ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

২৮ সেপ্টেম্বর- বাঙালীর পাখি দেখার দিন

প্রকাশিত: ২০:৫৫, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০

২৮ সেপ্টেম্বর- বাঙালীর পাখি দেখার দিন

‘একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে মুক্ত ও সম্মানজনক জীবন যাপনের অধিকার অর্জনের জন্য বাঙালী জাতি বহু শতাব্দী ধরে সংগ্রাম চালিয়ে এসেছে’- জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের পরে দেয়া বঙ্গবন্ধুর প্রথম ভাষণ থেকে এই উক্তি আজ তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার জন্মদিনে স্মরণ করছি। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর ডাকে ১৯৭১ সালে সমগ্র জাতি যখন সশস্ত্র যুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে আত্মোৎসর্গ করছে তখন এই ২৪ বছর বয়সী অন্তঃসত্ত্বা কন্যা স্বামী, মা-বোন ও ভাইদের সঙ্গে পাকিস্তানী সৈন্য বাহিনীর হাতে বন্দী ছিলেন। ধানম-ি ১৮ নং সড়কের (এখনকার ৯/এ) একটি স্যাঁতসেঁতে বাড়িতে (২৬ নং) তাদের ধরে এনে আটকে রাখা হয়। ২৫ মার্চ থেকে ১২ মে পর্যন্ত তাঁরা খিলগাঁও, মগবাজার এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে আত্মগোপনে ছিলেন। সঙ্গত কারণেই তাঁদের অবস্থান জানাজানি হয়ে যেত ও কোন কোন বাড়িওয়ালাদের অসহযোগিতায় তাঁদের বাসা ছেড়েও দিতে হতো। এরকম রুদ্ধশ্বাস ও অস্বস্তিকর অবস্থায় ১২ মে সন্ধ্যার দিকে এক পাকিস্তানী মেজরের নেতৃত্বে সেনা প্রহরায় তাঁদের সে বাড়িতে নিয়ে এসে বন্দী করা হয়। গেটের বাইরে ২০-২৫ জন সৈন্য পাহারায় রেখে দেয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু কন্যা যে বাড়িতে সকলের সঙ্গে বন্দী ছিলেন সে বাড়িটিতে কোন আসবাবপত্র এমনকি কোন ফ্যানও ছিল না। দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর হোসেনের কাছে অনুরোধ করেও সেসবের ব্যবস্থা করা যায়নি। পুরো বন্দী জীবন তাঁদের থাকতে হয়েছিল ঘরের মেঝেতে। দেয়া হয়েছিল একটিমাত্র কম্বল। ছোট দুই ভাই জামাল ও রাসেল, বোন রেহানা, স্বামী এম ওয়াজেদ মিয়া ও অসুস্থ মাকে নিয়ে সে কী এক দুর্বিসহ জীবন তাঁরা কাটিয়েছেন শেখ হাসিনার নানা কথোপকথনে ও ওয়াজেদ মিয়ার লিখে রাখা বর্ণনায় সেসবের বিবরণ পাওয়া যায়। শেখ হাসিনার মুখেই শুনেছি, একটি কেরোসিনের চুলোয় রান্না সীমিত খাবারের জন্য তাঁদের মা আধ পেট খেতে বলতেন, কারণ খাবার ফুরিয়ে গেলে কারফিউর মধ্যে জোগাড় করা কঠিন হবে। পাকিস্তানী সেনারা তো কোন সাহায্য করবে না। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে শেখ হাসিনাকে ডাক্তারের কাছে যেতে দিতে অনুমতি মিলে। বিশিষ্ট স্ত্রীরোগ চিকিৎসক-দম্পতি ডা এম এ ওয়াদুদ ও ডা সুফিয়া ওয়াদুদের পরামর্শ মেনে চলতেন শেখ হাসিনা। যে কেউ আজ অনুধাবন করবেন অন্তঃসত্ত্বা একজন বন্দী মায়ের কি সেসব পরামর্শ মেনে চলার কোন সুযোগ ছিল যারা প্রচ- গরমের সময় আধপেট খেয়ে মেঝেতে থাকতেন? ডা ওয়াদুদ স্নেহবশত কোন টাকা পয়সা নিতেন না বলে কিছুটা রক্ষা ছিল বটে কিন্তু আসন্ন সন্তানের পুষ্টি ও সুস্থতার জন্যে এই মায়ের বা তাঁর স্বামীর কী-ই বা করার ছিল? ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন, ‘জুন মাসের প্রথম থেকে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান বাহিনীর বিভিন্ন অবস্থান ও সরকারী ইলেক্ট্রিক সাব-স্টেশন, পুলিশ ফাঁড়ি, ইত্যাদি স্থানে আক্রমণ জোরদার করতে থাকে। জুন মাসের শেষের দিকে এই আক্রমণ তীব্র আকার ধারণ করে। যখনই বাইরে গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া যেত, প্রহরারত সুবেদার মেজর স্টেনগান হাতে ‘ডক্টর সাব, ডক্টর সাব’ বলতে বলতে আমার রুমে ঢুকত। সে সময়ে তারা আমাদের নানাভাবে হয়রানি ও মানসিকভাবে নির্যাতন করত। বাড়ির ছাদে উঠে লাফালাফি করত এবং লাইট জ্বালিয়ে রেখে ঘুমোতে দিত না। রাইফেলের মাথায় বেয়নেট লাগিয়ে কক্ষের জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকত।’ ভাবা যায়? এই গর্ভধারিণী মায়ের মন তখন কী স্বপ্নে বিভোর থাকার কথা! জুলাই মাসের মাঝামাঝি ডা ওয়াদুদের তত্ত্বাবধানে শেখ হাসিনা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। সন্তান প্রসবিনী মায়ের সঙ্গে আমাদের দেশের প্রচলিত সংস্কৃতি অনুযায়ী তাঁর মায়েরই থাকার কথা। বেগম মুজিব যেন তাঁর মেয়ের সঙ্গে হাসপাতালে থাকতে পারেন সে অনুমতি চাইলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর ইকবাল নামের একজন অত্যন্ত বাজে আচরণ করে। ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন, ‘মেজর ইকবাল নামক এক সামরিক কর্মকর্তা বাসায় এসে আমার শাশুড়ীকে রূঢ় ভাষায় বলেন, আপনি তো নার্স নন যে, হাসপাতালের কেবিনে আপনার মেয়ের সঙ্গে থাকা বা দেখাশোনা করার প্রয়োজন রয়েছে।’ এ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর ছোট বোন খাদিজা হোসেন লিলি (লিলি ফুফু, বাংলাদেশ সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব এ টি এম হোসেনের স্ত্রী) সারাক্ষণ শেখ হাসিনার সঙ্গে হাসপাতালে থাকতেন। ২৭ জুলাই রাত ৮টার দিকে নির্ধারিত সময়ের ছয় সপ্তাহ আগে শেখ হাসিনার প্রথম সন্তান জয়ের জন্ম হয়। গর্ভকালে এই শিশু মায়ের সঙ্গে মায়ের পেটেই বন্দী ছিল, ভূমিষ্ঠ হয়েও সে বন্দী, ‘মুক্ত জীবনের অধিকার’ এই সদ্যজাত শিশুরও ভাগ্যে ছিল না। দু-একজন আত্মীয় স্বজন এই শিশুকে দেখতে এলে পাকিস্তানী সৈন্যরা খারাপ ব্যবহার করত। একদিন শেখ হাসিনার লিলি ফুফু ছাড়া দেখতে আসা আর সকল আত্মীয়দের পাকিস্তানীরা ভয় দেখিয়ে কেবিন থেকে বের করে দেয়। তারা জানায় যে, তাদের কাছে সরকারী নির্দেশ রয়েছে এই কেবিনে একজনের বেশি সেবিকা থাকতে পারবে না। এমনকি ধানম-ির বন্দীশালায় গিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা বেগম মুজিবকে এই বলে হুমকি দিয়ে আসে যে, ‘আপনারা জয় বাংলা রেডিও শোনেন। এটা বন্ধ না করলে জামালকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে ঘরের সিলিং-এ পা বেঁধে ঝুলিয়ে পিটিয়ে তার পিঠের চামড়া উঠানো হবে।’ হাসপাতালে বড় বোনের কাছে যদি সদ্য মামা হওয়া এই ভাইয়ের জন্য আশঙ্কার খবর পৌঁছায়, তখন শেখ হাসিনার কেমন লেগেছিল আজকের দিনে যে কোন সংবেদনশীল মানুষেরই তা উপলব্ধি হবার কথা। এই শিশু সন্তান নিয়ে শেখ হাসিনা যখন ধানম-ির বন্দীগৃহে ফিরেন সে মেঝেতেই তাঁদের ঠাঁই হয় একটি মাত্র কম্বল বিছিয়ে। একদিন জরুরী চিকিৎসার প্রয়োজনে সন্তানের জন্য ডাক্তার ডাকা প্রয়োজন হলে সেনারা গেট থেকে আটকে দেয়। শুধু তাই-ই নয়, শেখ হাসিনার প্রসবোত্তর অতি-জরুরী চিকিৎসার জন্য (যাতে তাঁর জীবনাশঙ্কা হয়েছিল) কিছুতেই ডাক্তার ওয়াদুদকে আসতে দেয়া হয়নি। বাধ্য হয়ে ডাক্তার ব্যবস্থাপত্র লিখে দিলে তা নিয়ে কারফিউ শুরুর মাত্র কয়েক মিনিট আগে জরুরী ওষুধ পত্র কিনে এনে সে যাত্রায় রক্ষা হয়। এই ক্রমাগত বাধা আর অত্যাচারের যন্ত্রণা দায়িত্বশীল স্বামী হিসেবে, আদর্শ পিতা হিসেবে ওয়াজেদ মিয়াকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তখন বহন করতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু আগে থেকেই তাঁর পছন্দ বলে রেখেছিলেন যেন শেখ হাসিনা তাঁর ছেলে সন্তান হলে নাম রাখেন ‘জয়’ ও মেয়ে হলে ‘জয়া’। বন্দীশালায় সদ্যজাত ছেলে সন্তানের নাম যখন ‘জয়’ রাখা হলো তখন এ নিয়েও পাকিস্তানীরা প্রশ্ন তুলেছে। কটাক্ষ করে তারা বলতো, ‘পশ্চিম পাকিস্তানমে এক নমরুদকো পাকড়াও করকে রাখা হুয়া, লেকিন এধার এক কাফের পয়দা হুয়া।’ বঙ্গবন্ধুপুত্র শেখ জামাল একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে চলে যান। জামালের অনুপস্থিতি ও আজানা আশঙ্কার মধ্যে একদিন বাসায় কর্মরত এক তরুণ সদস্য ফরিদকে পাকিস্তানী সৈন্যরা ধরে নিয়ে নির্মম অত্যাচার করে। টুঙ্গিপাড়ায় বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দিলে বঙ্গবন্ধুর অসুস্থ বাবা মাকে ঢাকায় এনে আত্মীয় বাড়িতে রাখা হয়েছিল। অক্টোবরে ওয়াজেদ সাহেব নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েন ও চিকিৎসার জন্য ডাক্তারদের পরামর্শে তাঁকে তখনকার পি জি হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। একই সময়ে যুদ্ধ ঘনীভূত হলে ও ঢাকায় ক্রমাগত গেরিলা আক্রমণ শুরু হলে পাকিস্তানী বাহিনীর সতর্ক দৃষ্টি পড়ে বঙ্গবন্ধুর পরিবার ও পরিবারের সদস্যদের প্রতি। সেসব কঠোর পাহারার মধ্যে ধানম-ির বন্দীগৃহে বেগম মুজিব ও শেখ হাসিনাসহ অন্যরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের পরেও তাঁরা মুক্ত হতে পারেননি। বাড়ির পাহারা পাকিস্তানীরা ত্যাগ করেনি। মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে ওয়াজেদ সাহেব তাঁদের ১৮ ডিসেম্বর মুক্ত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। জেনারেল অরোরা নিজে এসে ১৮ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন। সে বাসায় কোন চেয়ার ছিল না বলে জেনারেল অরোরাকে কোথায় বসতে দেবেন তা ভেবে বেগম মুজিব খুব বিব্রতবোধ করছিলেন। (তথ্যসূত্র : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথোপকথন ও এম এ ওয়াজেদ মিয়ার বই ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ)’। এই যে একাত্তরের বন্দী জীবন সে জীবনেও শেখ হাসিনার একটি জন্মদিন ছিল, ২৮ সেপ্টেম্বর। জয়ের জন্মের মাত্র দুই মাস পরের কথা, শুনেছি আপার তা মনেও ছিল না। আমরা আজও জানি না বঙ্গবন্ধু কন্যার সে বন্দী দশা আদৌ মুক্ত হয়েছে কী না। কারণ, বঙ্গবন্ধুর উক্তি ‘একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে মুক্ত ও সম্মানজনক জীবন যাপনের অধিকার অর্জনের জন্য বাঙালী জাতি বহু শতাব্দী ধরে সংগ্রাম চালিয়ে এসেছে’; সেই সংগ্রামের হাল ধরে শেখ হাসিনা নিজে মুক্ত, স্বাধীন ও সম্মানজনক জীবন প্রতিষ্ঠার লড়াই করছেন ও নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁর মুক্তি কোথায়? যুদ্ধের দিনে অভাবে-অনটনে-কষ্টে-অপমানে জন্ম নেয়া একটি বন্দী শিশুর জন্য শেখ হাসিনার যে মাতৃত্ববোধ তা আজ সমগ্র জাতির কাছে ছড়িয়ে গেছে। তিনি যখন বলেন, ‘আত্মমর্যাদা অর্জন করেই বাঙালীকে বাঁচতে হবে, আমি দেশের মানুষের সে আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্যই লড়াই করছি’ তখন আমাদের মনে হয় এই সংগ্রাম কবে শেষ হবে? যদি শেষ হতো, একবার সবাই মিলে আপার জন্মদিনে টুঙ্গিপাড়া যেতাম, আপা বসে থাকতেন বঙ্গবন্ধুর শয়নের পাশে, আমরা একটি দূরের উঁচু ঢিবি থেকে দেখতাম পাখিগুলো ফিরে যাচ্ছে আপন মনে। শেখ হাসিনার জন্মদিনে আজ এই প্রার্থনা করি বাঙালীর জীবনে পাখি দেখার সেই দিন আসুক, আমরা তখন থাকি বা না থাকি। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম [email protected]
×