ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

তৌফিক রহমান

পর্যটনের বিশ্ব মানচিত্রে নতুন পরিচয়

প্রকাশিত: ২০:৫৭, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০

পর্যটনের বিশ্ব মানচিত্রে নতুন পরিচয়

২৭শে সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস। সারা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও আড়ম্বরপূর্ণভাবে এই দিবসটি পালিত হচ্ছে। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার আহ্বানে ১৯৮০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। বিশ্ব পর্যটন দিবস প্রতি বছর একটি বিশেষ থীম সহকারে পালিত হয়। এ বছরের বিশ্ব পর্যটন দিবসের থীম হচ্ছে “ Tourism & Rural Development ” বাংলায় করলে এর অর্থ হচ্ছে “পর্যটন এবং গ্রামীণ উন্নয়ন ”। পর্যটনের দৃষ্টিকোণ থেকে এর যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। পর্যটনের মাধ্যমে গ্রামীণ উন্নয়ন এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিই পর্যটন শিল্পের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড বাংলাদেশের জন্যে পর্যটনের একটি আইকনিক ল্যান্ডমার্ক এবং ব্র্যান্ড নেম নির্বাচনের লক্ষ্যে বিজ্ঞাপন প্রচার করেছে। উৎসাহীদের তাঁদের মতামত প্রদানের জন্যে নির্ধারিত সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে এবং এর মাধ্যমে বিজয়ীদের পুরস্কৃতও করা হবে বলে জানানো হয়। এর আগে Beautiful Bangladesh নামে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং করা হলেও ওটি পর্যটন মহলে খুব বেশী সমাদৃত হয়নি। কারণ একটি দেশের পর্যটনের ব্র্যান্ডিং -এর পেছনে অনেকগুলো গল্প থাকতে হয়। এ্যামেজিং থাইল্যান্ড, ট্রুলি এশিয়া কিংবা ইনক্রিডেবল ইন্ডিয়ার পেছনে রয়েছে’ একদল পর্যটন বিশেষজ্ঞের দীর্ঘদিনের মেধা আর শ্রম। সাধারণতঃ শ্লোগান ও লোগো এমন হতে হয়, যেন ওটা দেখেই বোঝা যায়, ওই দেশটি তার কোন্ কোন্ পর্যটন পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রী করতে চাইছে। আমরা যদি অষ্ট্রেলিয়া, বৃটেন, ফ্রান্স, স্পেন, কিংবা থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর কিংবা মালদ্বীপ ইত্যাদি দেশের শ্লোগান ও লোগোর দিকে তাকাই, তাহলে কিছু না বললেও সহজে বুঝে নিতে পারবো ওই দেশগুলো তাঁদের কোন্ কোন্ পর্যটন পণ্য প্রমোট করতে চাইছে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে শ্লোগান আর লোগো দেখেও সহজেই বুঝে নেয়া যায় ওই দেশের প্রায়োরিটি পর্যটন পণ্য কোনগুলো। Everything under the Sun wKsev Mount Everest and more… বললে বুঝতে হবে বাকি থাকে না তাঁদের প্রধান প্রধান পর্যটন পণ্য কোনগুলো। ক্যাঙ্গারু, সমুদ্র আর উজ্জ্বল সূর্য দেখলেই বুঝতে বাকি থাকে না, ওটি হচ্ছে অষ্ট্রেলিয়ার লোগো। আর এসব কিছুই হচ্ছে একটি দেশের পর্যটন মার্কেটিং ও ষ্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং এর অংশ। আমাদের দেশের আইকনিক ল্যান্ডমার্ক কোনটি হতে পারে। প্রথমেই আসা যাক পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনের কথা। কিন্তু এক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে, সুন্দরবনের এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগারের একটা ভাগীদার ভারতও বটে। ফলে ওটি আমাদের একার সম্পত্তি নয়। সংসদ ভবনের নির্মাণশৈলী চমৎকার কিন্তু এরকম নির্মাণ কৌশল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে রয়েছে। আমাদের শহীদ মিনার ভাষা আন্দোলনের প্রতীক। এর ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং তাৎপর্যপূর্ণ কিন্তু স্থাপত্যকলার দিক দিয়ে এটি আইকনিক ল্যান্ডমার্ক হবার মত নয়। সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ কিংবা লালবাগ দূর্গ কিংবা আহসান মঞ্জিলের স্থাপত্যশৈলীও আশে-পাশের দেশের তুলনায় বিরল নয়। তাহলে বর্তমান পর্যটন বিশ্বে কি দিয়ে বাংলাদেশকে পরিচিত করানো যায়। আইকনিক ল্যান্ডমার্ক কিংবা ব্র্যান্ডিং - যাই বলি না কেনো, আমাদের এমন একটি হৃদয়গ্রাহী এবং স্পর্শকাতর ল্যান্ডমার্ক দরকার - যা মুহুর্তেই বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে পরিচয় করিয়ে দেবে। কিন্তু তা যে কোনো স্থাপত্য কিংবা বনভুমি কিংবা সমুদ্র সৈকত হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। দীর্ঘদিনের পর্যটন শিল্পের মাঠ পর্যায়ের কর্মী হিসেবে আমার কাছে মনে হয়েছে, বাংলাদেশকে খুব সহজেই পর্যটন বিশ্বে পরিচয় ঘটানোর এ মুহুর্তে একমাত্র আইকনিক ল্যান্ডমার্ক এবং ব্র্যান্ডিং হতে পারে স্বাধীনতার মহান স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর হাস্যাজ্বল মুখাবয়ব- যা বাঙালীর আতিথেয়তার পরিচয়ও বহন করে। কেন এটিকে আইকনিক ল্যান্ডমার্ক ও ব্র্যান্ডিং করতে বললাম, তাঁর পেছনে যুক্তিও রয়েছে প্রচুর। প্রথমতঃ ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে আমাদের মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের তিনি একজন অবিসংবাদিত নেতা। তাঁর নেতৃত্বেই মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিলো। দ্বিতীয়তঃ বিবিসির জরীপে তিনিই হচ্ছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী -যা বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় আসীন করেছে। তৃতীয়তঃ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বর্তমানে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্মারকরুপে চিহ্নিত হয়েছে। চতুর্থতঃ বঙ্গবন্ধু যাদুঘর, রেসকোর্স ময়দান, টুঙ্গীপাড়ার বঙ্গবন্ধুর সমাধি -এসব কিছুই বর্তমানে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের কাছে একটি আবশ্যিক দর্শনীয় স্থান। পঞ্চমতঃ ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের ফসল আমাদের বাংলা ভাষা- যা বর্তমানে ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং বাংলা ভাষা বর্তমানে জাতিসংঘেরও স্বীকৃত ভাষা এবং ষষ্ঠতঃ এই সেই বাংলা ভাষা, যে ভাষায় আমাদের বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে জাতিসংঘে সর্বপ্রথম বাংলায় ভাষণ দিয়ে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়ার নজর কেড়ে ছিলেন। ফলে সকল দিক এবং পর্যটনের দৃষ্টিকোণ বিবেচনায় এ মুহুর্তে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ এবং তাঁর হাস্যোজ্জল মুখাবয়বই হতে পারে বাংলাদেশের নতুন আইকনিক ল্যান্ডমার্ক এবং ব্র্যান্ডিং। প্রশ্ন উঠতে পারে, একটি দেশের পর্যটনের আইকন এবং ব্র্যান্ডিং কি কোনো ব্যক্তি বিশেষের নামে কিংবা ইতিমধ্যে হওয়ার কোনো নজির কি ইতিহাসে আছে। সহজ উত্তর হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু কখনোই সাধারণ কোনো ব্যক্তি নন। তিনি তার সম্মোহনী বক্তৃতা এবং নেতৃত্ব দিয়ে একটি সামরিক শক্তি সম্পন্ন মহাপরাক্রমশালী দেশের বিরুদ্ধে অত্যন্ত স্বল্পসময়ে আমাদের স্বাধীনতা উপহার দিয়েছেন -যা ইতিহাসে বিরল। দুই, তদানীন্তন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী এবং ফ্যাসিষ্ট আচরণের বিরুদ্ধেই কিন্তু একজন নেলসন ম্যান্ডেলার জন্ম হয়েছিলো -যিনি পরবর্তীকালে তাঁর নিজ দেশকে ছাপিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে দক্ষিণ আফ্রিকার একজন আইকন এবং প্রকারান্তরে ব্র্যান্ড হয়ে উঠেছিলেন। তিন, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের দক্ষ নেতৃতে¦র কল্যাণেই মালয়েশিয়া বর্তমানে হয়ে উঠেছে বিশ্বপর্যটনের একটি পরাক্রমশালী দেশ। অনেকের কাছেই মালয়েশিয়া এবং মাহাথির মোহাম্মদ সমার্থক। বাংলাদেশেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই ১৯৭২ সালে পর্যটনের গুরুত্ব অনুধাবন করেই বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নেলসন ম্যান্ডেলা ও মাহাথির মোহাম্মদ পরবর্তীতে তাঁদের নিজ নিজ দেশের আইকন ও ব্র্যান্ড ঠিকই হয়েছিলেন। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে একধাপ এগিয়ে বঙ্গবন্ধুকে পর্যটনের আইকনিক ল্যান্ডমার্ক ও ব্র্যান্ড করলে আমাদের কিন্তু কোনো ক্ষতি হবে না বরং পর্যটনের দৃষ্টিকোণ থেকে লাভবানই হবে বাংলাদেশ। বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর শততম বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানমালা চলছে এবং আগামী বছর আমাদের স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী পূর্ণ হবে। আর এমনই এক মাহেন্দ্রক্ষণে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশই হোক পর্যটনের বিশ্ব মানচিত্রে আমাদের নতুন পরিচয়। আর এতে করে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা আর সম্মাননা জানানোর পাশাপাশি দেশ আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ এবং বিদেশী পর্যটক আকর্ষণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। কারণ বঙ্গবন্ধুর চেয়ে আর বড় কোনো আইকনিক ল্যান্ডমার্ক এবং ব্র্যান্ডিং নির্বাচন বাংলাদেশে সম্ভব নয়। এবারের বিশ্ব পর্যটন দিবসে সরকারের পর্যটন মন্ত্রণালয় ও পর্যটন বোর্ডের কাছে বেসরকারী ষ্টেকহোল্ডারদের সম্মিলিত চাওয়া, পর্যটনের বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের নতুন পরিচয় হোক “ বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ ”।। লেখক: মহাসচিব, পাটা বাংলাদেশ চ্যাপ্টার [email protected]
×