি ও বদলি হওয়া শূন্য পদে ১ হাজার ৫০৭ জন পুলিশকে যুক্ত করাসহ ৩ হাজার পুলিশের বদলি ও নিয়োগের ঘটনাটি খুবই তাৎপর্য বলে মনে করেন পুলিশ কর্মকর্তারা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, কক্সবাজার বদলি ও নিয়োগের ঘটনায় মাদকের কোন সিন্ডিকেট থাকলে আমরা তা ভেঙ্গে দেবো। কক্সবাজারে নতুন করে কোন অবৈধ সিন্ডিকেট যাতে দাঁড়াতে না পারে আমরা সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছি। মেজর সিনহা হত্যাকা-ের ঘটনায় মামলা হয়েছে, তদন্ত চলছে, একটি তদন্ত কমিটি রিপোর্টও দিয়েছে। কক্সবাজারের সব মানুষের আস্থা, বিশ্বাস, নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা নিয়ে কাজ করে দেশজুড়ে পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার একটি প্রয়াস হিসেবে ধরা যাবে। পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশনা অনুযায়ী সারাদেশে অসৎ, দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, মাদকাসক্ত ও মাদক কারবারের সঙ্গে যুক্তসহ নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত পুলিশ সদস্যদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। পুলিশ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ৯৫ থেকে ৯৭ ভাগই সৎ এবং নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। বিশেষ করে গত ১০ বছরে পুলিশে নিয়োগের ক্ষেত্রে একটা স্বচ্ছতা তৈরি হয়েছে। এটি দুর্নীতির উৎস বন্ধের অন্যতম একটি ধাপ। পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ পুলিশ সদর দফতরে পুলিশের প্রতিটি ইউনিট প্রধানের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে বিশেষ এক ঘোষণায় বলেছেন, পুলিশ বাহিনীতে চাকরি করে রাতারাতি কাড়ি কাড়ি টাকার মালিক হবেন বলে যারা ভাবছেন বা সেই লক্ষ্য নিয়ে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন, তাদের পুলিশ বাহিনীতে জায়গা নেই। তারা ইচ্ছে করলে পুলিশের চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করতে পারেন। কক্সবাজারের সেনা কর্মকর্তা হত্যাকা-ের পর কোন ব্যক্তির দায় প্রতিষ্ঠান নেবে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন আইজিপি। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোহাঃ শফিকুল ইসলাম বলেছেন, যেসব পুলিশ সদস্য মাদকের সঙ্গে জড়িত থাকবে তাদের চাকরিচ্যুত করা হবে। পুলিশ বাহিনীতে ডোপ টেস্ট চালু করেছেন তিনি। ডোপটেস্টের প্রথমদিনেই ২৬ জনের পজিটিভ রিপোর্ট এসেছে। তাদের চাকরিচ্যুত করার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। এছাড়াও নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি বাণিজ্যের সঙ্গে কোন পুলিশ সদস্য জড়িত থাকলে তার শাস্তি নিশ্চিত। এক্ষেত্রে কোন ডাক দোহাই মানা হবে না। যেসব পুলিশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন, ক্ষমতার অপব্যবহার করার প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে। পুলিশ প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে পুলিশ বিভাগে শুরু হয়েছে শুদ্ধি অভিযান। বিভাগীয় মামলায় যেসব পুলিশ সদস্য দোষী সাব্যস্ত হবেন তাদের আইনী প্রক্রিয়ায় চাকরিচ্যুত করা হবে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর দফতরে সম্প্রতি জমা দেয়া দুটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২৯টি জেলার দেড় শতাধিক পুলিশ সদস্য মামলায় আসামি দেখিয়ে আটকের পর ঘুষের বিনিময়ে ২৫২ জনকে ছেড়ে দেন। আটক এবং ছেড়ে দেয়াদের মধ্যে রয়েছে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী, সন্ত্রাসী, চোর, ডাকাত ও জুয়াড়ি। একটি গোয়েন্দা সংস্থা ১৭৮ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে আটক বাণিজ্যের প্রতিবেদন পাঠায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এ তালিকায় নাম রয়েছে পুলিশ সুপার থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত। পুলিশে ডিআইজি, এসপি, এ্যাডিশনাল এসপি, সার্কেল এএসপি এবং বিভিন্ন থানার ওসিসহ পুলিশ সদস্যরা সরকারী আদেশ অমান্য করেছেন। এ ক্ষেত্রে পুলিশের বিরুদ্ধে সরকারী দলের এমপি ও নেতাদের অভিযোগও আমলে নেয়া হচ্ছে। এছাড়া বিগত সরকার ও চারদলীয় জোট সরকারের সময় দলীয় প্রভাব খাটিয়ে বিএসএস পরীক্ষায় পাস করিয়ে পুলিশের এএসপি পদে চাকরি দেয়া হয়। সরকার ওইসব পুলিশ কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করছে। একইসঙ্গে যে পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রয়েছে তা দ্রুত নিষ্পত্তি করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ারও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। পুলিশের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে যে, পুলিশের বর্তমান আইজি বেনজীর আহমেদ এটি চিরতরে অবসানের জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন। পুলিশের আইজি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তিনি বলেছিলেন, তিনি কলঙ্কমুক্ত পুলিশ বাহিনী করতে চান এবং পুলিশকে জনগণের বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে চান। সারাদেশে যারা এই ধরনের অপকর্ম করছে, জনগণকে সেবা দেয়ার বদলে যারা জনগণকে জিম্মি করছে, যারা বিভিন্ন দুর্নীতি এবং স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে জনগণকে ভোগান্তির মধ্যে ফেলছেন, তাদের তালিকা তৈরি করা হবে। এই শুদ্ধি অভিযানের একটি নীতিমালা ও পরিকাঠামো খুব শীঘ্রই তৈরি হবে। সারাদেশে দুর্নীতিবাজ পুলিশ অফিসারদের তালিকা তৈরি করা হবে। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থাসহ তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়া হবে।
×