ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সেই রাশিয়া

প্রকাশিত: ০০:০২, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০

সেই রাশিয়া

পূর্ব প্রকাশের পর মা-বাবা-ভাই-বোনের কথাও মনে পড়লো আমার। দেশের টান টের পেলাম। আবার এই যে নানা দেশে ঘুরে বেড়ানো, কতরকম মানুষ দেখা- এরও একটা নেশা আছে, টান আছে বুঝতে পারি। দুটোই তীব্রভাবে টানে আমাকে। কিন্তু কোনটা বেছে নেবো আমি? ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম। লেনিনগ্রাদে বাঙালি বিয়ে রাশিয়ায় ফিরে এসেছি অনেকদিন হলো। আলাউদ্দিন ফেরেনি। ভিক্টোরিয়া স্টেশনে ট্রেন যখন ছাড়বে, দু’তিন মিনিট বাকি, আলাউদ্দিন ছুটতে ছুটতে এলো। তার হাতে বিরাট একটা খাবারের প্যাকেট। ট্রেনের জানালার ভিতর দিয়ে আমাকে দিতে দিতে বললো এর মধ্যে স্যান্ডউইচ আছে, তোমার জন্য বানিয়ে এনেছি। যেতে যেতে খেও। বেশি কথা হলো না। প্যাকেট থেকে কোকের বোতলটা বের করে আলাউদ্দিনের হাতে দিলাম, ও দু’এক চুমুক খেয়ে ফিরিয়ে দিল। আমি বোতলে চুমুক দিতে না দিতেই ট্রেন ছেড়ে দিল। দু’চার দিনের মধ্যেই ক্লাস শুরু হয়ে গেল। ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। এর মধ্যে একদিন কী কাজে যেন ডিন অফিসে গেছি। তামারা বললো আলাউদ্দিন একটা দরখাস্ত পাঠিয়েছে। ওর বাবা অসুস্থ, লন্ডনের হাসপাতালে আছেন। তিনি তো লন্ডনে তোমাদের অ্যামবেসাডার, তাই না? বাবার দেখাশোনা করার জন্য আলাউদ্দিন ফিরতে পারেনি। ছুটি চেয়েছে একমাসের। তুমি হাসপাতালে গিয়েছিলে ওর বাবাকে দেখতে? আমি ঠিক বুঝতে পরলাম না- লন্ডনে অ্যামবেসাডার! মনে পড়লো- এর আগে যে রাশান ছেলেটার কাছে আমরা সুইডিশ ভাষা শিখতে শুরু করেছিলাম, তাকে আলাউদ্দিন বলেছিল ওর বাবা সুইডেনে অ্যামবেসাডার, তাই ও সুইডিশ ভাষা শিখছে- বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাবে সুইডেনে। এরপর ফ্রেঞ্চ ভাষা শেখার সময় সেখানেও সিগারেট ব্রেকের সময় এক সহপাঠিনীর কাছে একই কথা শুনেছিলাম- তবে এখানে আলাউদ্দিন বলেছে ওর বাবা ফ্রান্সের অ্যামবেসাডার...কেননা ভাষাটা ফ্রেঞ্চ। মনে মনে হাসলাম, কতই রঙ্গ! শেক্সপীয়ারই তো বলেছেন আমরা সবাই অভিনেতা, আর পৃথিবীটা বিরাট রঙ্গমঞ্চ। অন্য বাঙালি স্টুডেন্টরাও ফিরেছে যার যার সামার-জব থেকে। ত্রিরতœ এবং আনোয়ার ভাই শুরু থেকেই সুইডেন যায় জব করতে। এবারেও সেখানেই গিয়েছিল তারা। ফিরেও এসেছে সবাই। শান্তিদার সঙ্গে ঘন ঘন দেখা হচ্ছে আমার। ফিরে আসার পর থেকেই বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। দেশ থেকে কিছু দরকারি কাগজপত্র আনিয়ে নিয়েছে। তার মধ্যে একটা নোটারি করা হলফনামা এই মর্মে যে দেশে তার কোনো বউ নাই, সংসার নাই। ‘কতরকম কাগজ যে লাগে!’ হাসতে হাসতে বলে শান্তিদা। ‘আচ্ছা শোনো অপু, মস্কো যাওয়া দরকার একবার। কাগজগুলো এমবেসি থেকে এটেস্টেড করে আনতে হবে।’ - চলেন যাই। - তোমার অসুবিধা হবে না? - কী অসুবিধা! প্ল্যান হলো রোববার রাতে মস্কোর ট্রেন ধরবো আমরা। সোমবার কাজ সেরে সেদিনই রাতের ট্রেনে ফিরবো- সকালে স্টেশন থেকে সোজা চলে যাবো ক্লাসে। কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ এমবেসির এডুকেশন কাউন্সিলর। এই সুযোগে তাকে একটা কবিতার বই উপহার দেবো আমি। কবিকে কবিতার বই। কবিতাগুলো আমার বাবার লেখা, তাই বইটা স্পেশাল আমার কাছে। ঐ বইয়ের ভিতরে একটা কবিতা আছে ‘আশ্চর্য রজনীগন্ধ্যা’। আমার রজনীগন্ধ্যা ফুলের গাছ নিয়ে কবিতাটা লিখেছেন আমার রাশভারি শিক্ষক পিতা। বাকুতে থাকতেই খবর পেয়েছি বোনের চিঠিতে- আমি চলে আসবার পরে ফুল ফুটেছে ঐ গাছে। বাড়ি থেকে এবার একটা চিঠি পেয়েছি, আর একটা পার্সেল। পার্সেলটার ভিতরে এসেছে ‘চতুষ্ক’ নামের এই কবিতার বই। নামটা খুব অদ্ভুত চতুষ্ক! এর মানে কী? দেশের চিঠির সঙ্গে আরেকটা চিঠি ছিল। সেটা এসেছে ভিওস্কি গ্রাম থেকে। তার উপরে লিখোশ্লাভ ডাকঘরের সিল-ছাপ্পড় মারা। দেখে আমার হার্টবিট বেড়ে গেল। রুমে এসে কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠিটা খুললাম। ইলিয়েনার চিঠি। সবই মামুলি কথা, কেমন আছো, ভালো আছি- এরকমই বেশিরভাগ। তবু আমার মনে হতে থাকে এইসব মামুলি কথার ভিতরেই অনেক না বলা কথা হয়তো মিশে আছে। আমি সেই না বলা কথা তন্ন তন্ন করে খুঁজি চিঠির ভিতরে। ইলিয়েনা জানিয়েছে আন্দ্রুশা আর নাতাশা এখনো তোমার কথা বলে, ওদের সঙ্গে বুবকার নদীতে পড়ে যাওয়ার গল্প হয়। আমিও তোমার কথা ভাবি, বার্চ গাছের পাতার মৃদু শব্দে ভরা সেই রাতের কথা ভাবি, তোমার মনে পড়ে? এরপর ওর মায়ের প্রসঙ্গ আছে, তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন কিছুদিন, এখন একটু সুস্থ। তার নিজের খবর হলো স্কুলের লেখাপড়া প্রায় শেষের পথে, রেজাল্ট ভালো হচ্ছে, সে মস্কো যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাস পড়ার ইচ্ছা তার... চিঠিটা আমি কয়েকবার পড়ি। পড়া শেষে উল্কাপাতের মতো উজ্জ্বল একটা লাইন বারবার জ্বলে উঠতে থাকে আমার আঁধার মনের অন্ধকার কোণায়- ‘মনে পড়ে...তোমার মনে পড়ে’! উল্কার মতোই জ্বলে উঠে তা আবার মিলিয়ে যায়। আমি কল্পনায় কথা বলতে থাকি ইলিয়েনার সঙ্গে। বলি আমার মনে পড়ে, সুন্দর কিছু দেখলেই সূর্যমুখি ফুলের বাগানে উজ্জ্বল আলোর ভিতরে দেখা একটা মুখ মনে পড়ে, মিনতি নদীর ঢেউ মনে পড়ে, আর সবকিছু ছাপিয়ে ভেসে ওঠে তারাভরা রাতের সেই স্মৃতি, যাকে ঘিরে ছিল দূরে দূরে দাঁড়ানো এক সারি বার্চ গাছের সাদা সাদা দীর্ঘ শরীর আর সেইসব বৃক্ষদের রহস্যময় ফিসফিসানি, সবই মনে পড়ে... শান্তিদা এসে ডাকে রেডি? কবিতার বইটা ব্যাকপ্যাকে ভরে রওনা দিই। মস্কোর কাজগুলো দিনে দিনে শেষ হয়ে যায়। দূতাবাসে যে কেরানী সিল মারবে সে সিলটা হাতে নিয়ে শান্তিদাকে প্রশ্ন করলো ‘ভালোভাবে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তো?’ শান্তিদা বললেন ‘ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ - বাবা-মা জানে? - জানে। - তারা মত দিয়েছেন? - হ্যাঁ। - বাবা কী করেন? - স্কুল শিক্ষক। - স্কুল শিক্ষকের ছেলে, অথচ বিদেশী মেয়েকে বিয়ে... আরও কী সব বলতে লাগলো লোকটা। আমার মেজাজ খারাপ হচ্ছিলো, কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, শান্তিদা মৃদু চাপ দিলো হাতে। চেপে গেলাম, কিছু বললে ঝামেলা হতে পারে। শান্তিদা ধৈর্য ধরে লোকটার কথা শুনলো, প্রশ্নের উত্তর দিলো, কী করবে, ব্যাটার হাতে সিল মারার ক্ষমতা। লোকটা গার্জেনগিরি করতেই থাকলো। আমি মনে মনে মাতৃভাষায় আর রুশ ভাষায় লোকটাকে ঝাড়তে লাগলাম- মালচি দুরাক... চুপ যা গর্দভ! আমার ভালো লাগছিল না, আমি এডুকেশন কাউন্সিলরের অফিস খুঁজে বের করলাম। ভিতরেই আছেন কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ, কী যেন লিখছেন। দরজায় নক করতে তিনি মাথা তুলে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন। আমি নিজের ছাত্র পরিচয় দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। তিনি আমাকে বসতে বললেন। আমি বললাম, ‘আপনার জন্য একটা কবিতার বই এনেছি আমি। আমার বাবার লেখা বই।’ - ও আচ্ছা। কে তিনি, কী করেন? আমি নাম বললাম, শিক্ষকতা করেন জানালাম। - আমি তো তাকে চিনি, তিনি আমার শিক্ষক। কেমন আছেন তিনি, এটা তার বই!...দেখি। হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে কবি এবার প্রশ্ন করলেন, চতুষ্ক! নামটা একটু অন্যরকম। চতুষ্ক মানে জানো তুমি? - জ্বী না, জানি না। - জ্যোতিষ্ক মানে জানো? - তা জানি। জ্যোতিষ্ক হচ্ছে স্টার, তারা...জ্যোতির অংশ অথবা খন্ড বলা যায়। - ঠিক, এবার তাহলে বলো চতুষ্ক মানে কী দাঁড়ায়? আমি একটু ভেবে নিয়ে বললাম চার খন্ড? - ‘একদম ঠিক।’ শব্দের খেলায় খুশি হয়ে উঠলেন কবি। ‘বইটার চারটে ছোট ছোট অংশ, এই যে দেখো। তাই এরকম নাম দিয়েছেন লেখক। সেদিক থেকে দেখলে খুব সহজ নাম- চারটা অংশ, তাই নাম চতুষ্ক। অথচ শব্দটা কোথাও তেমন ব্যবহার হয় না। ‘চতুষ্কোণ’ শব্দটা অনেক শুনবে। কিন্তু চতুষ্ক...! কবিদের কাজই এইÑ নতুন নতুন শব্দ খুঁজে বের করা...শব্দ আবিষ্কার! অথবা পুরোনো শব্দকে ঘষেমেজে ঝাঁ চকচকে নতুন করে ফেলা, বুঝলে...!’ আমি ঠিক বুঝতে পারি না, কিন্তু মাথা নাড়ি, তবে এটুকু বুঝতে পারি কবি পেয়ে গেছেন কথা বলার প্রিয় বিষয়। একসময় নিজের লেখালেখির প্রসঙ্গেও কথা বলেন তিনি। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ‘সেই সময় ‘স্মৃতির মিনার’ নামে একটা কবিতা লিখেছিলাম বুঝলে?’ পুরোনো দিনের কথা স্মরণ করেন কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি যেদিন পুলিশ গুলি চালালো, শহীদ হলো রফিকউদ্দিন- সেদিনই হলে এসে গভীর রাতে এক টানে কবিতাটা লিখে ফেললাম জানো? বেশ ভালো হয়েছিল কবিতাটা...’ বিড়বিড় করতে লাগলেন কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন। বাইরে মস্কোর গ্রীষ্মকাল কেবলি শেষ হয়েছে। তার সামনে খোলা একটা পৃষ্ঠা। উঁকি দিয়ে দেখলাম, তাতে লেখা ‘চরিদিকে যুদ্ধ’ । জিজ্ঞেস করলাম আপনি কিছু লিখছেন এখন? - চেষ্টা করছি...একটা কবিতা লিখতে। - যুদ্ধের কবিতা? - যুদ্ধের। - কিন্তু যুদ্ধ তো শেষ হয়ে গেছে। - মুক্তিযুদ্ধের কথা বলছো? - জ্বী। -‘মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে।’ সামনের দিকে ঝুঁকে এসে নিচু গলায় বললেন কবি। ‘কিন্তু মুক্তির যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। যুদ্ধ চলছে...।’ - মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তির যুদ্ধ কি আলাদা...! - ‘দেশে কী হচ্ছে জানো?’ এবার ফিসফিস করে বললেন তিনি। ‘দেশকে এখন আবার পাকিস্তান বানানোর পাঁয়তারা চলছে। তোমার বাবাকে আমি জানি, তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ, তাই এখানে বসে এই কথা তোমাকে বলতে সাহস পাচ্ছি আমি...। তুমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছো? যুদ্ধের সময় বয়স কত ছিল তোমার?’ আচমকা প্রশ্ন করলেন কবি। - ‘সতেরো বছর।’ আমি বললাম, তারপর যোগ করলাম, ‘আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আপনার স্মৃতির মিনার কবিতা আমি পড়েছি...‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার?/ ভয় কী বন্ধু, আমরা এখনো/ চার কোটি পরিবার/ খাড়া রয়েছি তো/ যে ভিত কখনো কোনো রাজন্য/ পারেনি ভাঙতে... ’ গড়গড় করে অনেক দূর পর্যন্ত বললাম। স্বস্তি ফুটে উঠলো কবির চোখেমুখে, বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে হেলান দিয়ে বসলেন তিনি, ‘তাহলে তুমি বুঝবে। দেশ এখন সৈন্যদের হাতে, একজন জেনারেলের বুটের নিচে... মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করা হচ্ছে...।’ বলতে বলতে হঠাৎ ব্রেক কষলেন কবি। বুঝতে পারলাম মনের কথাগুলো হঠাৎ বলে ফেলায় একটু দ্বিধা-দ্বন্ধের মধ্যে পড়ে গেছেন তিনি। বললেন, ‘থাক, কবি হলেও আমি সরকারি চাকুরে...’ এইসময় শান্তিদা উঁকি দিল দরজায়। আমাদের সবারই তখন ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল। কবি একটু চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কে?’ আমি শান্তিদাকে পরিচয় করিয়ে দিলাম। কবি আর বেশি কথা বললেন না। শুধু বললেন, ‘লেখাপড়া শেষ করে তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে যাও তোমরা। অনেক কাজ...অনেক কাজ সেখানে।’ আমরা বেরিয়ে এলাম। লেনিনগ্রাদে ফিরে আমি পড়লাম জ্বরে। উথাল-পাথাল জ্বর। মাথা তুলতে পারি না। তুলতে নিলে অন্ধকার দেখি। শান্তিদা হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলো, আমি বললাম দরকার নাই, দু’একদিনেই ঠিক হয়ে যাবো। ঠিক হতে হতে লেগে গেল দিন সাতেকেরও বেশি। শান্তিদা দু’বেলা খোঁজ নেয়, লিলিয়া স্যুপ বানিয়ে দেয়, ভালোমতো খেতে পারি না, রুচি নাই। কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকি, ঘুম আর ঘোরের মধ্যে অনেকরকম ছবি আর দৃশ্য নড়াচড়া করে মাথার ভিতরে। হঠাৎ মনে হয় মাথার কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মা- এত স্পষ্ট তার উপস্থিতি আর হাতের ছোঁয়া যে অবাক হয়ে ভাবি মা কীভাবে আসবে! ভীষণ পানি পিপাসা পায়, শুকনো ঠোঁট টের পাই, কিন্তু আমি নড়ি না, পানিও চাই না, জানি একটু নড়লেই স্বপ্নটা ভেঙে যাবে, জলের ছবিতে সামান্য ঢেউ উঠলে যেমন হয়- ভেঙে যায় ছবি। তবু ঢেউ ওঠে একসময়, এক দৃশ্য ভেঙে অন্য দৃশ্য তৈরি হয়। কে যেন আসে পা টিপে টিপে, লিলিয়া নাকি! স্যুপের ঢাকনা তুলে দেখে খেয়েছি কিনা, রুটি-সসেজ পড়ে আছে দেখে, কাছে এসে মাথায় হাত দেয়। আমি তার মুখটা দেখতে চেষ্টা করি, লিলিয়া না অন্য কেউ...ইলিয়েনা! ও কোথা থেকে এলো! অবাক হই, ভালো লাগে ভীষণ, স্বপ্ন হলেও শান্তি এনে দেয় দৃশ্যটা মনে। ইলিয়েনা ফিসফিস করে কিছু বলে, আমি বুঝতে পারি না, এবারও নড়ি না, যদি দৃশ্যটা ভেঙে যায়...! কয়েকটা দিন হাসপাতালেই থাকতে হলো। নিউমোনিয়া ধরে ফেলেছিল। হুঁশ ফিরে এলো একসময়- সাদা সাদা পোশাক পরা নার্স আর ডাক্তারদের মধ্যে। আগেও এসেছি এখানে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় এই হাসপাতালেই টেস্ট-ফেস্ট করাতে হয়েছে। সামারে প্র্যাকটিকাল করতে যাওয়ার আগেও এখানে এসে ম্যানিনজাইটিস রোগের ভ্যাকসিন নিয়ে গেছি। এবারই প্রথম এলাম রোগী হয়ে অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে। বিকেলে শান্তিদা আসে, জিজ্ঞেস করে- কী খবরটবর? এই তো উঠে বসেছো। - হ্যাঁ শান্তিদা, আজকে ভালো। ঠিক হয়ে গেছি। - খুব চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলে। তবে ডাক্তার বলেছে, শিগ্রী ভালো হয়ে যাবে। আমি তোমার ডিপার্টমেন্টে খবর দিয়ে রেখেছি। এখনো জোরেশোরে ক্লাস শুরু হয়নি। মেক আপ করে নিতে পারবে। নানান কথা হয় শান্তিদার সঙ্গে। বিয়ের প্রস্তুতির কথা জিজ্ঞেস করি। শান্তিদা বলে রেজিস্ট্রেশনের ডেট পাওয়া গেছে। লিলিয়ার বাবা-মায়ের আপত্তি ছিল শুরুতে। এখন তারা নিমরাজি হয়েছেন। বিয়েতে উপস্থিত থাকবেন। - আপনার বাড়ির খবর কী? - ‘সে তো তুমি জানোই অপু।’ শান্তিদার মুখে ছায়া নামে। ‘আমার বাবাকে হয়তো বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করাতে পারতাম। কিন্তু মা একদমই রাজি না। তারা বলে দিয়েছেন যদি বিয়ে করি তো আমার নিজ দায়িত্বে করতে হবে। বাড়িতে বিদেশী বউয়ের জায়গা হবে না।’(চলবে)
×