ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যবসায় আত্মবিশ্বাস ফেরাতে পারে মানসম্মত আর্থিক রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১৭:০৭, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০

ব্যবসায় আত্মবিশ্বাস ফেরাতে পারে মানসম্মত আর্থিক রিপোর্ট

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বিনিয়োগ আকর্ষন এবং ব্যবসায় আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে মানসম্মত ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন এ খাতের বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্ট অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করতে পারে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কারণে আগামী ১০ বছরের মধ্যে আইওটি এবং মেশিন লার্নিং ব্যবস্থা আরো সহজলভ্য হলে, আমাদের প্রথাগত অডিট রিপোর্টের ব্যবস্থাকে যুগোপোযোগী করতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পানা গ্রহণ করতে হবে। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট ২০১৫ : ব্যবসায়িক কর্মকান্ডে-এর প্রভাব’ শীর্ষক ওয়েবিনার শনিবার (২৬ সেপ্টেম্বর) অনুষ্ঠিত হয়। আয়োজিত এ ওয়েবিনারে বাংলাদেশের মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মোসলেম চৌধুরী প্রধান অতিথি এবং বাংলাদেশ ব্যাংক-এর পরিচালক আফতাব-উল ইসলাম সম্মানিত অতিথি হিসেবে যোগদান করেন। স্বাগত বক্তব্যে ডিসিসিআই সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, মানসম্মত অডিট রিপোর্ট প্রস্তুতকরন ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেটি দেশের ব্যাংকিংখাতের খেলাপী ঋণ চিহ্নিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তিনি উল্লেখ করেন, আমাদের পুঁজিবাজারে এখনও কাঙ্খিত উন্নয়ন হয়নি, এছাড়াও দেশের জিডিপিতে পুঁজিবাজারের অবদান সারা পৃথিবীর অন্যান্য দেশসমূহের মধ্যে সবচেয়ে কম, এ অবস্থা উন্নয়নে লিস্টেট ও নন-লিস্টেট কোম্পানীসমূহের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্ট অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করতে পারে। ঢাকা চেম্বারের সভাপতি বলেন, বিশেষকরে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষনের জন্য বহুজাতিক কোম্পানীসমূহকে ‘ইন্টারন্যাশনাল একাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ডস বোর্ড’-এর আওতায় আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুসরণ করতে হয় এবং ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরো বলেন, দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারী উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন প্রাপ্তি নিশ্চিতকরনের জন্য ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং-এর গাইডলাইন আরো সহজীকরন এবং ব্যবহার বান্ধব করা প্রয়োজন। প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশের মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মোসলেম চৌধুরী বলেন, আমাদের ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং আইন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিষয়াদির পাশাপাশি জনস্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোও বিবেচনা করে থাকে। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এবং অন্যান্য সংস্থার সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে এ কাউন্সিলের কার্যক্রম আরো সম্প্রসারণ ও দৃশ্যমান করার উপর জোরারোপ করেন। তিনি বলেন, ‘ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডর্ড (আইআরএফএস)’ অনুসরণের ক্ষেত্রে আমাদের আবশ্যই নিজেদের সক্ষমাকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং আমাদের এসএমই খাত এখনও আইআরএফএস-এর গাইড লাইন অনুসরনের জন্য প্রস্তুত হতে পারেনি, তাই এ বিষয়টি নিয়ে সকলেরই যত্নবান হতে হবে। তিনি ফাইন্যান্সিয়াল কাউন্সিল এবং এখাতে প্রফেশনালদের মধ্যে সমন্বয় আরো বাড়নোর প্রয়োজন। তিনি বলেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কারণে আগামী ১০ বছরের মধ্যে আইওটি এবং মেশিন লার্নিং ব্যবস্থা আরো সহজলভ্য হলে, আমাদের প্রথাগত অডিট রিপোর্টের ব্যবস্থা কে যুগোপোযোগী করার জন্য আইসিএবি ও আইসিএমএবি-এর প্রতিষ্ঠানগুলোকে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পানা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়াও তিনি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যক্রম স্বচ্ছতা ও গর্ভানেন্স বাড়ানোর আহ্বান জানান। সম্মানিত অতিথি’র বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক আফতাব-উল ইসলাম বলেন, ক্যামেল রেটিং-এর মত অডিট কোম্পানীসমূহের জন্য এফআরসি কর্তৃক রেটিং ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে পারে, যার মাধ্যমে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা, অবস্থান এবং সক্ষমতা সম্পর্কে আমরা ধারণা পেতে পারি। এছাড়াও তিনি অডিট রিপোর্টের বিশ্বাপসসযোগ্যতা বাড়ানোর উপর গুরুত্বারোপ করেন। ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ফাইনান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের ‘ফাইনান্সিয়াল রিপোর্ট মনিটরিং ডিভিশন’র নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ব্যবসায়িক কার্যক্রমের ৩টি বিষয় যেমন: আর্থিক তথ্য বিবরণী, অডিট প্রসেস এবং স্বচ্ছতা নিরূপন ফাইনান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট-এর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, মানসম্মত ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্ট একটি ব্যাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য করে তোলার পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষনে বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করে। তিনি অডিট রিপোর্ট প্রস্তুতকরণে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করেন। নির্ধারিত আলোচনায় বাংলাদেশ ফাইনান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের স্ট্যান্ডার্ড সেটিং ডিভিশন-এর নির্বাহী পরিচালক এম আনোয়ারুল করিম যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. জাভেদ সিদ্দিকী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট-এর আপীল বিভাগের এ্যাডভোকেট ব্যারিস্টার এ এম মাসুম, দি ইন্সটিটিউট অফ চার্টার্ড একাউন্টেন্টস অফ বাংলাদেশ (আইসিএবি)-এর সভাপতি মোহাম্মদ ফারুক এবং দি ইন্সটিটিউট অফ কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট একাউন্টেন্টস অফ বাংলাদেশ (আইসিএমএবি)-এর সভাপতি মোঃ জসিম উদ্দিন আকন যোগদান করেন। বাংলাদেশ ফাইনান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের স্ট্যান্ডার্ড সেটিং ডিভিশন-এর নির্বাহী পরিচালক এম আনোয়ারুল করিম বলেন, ফাইনান্সিয়াল কাউন্সিলের পক্ষ হতে অডিট রিপোর্ট-এর স্ট্যান্ডার্ড নিশ্চিতকরণের জন্য বিভিন্ন ধাপে এ পদ্ধতির সহজীকরণ করা হয়েছে এবং এ বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য কর্মশালা আয়োজন সহ বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. জাভেদ সিদ্দিকী বলেন, মানসম্মত অডিটি রিপোর্ট নিশ্চিতকল্পে বিদ্যমান আইনে ফাইনান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলকে বেশ ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে, যা বাস্তবে ব্যবহার করা প্রযোজন। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ অডিট ফি সারা পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে তুলনামূকভাবে বেশ কম, যা বাড়ানো প্রয়োজন। এবিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের মধ্যে জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য আরো বেশি হারে কর্মশালার আয়োজন এবং স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়নের উপর তিনি জোরারোপ করেন। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট-এর আপীল বিভাগের এ্যাডভোকেট ব্যারিস্টার এ এম মাসুম বলেন, কাউন্সিলের কার্যক্রম আরো দৃশ্যমান করার জন্য আরো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তিনি অডিটদের ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি কোম্পানীর পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্যবস্থাপনার কাজে নিয়োজিতদের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিদ্যমান আইনের ৪৭ ধারার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষন করেন। জনস্বার্থের সাথে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে তিনি আইনের ৭১ ধারা ব্যবসারের জন্য কাউন্সিলের প্রতি তিনি আহ্বান জানান। আইসিএবি-এর সভাপতি মোহাম্মদ ফারুক বলেন, রেগুলেটরদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য কাউন্সিরকে কাজ করতে হবে। তিনি জানান, সাধারণত অডিটদের দ্বারা তৈরি কোম্পানীগুলোর অডিট রিপোর্টের উপর ভিত্তি করেই সেইসব প্রতিষ্ঠানের ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্ট তৈরি করা হয় এবং এক্ষেত্রে কোন ধরনের অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হলে অডিটদের পাশাপাশি সেই প্রতিষ্ঠানের পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনার কাজে নিয়োজিতদেরও আইনের আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে ‘ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড’-এর নীতিমালা সমূহ খুব বেশি অনুসরণ করা হয় না। তিনি অডিটরদের নিবন্ধন একটি সংস্থার আওতায় নিয়ে আসারও প্রস্তাব করেন। আইসিএমএবি-এর সভাপতি মোঃ জসিম উদ্দিন আকন ফাইনান্সিয়াল রিপোর্টিং আইনের আওতায় কস্ট অডিট কে অন্তর্ভূক্তকরণের দাবী জানান। ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের প্রাক্তন চেয়ারম্যান সি কিউ কে মোস্তাক আহমেদ, কাউন্সিলের পর্যবেক্ষণের কার্যক্রম আরো বাড়ানো ও শক্তিশালীকরনের আহ্বান জানান। তিনি বিদ্যমান আইনে বেসরকারীখাতে এসএমইদের থ্রেসহোল্ড-এর সীমা পুনঃনির্ধারনের জন্য সংশ্লিষ্ট খাতের প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনার পরামর্শ প্রদান করেন। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক-এর প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকর্তা আব্দুল কাদের জোয়ারদার, এফসিএ, ওমেরা ফুয়েলস লিমিটেড’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আকতার হোসেন, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকালটি সদস্য প্রফেসর ড. শরীফ আহকাম প্রমুখ মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। আলোচকবৃন্দ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যবৃন্দের মানসিকতা পরিবর্তন, অডিট ফি বাড়ানো এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানসমূহে দক্ষ অডিট কর্মকর্তা নিয়োগদানের উপর জোরারোপ করেন। ডিসিসিআই ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি এন কে মবিন ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
×