ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম ভাঙছে

প্রকাশিত: ২২:৪২, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০

ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম ভাঙছে

রাজন ভট্টাচার্য ॥ দলের সাধারণ সম্পাদক ড. রেজা কিবরিয়াকে নিয়ে কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন দল গণফোরামের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। নতুন এই সাধারণ সম্পাদকের সকল কর্মকা-কে অগণতান্ত্রিক বলছেন দলটির দীর্ঘ দিনের পরীক্ষিত নেতারা। এরই ধারাবাহিকতায় প্রায় এক বছরের বেশি সময় দলে বহিষ্কার আর পাল্টা বহিষ্কারের ঘটনা ঘটেছে। এই গৃহবিবাদ থেকে এখন বিভক্তির পথে গণফোরাম। গণফোরাম সূত্রে জানা গেছে, কামাল হোসেনের সঙ্গে একটি পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এম এস কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়া। অপর অংশের নেতৃত্বে রয়েছেন দলের নির্বাহী সভাপতি এ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু। সুব্রত চৌধুরী পক্ষের অভিযোগ কামাল হোসেনের বার্ধক্যের সুযোগে ইচ্ছে মতো দল পরিচালনা করছেন নতুন সাধারণ সম্পাদক। তিনি নির্বাচিত হওয়ার পর একটিও নির্বাহী কমিটির বৈঠক করেননি। অনুমোদন ছাড়াই যাকে ইচ্ছে দলীয় পদ দিচ্ছেন। তার এই অগণতান্ত্রিক কর্মকা-ের প্রতিবাদে কামাল হোসেনের কাছে লিখিত অভিযোগ যারা করেছিলেন তাদের বহিষ্কারসহ নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় আগামীকাল ২৬ সেপ্টেম্বর নির্বাহী কমিটির বৈঠক আহ্বান করেছে সুব্রত-মন্টু পক্ষ। কামাল হোসেন পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এই বৈঠকের সঙ্গে গণফোরামের সম্পর্ক নেই। তাছাড়া তাদের বৈঠক ডাকার কোন এখতিয়ার নেই। সুব্রত চৌধুরী বলছেন, তারা কামাল হোসেনের দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাবেন। তবে নির্বাহী কমিটিতে সবাই চাইলে নতুন দলের ঘোষণাও আসতে পারে। এদিকে দলীয় সূত্রে জানা গেছে, কামাল হোসেন বৃহস্পতিবার পর্যন্ত নির্বাহী কমিটির বৈঠকের আমন্ত্রণ পাননি। তিনি সে বৈঠকেও যাবেন না। তবে যে কোন সময় কামাল হোসেনের আহ্বানে সমঝোতা বৈঠক হতে পারে। দলের সাধারণ নেতাকর্মীরা বলছেন, সাধারণ সম্পাদক রেজা কিবরিয়ার সঙ্গে সব্র্রত চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী আবু সাইয়িদ ও মোস্তফা মহসিন মন্টুর বিরোধের জেরে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত দলটি এখন ভাঙ্গনের পথে। সমঝোতা না হলে অন্য ছোট দলগুলোর মতোই নিশ্চিত ভাঙ্গনের মুখে পড়তে যাচ্ছে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন দল গণফোরাম। সাধারণ নেতাকর্মীরা বলছেন, রেজা কিবরিয়াকে দল থেকে সরিয়ে বহিষ্কৃত সবাইকে ফিরিয়ে আনলেই সব সঙ্কটের অবসান হবে। ভাঙ্গন থেকে রক্ষা পেতে পারে গণফোরাম। তবে দল রক্ষায় শেষ পর্যন্ত এমন সিদ্ধান্ত কামাল হোসেন নেবেন কিনা তাই দেখার বিষয়। গত বছর পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলের পর ঘোষিত কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পাওয়া না পাওয়া নিয়ে দুই অংশের বিবাদ চলে আসছিল। তা নিয়ে বহিষ্কার ও পাল্টা বহিষ্কারের ঘটনাও ঘটে। এর ধারাবাহিকতায় আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর দলের নামে বর্ধিত সভা ডেকেছেন গত কমিটির কার্যনির্বাহী সভাপতি আবু সাইয়িদ, সুব্রত চৌধুরী ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক মহসিন মন্টু। তাদের ডাকা এই সভাকে ‘অগঠনতান্ত্রিক’ বলছেন গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক রেজা কিবরিয়া। কামাল হোসেন ও রেজা কিবরিয়ার স্বাক্ষরে মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ওই সভার সঙ্গে গণফোরামের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। অন্যদিকে সব্রত চৌধুরীরা বলছেন, বর্ধিত সভায় দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কামাল হোসেনকে আমন্ত্রণ জানাবেন তারা। কামাল হোসেন আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ১৯৯৩ সালের ৪ নবেম্বর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) থেকে বেরিয়ে আসা সাইফ উদ্দিন আহমেদ মানিককে সঙ্গে নিয়ে গণফোরাম গঠন করেন। কয়েক বছর আগে মানিক মারা গেলে আওয়ামী যুবলীগ থেকে