ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

টাস্কফোর্সের সভায় সিদ্ধান্ত

এবার শুরু হচ্ছে ইয়াবায় লগ্নীকারীদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন

প্রকাশিত: ২৩:১৪, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০

এবার শুরু হচ্ছে ইয়াবায় লগ্নীকারীদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ ‘চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’- এমন স্লোগানে দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হয়। বিশেষ করে কক্সবাজার অঞ্চল দিয়ে মিয়ানমার থেকে মাদক ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সব সংস্থার অ্যাকশন। গত ৩১ জুলাই অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে একজন পুলিশ অফিসার গুলি করে হত্যা করার পর এই অ্যাকশন একেবারেই থমকে গেছে। কক্সবাজার অঞ্চলের মধ্যে টেকনাফে ইয়াবা ব্যবসায়ী ও চোরাচালানি হিসাবে বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে অনেকে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ইয়াবা চোরাচালান একদিকে যেমন বন্ধ করা যায়নি, তেমনি ইয়াবা ব্যবসায় বিপুল অঙ্কের অর্থলগ্নীকারীদের আইনের আওতায় আনা যায়নি। এ অবস্থায় গত বুধবার চট্টগ্রাম আঞ্চলিক টাস্কফোর্সের সভায় এসব মাদকের অর্থ বিনিয়োগকারীদের ধরার জন্য অভিযান শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এদিকে কক্সবাজারে পুলিশ কর্মকর্তার গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত একজন সেনা কর্মকর্তার মৃত্যুর ঘটনা এবং প্রাসঙ্গিকভাবে টেকনাফের সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশের অনিয়ম, দুর্নীতিসহ ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যানারে নিরীহ মানুষ হয়রানি, মোটা অঙ্কের অর্থ না পেয়ে গুলি করে হত্যাসহ আইনবিরোধী কার্যক্রমের যে চিত্র ফুটে উঠেছে তাতে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে। ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে পুলিশ বাহিনী। কিছুসংখ্যক দুর্নীতিবাজ এবং আইনী পোশাকে বেআইনী কর্মকা-ে লিপ্ত হওয়ার ঘটনা পুরো পুলিশ বাহিনীর সুনামকে ক্ষুণœ করেছে নিশ্চিতভাবে। এর ফলে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কক্সবাজারের এসপিসহ জেলায় পুলিশ সদস্যদের মধ্যে আমূল রদবদল আনা হয়েছে। বৃহস্পতিবার একযোগে ৩৪ পরিদর্শককে বদলি করা হয়েছে। যেসব পুলিশ সদস্য ঘুরেফিরে কক্সবাজার জেলায় চাকরি করতেন তাদের পোস্টিং দেয়া হচ্ছে দূর-দূরান্তের জেলাগুলোতে। এছাড়া সিনহা হত্যাকা-ের ঘটনার পর রেঞ্জ ডিআইজিকেও বদলি করে দেয়া হয়েছে। যদিও পুলিশ বিভাগের ভাষায় এটি একটি রুটিন বদলি। কিন্তু উৎস্যুক মহলের বুঝতে অসুবিধা হয়নি এসব বদলি টেকনাফে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যার ঘটনা এবং এর সঙ্গে উঠে আসা পুলিশের নানা অপকর্মের ঘটনা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সিনহা হত্যার পর দেশের কোথাও এনকাউন্টারের কোন ঘটনা ঘটেনি। টেকনাফে আগে যেখানে প্রতিদিন এ ধরনের ঘটনা ঘটত, সেখানে তা এখন রীতিমতো অকল্পনীয়। তৎকালীন ওসি প্রদীপের ২২ মাসের দায়িত্ব পালনকালে ১৪১টি এনকাউন্টারের ঘটনায় ২০৪ জনের প্রাণহানি হয়েছে। এই এনকাউন্টারের ঘটনা এখন চরম বিতর্কের মুখে রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের অনেকে প্রদীপসহ সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের আসামি করে একে একে মামলা ঠুকে দিচ্ছে। এসব মামলার ভবিষ্যত কি হবে তা নিয়ে আইনজীবীদের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে। কেননা, প্রতিটি এনকাউন্টারের ঘটনার পর একটি এক্সিকিউটিভ ইনকোয়ারি করার বিধান রয়েছে। জানা গেছে, ওসি প্রদীপ তার প্রতিটি এনকাউন্টারের ঘটনার এক্সিকিউটিভ ইনকোয়ারি সম্পন্ন করেছেন। সূত্র জানায়, বর্তমানে সত্যিকার অর্থেই ইয়াবা চোরাচালানের বিরুদ্ধে কক্সবাজার অঞ্চলে পুলিশী তৎপরতা সম্পূর্ণভাবে থমকে রয়েছে। তবে বিজিবি, কোস্টগার্ড ও র‌্যাব তাদের অভিযান অব্যাহত রেখেছে। ফলে ক’দিন পর পরই ইয়াবার চালান ধরা পড়ছে। এ জাতীয় চালান সাগর পথে আসার সময়ও ধরা পড়ার ঘটনা রয়েছে। অর্থাৎ কোনভাবেই ইয়াবা চোরাচালান রোধ করা যাচ্ছে না। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠেছে, মিয়ানমারে উৎপাদিত মরণনেশার এই ইয়াবা নিয়ে আসার পেছনে কারা অর্থলগ্নী করছে। সমাজে বিত্তশালীদের একটি অংশ মাদক চোরাচালান, মানব পাচারসহ আইনবিরোধী নানা কর্মকা-ে জড়িত। এক্ষেত্রে ইয়াবার সঙ্গে চট্টগ্রাম ও টেকনাফের কিছু চিহ্নিত বিত্তবান ব্যবসায়ী ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। যেখানে টেকনাফের একজন সাবেক এমপির কথা রয়েছে, যিনি ইয়াবা চোরাচালানিদের প্রত্যক্ষভাবে প্রশ্রয় দিয়ে নিজেও আন্ডারহ্যান্ডে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার তৎপরতায় লিপ্ত। তবে তিনি নাকি সরাসরি ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নন। এ সাবেক এমপির নাম সকলেরই জানা। প্রসঙ্গত, ইয়াবা ব্যবসার নেপথ্যে কিছু দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্যের পাশাপাশি সমাজের জনপ্রতিনিধি, অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যদেরও সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। তবে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ সব সময় জোরালো ভূমিকায় থাকে। এ নিয়ে সাধারণ পুলিশ সদস্যদের মাঝে চরম খেদও রয়েছে। সূত্র মতে, ইয়াবার চালান আসা বন্ধ করা একদিকে যেমন খুব একটি সহজ বিষয় নয় বলে আলোচিত, আবার বিপরীতে এটা বন্ধ করা কোন ব্যাপার নয় বলেও বলা হয়ে থাকে। অভিযোগ রয়েছে, রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে যা হয় ইয়াবা চোরাচালান রোধে এমন ঘটনা জড়িত বলে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। ট্যাবলেট প্রতি বিভিন্ন অঙ্কের অর্থ দিয়ে রক্ষকদের ম্যানেজ করে ইয়াবার চালান প্রতিনিয়ত আসছে মিয়ানমার থেকে। এক্ষেত্রে রক্ষক যদি ভক্ষক না হয় তাহলে এই ইয়াবার চালান রোধ করা বড় কোন বিষয় নয় বলে আলোচনায় রয়েছে। এ অবস্থায় গত বুধবার চট্টগ্রামে আঞ্চলিক টাস্কফোর্সের সভায় ইয়াবায় বিনিয়োগকারীদের আটকে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার এবিএম আজাদের সভাপতিত্বে টাস্কফোর্সের এ সভায় রেঞ্জ ডিআইজি আনোয়ার হোসেন, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর, র‌্যাব সেভেনের ডেপুটি সিও, বিজিবির আঞ্চলিক কমান্ডার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ টাস্কফোর্সের সদস্যরা জুম এ্যাপসের মাধ্যমে সভায় অংশ নিয়ে তাদের মতামত ব্যক্ত করেন। বিষয়টি আগ্রহী মহলের দৃষ্টি কেড়েছে। কেননা, এ ধরনের সিদ্ধান্ত আগে কম হয়নি। কিন্তু ইয়াবা চোরাচালান যেমন বন্ধ হয়নি, তেমনি ইয়াবা কারবারিরাও ধমে যায়নি।
×