ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সহযোগীরা বহাল তবিয়তে

মালেকের উত্থানের নেপথ্যে

প্রকাশিত: ২১:৩৫, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০

মালেকের উত্থানের নেপথ্যে

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ শত কোটি টাকার মালিক স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালকের গাড়িচালক আব্দুল মালেক ওরফে মালেকের সহযোগীরা এখনও বহাল তবিয়তে স্বাস্থ্য অধিদফতরে কাজ করে যাচ্ছেন। মালেক এদের যোগসাজশে ও পৃষ্ঠপোষকতায় বিশাল সিন্ডিকেট করে সীমাহীন দুর্নীতির মাধ্যমে অধিদফতরকে জিম্মি করে রেখেছিলেন। মালেককে গ্রেফতারের পর পুলিশী জিজ্ঞাসাবাদে সামান্য গাড়িচালক হয়ে এত সম্পদের মালিক হওয়ার ঘটনায় সবাই বিস্মিত। মালেক যাদের সহযোগিতায় এত সম্পদ গড়েছেন তাদের বিষয়েও খোঁজ-খবর নিচ্ছে পুলিশ। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, অনেক প্রভাবশালী মন্ত্রী, সাংসদ ও রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে সখ্য ছিল মালেকের। এসব ব্যক্তির সঙ্গে দহরম-মহরম থাকায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন অপ্রতিরোধ্য। এদিকে মালেক ওরফে বাদল কত সম্পদের মালিক তা এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে দুদক প্রাথমিক অনুসন্ধানে ঢাকার একটি মৌজাতেই মালেক ও তার স্ত্রী নার্গিস বেগমের সাতটি প্লটের সন্ধান পেয়েছে। এছাড়া মালেকের মহাখালীতে হোটেল ব্যবসা রয়েছে। এদিকে মালেকের বিরুদ্ধে দায়ের করা দুই মামলার তদন্ত করতে চায় র‌্যাব। এজন্য র‌্যাবের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। এছাড়া মালেকের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং মামলা দায়ের করার জন্যও দুদক ও সিআইডিকে চিঠি দিয়েছে র‌্যাব। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, অবৈধ অস্ত্র দেখিয়ে ভয়ভীতি, চাঁদাবাজি, জাল টাকার ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগে গত রবিবার তুরাগ এলাকার নিজ সাত তলা ভবনের তৃতীয়তলা থেকে আব্দুল মালেক ওরফে মালেক ড্রাইভারকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। গ্রেফতারের পর তৃতীয় শ্রেণীর এক কর্মচারী শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক হওয়া নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। এরপর মালেককে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতর থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরের দিন সোমবার মালেকের বিরুদ্ধে তুরাগ থানায় অস্ত্র ও জাল টাকা রাখার অভিযোগে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করে র‌্যাব। ওদিন তাকে আদালতে সোপর্দ করে দুই মামলায় ১৪ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। মামলাটি বর্তমানে তুরাগ থানা পুলিশ তদন্ত করছে। গ্রেফতারের পর মালেককে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করে র‌্যাব। পরে র‌্যাব অনুসন্ধান মালেকের সম্পদের একটি খসড়া হিসাব তৈরি করে। পরে র‌্যাবের পক্ষ থেকে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা দায়েরের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন- দুদক ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডিকে) চিঠি দেয়া হয়েছে। তবে দুদক সূত্র জানায়, গত বছরে মাঝামাঝি সময়ে দুদক স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতিবাজদের বিষয়ে খোঁজ-খবর শুরু করে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করে। এরই ধারাবাহিকতায় গত বছরের ২২ অক্টোবর জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আব্দুল মালেককে তলব করেছিল। র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়ে বিষয়টি আলোচনায় আসার পর মালেকের সম্পদ বিবরণী জমা দেয়ার জন্য নোটিস দেয়া হয়েছে। মালেকের স্বেচ্ছাচারিতা ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের গাড়িচালকের হওয়ার পর থেকে মালেকে দাপট দিন দিন বাড়তে থাকে। হেড ড্রাইভার হয়ে মালেক এক পর্যায়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরে ড্রাইভার্স এ্যাসোসিয়েশন নামে সংগঠন তৈরি করে নিজেই তার সভাপতি হন। এরপর সে ক্ষমতা দিয়ে ড্রাইভারদের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করেন। অধিদফতরের মহাপরিচালকের কর্তা ব্যক্তিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে মালেক দোর্দ-প্রতাপে সেখানে রামরাজত্ব কায়েম করেন। তার ভয়ে কোন গাড়িচালকই মুখ খুলতেই রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জানান, অধিদফতরে বেশিরভাগ সময়ই কর্মকর্তাদের বিকেল পাঁচটার পর পর্যন্তও কাজ করতে হয়। অফিস সময়ের বেশি কাজ করলে গাড়িচালকরা ওভারটাইম পেয়ে থাকেন। কিন্তু ওভারটাইমের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে টাকা কমিশন নিতেন মালেক। কেউ এই কমিশনের টাকা দিতে না চাইলে তার ওভারটাইম বিলে স্বাক্ষর করতে না মালেক। দুর্নীতিতে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন যারা ॥ র‌্যাবের অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা কবির হোসেন চৌধুরী ও মোঃ শাহজাহান ফকির, প্রধান সহকারী সৈয়দ জালাল এবং অফিস সহকারী জাহাঙ্গীর আলম (পেনশনের কাজ করেন) বিভিন্নভাবে গাড়িচালক মালেককে দুর্নীতিতে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। গ্রেফতারের ৪ দিন পর মালেকের দুর্নীতিতে পৃষ্ঠপোষকাতকারীরা স্বাস্থ্য অধিদফতরের বহাল তবিয়তে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের টিকিটি কেউ ছুঁতে পারেনি। বৃহস্পতিবারও মহাখালীতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নতুন ভবনের তিন তলায় প্রশাসনিক কর্মকর্তা কবির হোসেন চৌধুরীর কক্ষ। তিনি প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় মোঃ শাহজাহান ফকির, প্রধান সহকারী সৈয়দ জালাল এবং অফিস সহকারী জাহাঙ্গীর আলম অফিস করে যাচ্ছেন। অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, গাড়িচালক আব্দুল মালেকের সঙ্গে যাদের নাম এসেছে তারা সবাই অফিস করছেন, বহাল তবিয়তে রয়েছেন তারা। তবে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী সূত্র জানায়, তাদের নজরদারির মধ্যে রাখা হচ্ছে। তদন্ত করা হচ্ছে। যে কোন মুহূর্তে তাদের গ্রেফতার করা হতে পারেন। বিএমএর কর্মকর্তারা জানান, বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছেন সেগুলো প্রশংসনীয়। কিন্তু এই দুর্নীতিতে যারা সামনে রয়েছে যেমন সাবরিনা, মালেক, সাহেদ-তারা সম্মুখভাগের দুর্নীতিবাজ, কিন্তু এদের পেছনে যারা মাস্টারমাইন্ড, তাদের যদি না ধরা যায় কিংবা তাদের যদি ‘ট্রেস’ না করা হয় তাহলে এই দুর্নীতি নির্মূল হবে না। এই মালেক-সাহেদরাই সবসময় ধরা খাবে, পরে আবার এ রকম মালেক-সাহেদ-সাবরিনা তৈরি হবে। কিন্তু এদের যারা তৈরি করে, যারা কাজ করায়, যারা পারপাস সার্ভ করায়, তাদের পর্যন্ত যদি না যাওয়া যায় তাহলে আসলে কিছুই হবে না। গাড়িচালক আব্দুল মালেকের সঙ্গে যাদের নাম রয়েছে সহযোগী হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে অধিদফতর এখনও কোন পদক্ষেপ নেয়নি। আর এর কারণ হিসেবে অধিদফতর বলছে, তাদের হাতে অফিসিয়ালি কোন ডকুমেন্টস আসেনি এখনও। এ ব্যাপারে অধিদফতরের মিডিয়া সেলের প্রধান ডাঃ হাবিবুর রহমান বলেন, মালেকের সহযোগীদের বিরুদ্ধে তদন্ত করব যখন আমাদের কাছে স্পেসিফিক অভিযোগ আসবে। গাড়িচালক আব্দুল মালেককে আমরা বরখাস্ত করেছি, আমাদের কোন কর্মকর্তার নামে যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আসে যে তিনি দুর্নীতিবাজ বা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছে সেক্ষেত্রে তদন্ত করব।’ মালেকের সাদা পাজেরো জীপটি পড়ে আছে ॥ মহাপরিচালকের জন্য বরাদ্দকৃত সাদা পাজেরো জীপটি ব্যবহার করতেন মালেক। গ্রেফতারের পর সেই জীপটি স্বাস্থ্য অধিদফতরের ক্যান্টিনের সামনেই পড়ে আছে সাদা রঙের একটি পাজেরো জীপটি (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-২৯৭৯) অভিভাবকহীনভাবে পড়ে আছে। সেই গাড়িটি নিয়ে কৌতূহলও রয়েছে কর্মচারীদের মধ্যে। তারা অভিযোগ করেন, এই গাড়ির দাপুটে ব্যক্তিটির ভয়ে তটস্থ থাকত অধিদফতরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, গত ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে গাড়িটি এখানে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক ডাঃ এ এইচ এম এনায়েত হোসেনের গাড়িচালক মোঃ আবদুল মালেক ওরফে বাদল চালাতেন এই গাড়িটি। সেই মালেকের বিপুল সম্পদের মালিক বনে যাওয়ার তথ্য এরই মধ্যে বেরিয়ে তার অপকর্মের নানা কাহিনী। গাড়িটি অধিদফতরের সামনে পড়ে থাকলেও গাড়ির চাবি বা লগবুক কার কাছে, সে তথ্য বলতে পারছেন না কেউ। এই গাড়ির জ্বালানি তেল বাবদ কত টাকা খরচ করা হয়েছে বা সেই খরচ কে দিয়েছে, সে প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারছেন না খোদ স্বাস্থ্য অধিদফতরের কেউই। গাড়িচালক আবদুল মালেক গ্রেফতার হওয়ার পর তার অনিয়ম-দুর্নীতি বিষয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত কাগজে-কলমে তিনি স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক ডাঃ এ এইচ এম এনায়েত হোসেনের গাড়িচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু ডাঃ এনায়েত হোসেন বর্তমানে যে টয়োটা ভিগো (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৮-৩৯৫১) গাড়ি ব্যবহার করেন, সেটির চালক হারুন। এর আগে এনায়েত হোসেন যখন অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) ছিলেন, তখন তার গাড়ির চালক ছিলেন আবদুল মালেক। সেই সময় ডাঃ এনায়েত হোসেনের জন্য বরাদ্দ ছিল ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-২৯৭৯ নম্বর পেটের সাদা রঙের পাজেরো জীপ, যা চালাতেন মালেক। পরে ডাঃ এনায়েত মহাপরিচালক হিসেবে পদোন্নতি পেলে নতুন গাড়ি ব্যবহার করতে থাকেন। ওই সময় থেকেই সাদা পাজেরো জীপটি ব্যক্তিগত বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে আসছেন আবদুল মালেক, যার লগবুক বা চাবির কোন তথ্য কেউই দিতে পারছেন না। এছাড়াও মালেক স্বাস্থ্য অধিদফতরের আরও দুটি গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতেন, যার মধ্যে একটি পিক-আপ গাড়ি তার খামারের দুধ বিক্রি এবং অধিদফতরের ক্যান্টিনের মালামাল পরিবহন করত। আরেকটি মাইক্রোবাস অধিদফতরে কাজ করা পরিবারের অন্য সদস্যরা ব্যবহার করে। ক্যান্টিন বন্ধ ॥ গাড়িচালক আব্দুল মালেকের বড় মেয়ের জামাই রতন ক্যান্টিন ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অধিদফতরের পুরনো ভবনের সামনে ক্যান্টিনটি বন্ধ। মালেক ড্রাইভার গ্রেফতার হওয়ার পর ক্যান্টিনের প্রধান ফটকটি তালা মারা। অধিদফতরের অনেক কর্মচারী জানান, এই তালা কয়েকদিন পরেই খুলে যাবে। মালেক ড্রাইভার খুব শক্তিশালী। এর আগেও মালেক ড্রাইভারের বিরুদ্ধে সেনা সমর্থিত সরকার তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি তদন্ত করেছিল। তখনও তার কিছু হয়নি। তখন ক্যান্টিন কিছুদিন বন্ধ হয়েছিল, কিন্তু পরে তারা এসে ক্যান্টিন খুলেছে। নিয়োগ বাণিজ্য ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ শাহ মুনীর হোসেনের আমলে (২০০৯ থেকে ২০১০) স্বাস্থ্য সহকারী পদে শতাধিক নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন মালেক ড্রাইভার। গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ এ এইচ এম এনায়েত হোসেনের গাড়িচালক ছিলেন। এদিকে র‌্যাব অভিযোগ পত্রে উল্লেখ্য করেন, মহাপরিচালক তার অন্যতম আশ্রয়দাতা হিসেবে কাজ করেছেন। বিনিময়ে তিনি মহাপরিচালককে নানা ধরনের অনৈতিক সুবিধা দিয়েছেন বলেও উল্লেখ করা