ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শফিক হাসান

তাঁর বিভূতি ও বিভা

প্রকাশিত: ২৩:৫২, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০

তাঁর বিভূতি ও বিভা

কবিতায় টুকরো টুকরো ছবি আঁকেন তিনি, প্রেক্ষাপট ভেদে সেই খণ্ডচিত্র উজ্জ্বল কিংবা নিষ্প্রভ। ছবিগুলো জোড়া দিলে সেটাকে বাংলাদেশের মানচিত্রের মতোই দেখায়। কখনোবা সেটা হয়ে ওঠে বৃহত্তর পরিম-লে বিশ্বমানবতার মুখচ্ছবি। চিত্রকর হিসেবে এমন কবিতাই রচনা করে চলেছেন দীলতাজ রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আলো-জল দিয়ে পরম মমতায় লালন করেছে যে জেলা, সেই গোপালগঞ্জেরই উজ্জ্বল উত্তরাধিকারী তিনি। জন্মস্থান এবং জন্ম-মাটির প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও কী-বোর্ড। সেই কলম ও কী-বোর্ডের যৌথ প্রয়াসে সৃজিত হয়েছে তাঁর বেশ কয়েকটি গল্প, কবিতা ও শিশুতোষ গ্রন্থ। সম্পাদনায়ও এগিয়ে। এত যাঁর গুণ-গৌরব, তিনি কেন মাড়ালেন না উপন্যাসের বিস্তৃত প্রান্তর- এমন কৌতূহল জেগেই থাকে। তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থের নাম স্মরণে আনি- এ মাটি শেখ মুজিবের বুক। জাতির পিতাকে কী নিবিড়ভাবে হৃদয়ে ধারণ করলে এমন দুর্দান্ত পঙ্ক্তির জন্ম হতে পারে! দীলতাজ রহমান কবিতায় আটপৌরে কথকতায় যেভাবে বসিয়ে দেন কবিতার ছুরি, সেই নিপুণ কলাবিশারদের ছুরির নিচে নিজেকে পেতে দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই পাঠকের! অল্প ক’টি পঙ্ক্তিতে তিনি পুঁতে দেন অসীম ভার ও নিঃসীম গভীরতা। পাঠান্তে মনে হয়- এ তো আমারই কথা, হৃদয় উৎসারিত জীবন-নির্যাস। সচরাচর ব্যবহৃত হয় না, এমন কঠিন বা অপরিচিত শব্দ চয়ন না করেও বক্তব্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। উল্টোভাবেও বলা যায়- যে ভাষা লুকায়িত মানুষের মনে, মুখে আসি আসি করেও অস্ফুট, ধরা পড়ে না নিজস্ব স্বর-ব্যঞ্জন বর্ণে- সেই অকথিত বক্তব্যই সজীব ও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে দীলতাজ রহমানের যাদুকরী উপস্থাপনায়। একটি অনতিদীর্ঘ কবিতায় বলেন- ‘অন্যবাড়ির ফুল পোড়ায় মর্মমূল/ তার সুবাসও নাসারন্ধ্রে সত্য নয়/ তবু ফিরে ফিরে খোঁড়ে এসে কোন সে ভুল...। এই কবিতায় উচ্চকিত হয়ে উঠেছে মানবজীবনের অতি পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত অধ্যায়। যা কিছু নিজের, তাতে সন্তুষ্ট থাকা বোধকরি মানুষের সহজাত স্বভাব নয়। তাকে হাতছানি দেয় দূরের সৌন্দর্য, কল্পনার কাশবন, আপাত সহজ কিন্তু দুর্লভ বস্তু। প্রকৃতপক্ষে যা শেষপর্যন্ত অচেনাই থেকে যায়। তবুও থামে না ভুলের পুনরাবৃত্তি, আকাক্সক্ষার চাষ। এ কবিতার বাণীর বিপরীত দিকটাও কবি দেখান অভিজ্ঞ জহুরির মতো। দর্শনঋদ্ধ ভঙ্গিমায় উচ্চারণ করেন- মালা থেকে খসে পড়ে যে ফুল/ হয়তো সে কারো ভুল/ ঝিনুকের মতো বুকে তারও আছে দামি ফুল! প্রেমের কবিতায়ও কম যান না দীলতাজ রহমান। দুই কাব্য পঙ্ক্তিতে লহমায় মূর্ত করে তোলেন প্রেমিকমনের স্বতোৎসারিত আর্তি- তোমাকে নিয়ে কবিতা হবে তবু কোথাও থাকবে না নাম/ ধাম জেনে ভালোবাসা হলে চলো চাঁদের বাড়িটি খুঁজি...। আপাদমস্তক প্রেমময় কবি দীলতাজ রহমান এভাবেই কালের পাথরে খোদাই করে চলেন জীবন-জিজ্ঞাসার চারুলিপি। ঠাস বুনোটের আরেকটি কবিতায় এভাবে ঢালেন মৃণ¥য় মাধুরী- তোমার