ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কর্ণফুলীকে বাঁচান

প্রকাশিত: ২০:৫০, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০

কর্ণফুলীকে বাঁচান

বুড়িগঙ্গা যেমন ঢাকা তথা রাজধানীর প্রাণপ্রবাহ, কর্ণফুলী ততোধিক চট্টগ্রাম ও দেশের অন্যতম জীবনীশক্তি। দেশের আমদানি-রফতানির সিংহভাগ অদ্যাবধি পরিচালিত হয়ে থাকে কর্ণফুলী নৌবন্দরের মাধ্যমে। সেই হিসেবে নদীটি দেশের অন্যতম অর্থনৈতিক চালিকাশক্তিও বটে। এর বাইরেও চট্টগ্রাম অন্যতম শিল্পনগরী ও বাণিজ্যবন্দর। সেই ¯্রােতস্বিনী-কল্লোলিনী-প্রাণোচ্ছল কর্ণফুলীই প্রায় মরতে বসেছে মানুষের নিরন্তর অত্যাচার-অনাদর-অবহেলাসহ প্রতিনিয়ত দখল-দূষণে। সোমবার চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে কর্ণফুলী সম্পর্কে যেসব তথ্য-উপাত্ত পরিবেশন করা হয়েছে, তা এককথায় উদ্বেগজনক এবং নদীটির অস্তিত্ব নিভিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। সংস্থাটি টানা ২২দিন ধরে কর্ণফুলীর ওপর নির্মিত শাহ আমানত ব্রিজ থেকে ফিরিঙ্গীবাজার পর্যন্ত নদীটির প্রস্থ জরিপ করেছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও চিটাগাং পোর্ট অথরিটি প্রণীত স্ট্র্যাটেজিক মাস্টার প্ল্যান, চিটাগাং পোর্টের জেনারেল ইনফরমেশন সিপিএ ল্যান্ড ইউজ ২০১৪ অনুযায়ী নদীটির প্রস্থ ধরে এই জরিপ করা হয়েছে। এ শীট অনুযায়ী আগে নদীটির প্রস্থ ছিল ৮৮৬ দশমিক ১৬ মিটার। বর্তমানে ভাটার সময় এর প্রস্থ পাওয়া গেছে মাত্র ৪১০ মিটার। জোয়ারের সময় যা সর্বোচ্চ ওঠে ৫১০ মিটার পর্যন্ত। ভরাট হয়ে যাওয়া অংশে আদৌ কোন নৌযান চলাচল করতে পারে না। ফলে শাহ আমানত সেতুর মাঝ পিলারের পাশে যাত্রী পারাপারে একটি ঘাট তৈরি করেছে স্থানীয়রা। হুমকির মুখে পড়েছে সেতুটির পিলারও। এর বাইরেও নদী রক্ষা কমিশন ও জেলা প্রশাসনের জরিপ সিএস রেকর্ড অনুযায়ী কর্ণফুলীর তীরে অবৈধ স্থাপনা রয়েছে ২ হাজার ১১২টিÑ ব্যক্তি, বেসরকারী সংস্থা ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। ফলে নিয়মিত দখল-দূষণ ও পলিমাটি জমে কর্ণফুলী নাব্য হারিয়েছে অনেক আগেই। বড় জাহাজ এখন আর ভিড়তে পারে না। লাইটারেজ জাহাজ দিয়ে খালাস করতে হয় মালামাল। যে কারণে খরচ অনেক বেশি পড়ে। এর বাইরেও চট্টগ্রাম শহরের একটি বড় সমস্যা জলাবদ্ধতা। চাকতাইসহ খালগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় এটা ঘটে প্রতিবছর নিয়মিত। জোয়ারের সময় প্রায়ই প্লাবিত হয় পাইকারি পণ্যের বাজার খাতুনগঞ্জ। মুমূর্ষু নদীটির জীবনরক্ষায় ড্রেজিংয়েও কাজ হচ্ছে না বর্তমানে। ইতোমধ্যে সরকার চট্টগ্রামের কর্ণফুলীসহ রাজধানীর চারপাশের নদ-নদী সর্বোপরি দেশের সব নদী ও শাখা নদীকে দখল-দূষণমুক্ত করে সারা বছর ধরে নাব্য রাখার জন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান তথা মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এতে একদিকে যেমন নদীমাতৃক বাংলাদেশের আবহমান চিরায়ত প্রকৃতি ও রূপ ফিরে আসবে, তেমনি নৌযান চলাচলের মাধ্যমে ব্যবসাবাণিজ্য সম্প্রসারণসহ মানুষের যাতায়াতের পথ সহজ, সুগম ও সুলভ হবে। প্রাথমিকভাবে এর জন্য সময়সীমা ধরা হয়েছে ১০ বছর, যা প্রয়োজনে বাড়তে পারে। উল্লেখ্য, লন্ডনের বিখ্যাত টেমস নদীও এক সময় গার্বেজ ডাম্পিং সেন্টার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল এর নাব্যাবস্থা। সেই টেমসকে বর্তমান নাব্য ও পূর্বাবস্থায় ফেরাতে সময় লেগেছে ৫০-৫৫ বছর। বর্তমান সরকার যে দেশের নদ-নদীকে সারা বছর ধরে নাব্য, দখল ও দূষণমুক্ত রাখতে সচেষ্ট ও আন্তরিক তা ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে। তুরাগ, বুড়িগঙ্গা, বালু ও শীতলক্ষ্যায় প্রায় নিয়মিতই চলছে উচ্ছেদ অভিযান। অনুরূপ চালাতে হবে কর্ণফুলীতেও। নদী দখল ও দূষণ প্রতিরোধে সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছে। সারাদেশে নদীর নাব্য ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য দুই হাজার ৩৬৮ কিলোমিটার নৌপথ উদ্ধারে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ২০১২ সালে একনেক কর্তৃক অনুমোদিত ১১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। ৫৩টি নৌরুটের ১২ হাজার নৌপথ খননের প্রথম পর্যায় ২৪টি এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ২৯টি নদী খননের পরিকল্পনা রয়েছে। এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে নৌপথ সচলের পাশাপাশি সারা বছর নদীর নাব্য রক্ষাসহ সেচ সুবিধা ও চাষাবাদ অপেক্ষাকৃত সহজ ও সম্প্রসারিত হবে নিঃসন্দেহে। ইলিশসহ মাছের উৎপাদনও বাড়বে।
×