হয় সেখানে। এ ব্যাপারে অধ্যাপক ডাঃ এ এইচ এম এনায়েত হোসেন জানান, স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদফতরে কোন নিয়োগ-বদলি বা পদায়নের কোন বিষয় নেই। তাহলে আমি কিভাবে তাকে আশ্রয় দিলাম। দুদকের অনুসন্ধান ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়িচালক আবদুল মালেক ওরফে বাদলের সম্পদ আসলে কত, তা এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে দুদক প্রাথমিক অনুসন্ধানে ঢাকার একটি মৌজাতেই মালেক ও তার স্ত্রী নার্গিস বেগমের সাতটি প্লটের সন্ধান পেয়েছে। এর মধ্যে দুটি প্লটে বহুতল ভবন রয়েছে। সব কটিই রাজধানীর তুরাগ থানার ধউর এলাকায়। দুদক সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি উদ্নে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে গাড়িচালক আবদুল মালেকের নাম বেরিয়ে আসে। গত বছরের মার্চে তার ব্যাপারে অনুসন্ধান শুরু হয়। এখন পর্যন্ত মালেক ও তার স্ত্রীর যে সাতটি প্লটের সন্ধান পাওয়া গেছে, তার পাঁচটি মালেকের ও দুটি স্ত্রীর নামে। এর মধ্যে ধউর মৌজায় পৌনে ৭ শতক (৬৭০ অযুতাংশ) জমির ওপর মালেকের ছয়তলা একটি ভবন রয়েছে। ধউর মৌজায় আরও চারটি জমি আছে। একটি ৬ শতক, একটি সাড়ে ৬ শতক, একটি ৬ দশমিক ২৫ শতক, অন্যটি ২ দশমিক ৫ শতক। আর নার্গিস বেগমের নামে ৬৭০ অযুতাংশ বা পৌনে ৭ শতক জমির ওপর একটি ছয়তলা ভবন রয়েছে। একই মৌজায় তার আরেকটি প্লট রয়েছে। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১১ সালের মার্চে এসব জমি কেনা হয়। এ ছাড়া প্রাথমিকভাবে মালেকের ৬৪ লাখ টাকা ব্যবসায় বিনিয়োগ পাওয়া গেছে। মালেকের পেছনে কারা ॥ অনেক প্রভাবশালী মন্ত্রী, সাংসদ ও রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে সখ্য ছিল স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়িচালক আবদুল মালেকের। তাদের সঙ্গে দহরম-মহরম সম্পর্ক ছিল তার। এজন্য তিনি বেপরোয়া হয়ে উঠেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পাত্তাই দিতেন না মালেক। কখনও প্রভা খাটিয়ে আবার কখনও মোটা অঙ্কের বিনিময়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীতে লোকজনকে চাকরি দিতেন। এদের প্রশ্রয়ে মালেক পরিবারের ১২ জনকে চাকরি দিয়ে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন মালেক। শুধু তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর নিয়োগ কিংবা বদলি করেই নয়, প্রভাবশালী মহলের মাধ্যমে তিনি চিকিৎসকদের বদলি করেও কামিয়েছেন বিপুল অঙ্কের টাকা। স্বাস্থ্য অধিদফতরের একজন সাবেক মহাপরিচালক জানান, তিনি মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পরপরই গাড়িচালক মালেকের অবৈধ কর্মকান্ড সম্পর্ক জানতে পারেন। এজন্য তিনি মালেককে একটি দিনের জন্যেও তার গাড়ি চালাতে দেননি। কয়েকবার তাকে অন্যত্র বদলির উদ্যোগও নিয়েছিলেন এই পরিচালক, কিন্তু মানসম্মান হারানোর ভয়ে বদলির সাহস করেননি। ওই মহাপরিচালক জানান, নানা অনিয়মের অভিযোগে তার নির্দেশে কয়েকজন চালককে বদলি করা হলে মালেক তাদের তিন মাসের মধ্যে ফিরিয়ে আনবেন বলে একজন তাকে চ্যালেঞ্জ করেন। তিন মাসের মধ্যে প্রভাবশালী মহলের সুপারিশে সেই চালকরা অধিদফতরে বদলি হয়ে আসেন। তিনি জানান, চালকরা যদি এভাবে কর্মকর্তাদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বদলি হয়ে চলে আসেন, তাহলে মানসম্মান আর থাকে কোথায়? এ কারণে কৌশলে গাড়িচালক মালেককে এড়িয়ে গেছেন বলে জানান এই মহাপরিচালক। র‌্যাব তদন্ত করতে চায় ॥ রবিবার আবদুল মালেককে গ্রেফতারের পর পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পরে সোমবার তুরাগ থানার মালেকের বিরুদ্ধে দুই মামলা করে র‌্যাব। র‌্যাব জানায়, তারা মালেকের এই দুটি মামলাই তদন্ত করতে চায়। অনুমতি চেয়ে পুলিশ সদর দফতরে চিঠি পাঠানো হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিলে তারা কাজ শুরু করবে। দুদকের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, মালেক ও তার স্ত্রীর সম্পদের অনুসন্ধান এখনও চলছে। ইতিমধ্যে এই দম্পতিকে সম্পদ বিবরণী দাখিল করতে নোটিস দিয়েছে দুদক। অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদক ২১ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য বিভাগের ১১ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের বিবরণী চেয়ে নোটিস দিয়েছে। তাদের আটজনের নয়জন স্ত্রীর (একজনের দুই স্ত্রী) সম্পদের হিসাবও চাওয়া হয়েছে। সেখানে মালেক ও তার এক স্ত্রীও আছেন। এরই মধ্যে দুদক মালেকের আরেক স্ত্রী রাবেয়া খাতুনের খোঁজ পেয়েছে। তারও সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিস দেয়া হবে। র‌্যাবের পরিচালক (মিডিয়া) লে. কর্নেল আশিক বিলাহ বলেন, মামলার তদন্তের অনুমতির জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় অনুমতি দিলে ড্রাইভার মালেকের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা দুটি তদন্ত করবে র‌্যাব। বয়সে জটিলতা ॥ র‌্যাবের কাগজপত্রে আবদুল মালেকের বয়স ৬৩। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, তার বয়স প্রায় ৫৯। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিবহন কর্মকর্তা আলাউদ্দিন খান জানান, আগামী বছরের ৯ জানুয়ারি আবদুল মালেকের অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে যাওয়ার কথা ছিল। তিনি স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিবহন পুলের একজন গাড়িচালক ও তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী। অষ্টম শ্রেণী পাস মালেক ১৯৮২ সালে সাভার স্বাস্থ্য প্রকল্পের গাড়িচালক হিসেবে যোগ দেন। বছর চারেক পর অধিদফতরের পরিবহন পুলে যোগ দেন। গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত তিনি প্রেষণে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের পরিবহন পুলের গাড়িচালক ছিলেন। মহাখালীতে হোটেল ব্যবসাও মালেক ॥ স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক গাড়িচালক মালেক ওরফে বাদলের মহাখালীতে হোটেল ব্যবসাতেও যুক্ত ছিলেন। সম্প্রতি অবশ্য হোটেলটি বিক্রি করে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়ে যাওয়ায় সেই প্রক্রিয়া আর শেষ করতে পারেননি। অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর মহাখালী আমতলীতে কাপাসিয়া হোটেল নামে পরিচিত হোটেলটি দীর্ঘদিন থেকে পরিচালনা করে আসছিলেন আবদুল মালেক। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই ভবনের মালিক সেলিম রেজাও একজন গাড়িচালক। তবে সেলিম রেজার পরিবারের সদস্যরা এই অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, এটা তার শ্বশুরবাড়ি থেকে পাওয়া বাড়ি। তাদের দাবি, ২০০৮ সালে ১৪ লাখ টাকা দিয়ে মালেক এই হোটেলের জায়গা কিনে নেন সেলিম রেজার কাছ থেকে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, কাপাসিয়া হোটেলের দেখাশোনা করতেন আবদুল মালেকের বড় মেয়ের স্বামী রতন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ক্যান্টিনও চালাতেন এই রতনই। ১৩ সেপ্টেম্বর এই হোটেল বিক্রি করার উদ্যোগ নেন আবদুল মালেক। ৩০ লাখ টাকা দিয়ে এই হোটেল বিক্রির বিষয়ে কথা হয় সেলিম রেজার সঙ্গেও। তবে আবদুল মালেক গ্রেফতার হয়ে যাওয়ায় হোটেলটি আর বিক্রি করতে পারেননি। হোটেলের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা বুলবুল জানান, ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে হোটেলটি চলছে। আমি আবদুল মালেকের কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছিলাম। তার বড় মেয়ের জামাই রতন দেখাশোনা করেন। আগে দৈনিক এক হাজার ৫০০ টাকা দিতাম। তবে করোনাভাইরাসের কারণে এক হাজার ২০০ টাকা দিতাম। অর্থাৎ মাসে ৩৬ হাজার দিতাম। বুলবুলও জানান, হোটেলটি বিক্রি করে দেয়ার কথাবার্তা চলছিল।
×