কাছে যেতে পাশ দিয়ে যে পথ বয়ে গেলো,/ সেই পথে ছুটে গেলো কিছুটা মন/ সম্পূর্ণ আমার আমিকে আনি তোমার কাছে/ তবু তোমার সম্পূর্ণ আমি চাই-ই চাই...। প্রেম যে এক ধরনের স্বার্থপরতাও- প্রেমাস্পদকে সঠিক প্রাপ্যটুকু না দিয়ে নিজের হিস্যাটুকুই বুঝে নিতে চায় ষোল আনা, এমন প্রাচীন বিষয়কেই নতুন ব্যঞ্জনায় তুলে ধরেছেন। এক পঙ্ক্তির কবিতাও কতটা সংবেদী হতে পারে, সেই ‘ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস’ যেখানে বিন্দুতে লুকিয়ে থাকে সিন্ধুর রসদ সেটাই ধরা পড়েছে কাব্যকলিতে- বৃক্ষ জানলে না কী ক্ষতি করেছো খামখেয়ালী ডাকে...। আরেকটি বিপরীতধর্মী কবিতা- বইটি ছাপা হওয়ার পরই কবি বোঝেন/ উৎসর্গপত্রে ছাপা হয়েছে ভুল মানুষের নাম...। এভাবে, আটপৌরে শব্দ-বাক্যে, আড়াল কিংবা আবছায়া, আলো-অন্ধকারের লুকোচুরি, অলৌকিক বাতায়ন না রেখে অনেকটা নগ্নভাবে দীলতাজ রহমান মনোভাষ্য দিয়ে যান। তাতে ঘোর আপত্তি থাকতে পারে একশ্রেণির সাহিত্য সমালোচকের। কবিতায় যে রহস্যময়তা এবং দুর্বোধ্যতা থাকে তাকেই প্রধান্য দেন কেউ কেউ। অন্যথায় নিন্দুকের একহাত দেখে নিতে পারার আনন্দ! এমন ‘কল্পিত বাস্তবতা’র বিপরীতে দীলতাজ রহমান কবিতাকে কাঠবাদাম বানাতে চান না বলেই বক্তব্য প্রকাশে অকপট, নির্মেদ। এটাই তাঁর সৃজন-সৌন্দর্য। শক্তি ও বৈশিষ্ট্য তো বটেই। সমালোচকের ভ্রƒকুটি, প-িতের আলগা মাতব্বরি, খবরদারি কিংবা মনোবাঞ্ছার থোড়াই কেয়ার করেন একরোখা এ সাধক। ইতি-নেতির সীমারেখা ডিঙিয়ে পাঠক স্বস্তি ও দর্শন খুঁজে নেয় কবিতার স্বচ্ছ অলিন্দে। পাঁড়-পাঠক এবং আম-পাঠকের সঙ্গে অনায়াসে কমিউনিকেট করেন দীলতাজ রহমান। কবিতার পাশাপাশি গল্পেও নিবিষ্ট দীলতাজ রহমান। গল্প যেন যাপিত জীবনের মুখচ্ছবি। স্বচ্ছ জলে আয়না দেখার আনন্দ। নারীবাদ কিংবা পুরুষবাদের তীব্র-তীক্ষè অঙ্গনে পা না রাখেননি; তাঁর কথাসাহিত্যে ‘মানুষবাদ’ই মুখ্য। গল্পে অনায়াসেই ব্যবহার করেন অন্ত্যজ শ্রেণীর ব্যবহৃত এমন সব বাক্য, তাতে চোখ বিস্ফোরিত হওয়ার পরিস্থিতিও সৃষ্টি হয় ক্ষেত্রবিশেষে। যৌনতা ও যৌনবিষয়ক মনোভাবের প্রকাশ তার হাতে ‘শিল্পিত’ না হয়ে ‘দিগম্বর’ হয়ে ওঠে। গল্পে নারী-পুরুষ, সমাজের নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের মুখ যেভাবে এঁকে চলেন, বিধৃত করেন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রসায়ন তাতে বহুদর্শী দৃষ্টিই যেন পেখম মেলে পাঠকের মন-মানসে। প্রাত্যহিক টানাপোড়েন, দিনযাপনের গ্লানি, খেয়োখেয়ির সংসার, লোভ ও জিঘাংসার যে নৈর্ব্যক্তিক বয়ন উপস্থাপন করেন তাতে ধারণা জন্মায়Ñ দীলতাজ রহমানের জানা-শোনার পরিধি বস্তি থেকে আন্ডারওয়ার্ল্ড পর্যন্ত বিস্তৃত! গল্পের চরিত্ররা যেন লেখকসত্তার সঙ্গেই মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তেল-জলের মিশেলে সৃষ্টি হয় তৃতীয় রসায়ন। প্রশ্ন জাগে, এই অধরা মাধুরী, ব্যতিক্রমী শিল্প-রসদ কোথায় লুকিয়ে রাখেন, যেখানে গচ্ছিত গল্প-কবিতার প্রাণভোমরা! আপন আলোয় উদ্ভাসিত দীলতাজ রহমানের জন্মদিন ছিল গত ১৭ সেপ্টেম্বরে। তাঁর জন্ম ১৯৬১ সালে। জন্মদিনের শুভলগ্নে তাঁকে জানাই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা-অঞ্জলি। তাঁর বিভা ও বিভূতির রেশ ধরে আমাদের সংস্কৃতি এগিয়ে যাক আরও অনেক দূরে, বহু দূরে। [email protected]
×