আসা মন্টুকে দলে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দলটি একাদশ নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে অংশ নিয়ে প্রথম সংসদে যায়। দলের প্রতীক ‘উদীয়মান সূর্য’ নিয়ে সিলেট-২ আসনে বিজয়ী হন মোকাব্বির খানসহ সুলতান মুহাম্মদ মনসুর। নিজেদের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল নির্বাচনের পর থেকে বিবাদ চলছে দলটিতে। রেজা কিবরিয়া বলন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ওরা এরকম বর্ধিত সভা আহ্বান করতে পারেন না। এটা সম্পূর্ণভাবে গঠনতন্ত্রবিরোধী কাজ। তিনি বলেন, কথিত ওই সভায় গণফোরামের কোন জেলা কমিটির নেতারা আসবেন না। আমার সঙ্গে প্রত্যেকটা জেলা কমিটির নেতাদের কথা হয়েছে। গাজীপুর আর এলিফেন্ট রোড থেকে কিছু লোকজন নিয়ে এই সভা হবে। পাল্টা অভিযোগ এনে সুব্রত চৌধুরী বলেন, উনি (সাধারণ সম্পাদক) নিজেই তো গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দল পরিচালনা করছেন না। গঠনতন্ত্রের আছে ৩০ দিনে সম্পাদক পরিষদ, ৬০ দিনে স্থায়ী কমিটি এবং ৯০ দিনে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক করতে হবে। ২০১৯ সালে ৫ মে মাসে ১০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার এক বছরের মধ্যে একটি মিটিংও উনি করেনি। এর প্রেক্ষিতে ১৪ মার্চ আমরা একটি সভা করি। যার প্রেক্ষিতে এসব মিটিং আহ্বান করার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির ৭০ জন সদস্য লিখিতভাবে চিঠি দিয়েছেন কামাল হোসেনের কাছে। কিন্তু তিনি তা করেননি। উল্টো সাধারণ সম্পাদক তাদের মধ্যে ১৩ জনকে শোকজ নোটিস এবং চারজনকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এভাবে তো দল চলতে পারে না। এটা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তিনি বলেন, ২৩ আগস্ট কামাল হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাত করে সাধারণ সম্পাদকের অগণতান্ত্রিক কর্মকা-ের কথা তুলে ধরলে তিনি বলেন, এসব তার জানা ছিল না। যার প্রেক্ষিতে দু’পক্ষকে নিয়ে ২৯ আগস্ট বৈঠক ডাকেন কামাল হোসেন। পরবর্তীতে রেজা কিবরিয়ার পরামর্শে বৈঠক বাতিল করা হয়। রেজা কিবরিয়া বলেন, ওরা কোন গঠনতন্ত্র মানতে চায় না। এভাবে তো দল বলুন কিংবা সংগঠন বলুন, রান করতে পারে না। তিনি দাবি করেন, সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর বিভিন্ন জেলা সফর শুরু করেন তিনি। তবে করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে তাতে ছেদ ঘটে। চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, চাঁদপুর, নোয়াখালী, রাজশাহী, সিলেটসহ কিছু জেলায় আমি গিয়ে কমিটিকে সক্রিয় করার কাজ করেছি। আমাদের প্রায় ৩৫টা জেলায় সক্রিয় সাংগঠনিক কাজ আছে, আরও জেলায় আমরা কাজ করছিলাম। এর মধ্যে কোভিড-১৯ প্রকোপের কারণে রাজনৈতিক কর্মকা- স্থগিত হয়ে যায়। সুব্রত-মন্টু পক্ষ বলছে, বর্ধিত সভায় যোগ দিতে সারাদেশের জেলা-উপজেলা থেকে প্রতিনিধিদের আসতে চিঠি দেয়া হয়েছে। কামাল হোসেন না এলে কী করবেন- প্রশ্নে সুব্রত চৌধুরী বলেন, তিনি না এলে উপস্থিত নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী কর্মকৌশল ঠিক করা হবে। আমরা রাজনীতি করতে চাই, রাজনীতির স্বাভাবিক চর্চার অধিকার চাই। গণফোরাম গঠনটাই হয়েছিল সব কিছু স্বচ্ছতার আলোকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে করা হবে। সেজন্য এই দলের সভাপতির একচ্ছত্র ক্ষমতা নেই, যা অন্যান্য দলে আছে, বলেন তিনি। সুব্রত চৌধুরীদের আলাদা চলার বিষয়ে রেজা কিবরিয়া বলেন, যে কারও রাজনীতি করার অধিকার আছে। তারা কোন দল গঠন করে করতে পারেন। কিন্তু গণফোরামের নাম ব্যবহার করে কোন সভা করার অধিকার কারও নেই। গত বছরের কাউন্সিলের পরে ঘোষিত কমিটিতে মন্টুকে বাদ দিয়ে রেজা কিবরিয়াকে সাধারণ সম্পাদক করার পর থেকে গণফোরামে বিরোধ প্রকাশ্যে রূপ নেয়। কেন্দ্রীয় কমিটির সভা আহ্বান নিয়ে পাল্টাপাল্টি অবস্থানে দাঁড়ায় দুই গ্রুপ। এক পর্যায়ে রেজা কিবরিয়া চারজনকে বহিষ্কার করেন। তারা হলেন- কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল হাসিব চৌধুরী, খান সিদ্দিকুর রহমান, হেলাল উদ্দিন ও লতিফুল বারী হামিম। সুব্রত চৌধুরীরাও পাল্টা বহিষ্কার করেন সাধারণ সম্পাদক রেজা কিবরিয়া, কেন্দ্রীয় কমিটির মহসীন রশিদ, আ ও ম শফিকউল্লাহ ও মোশতাক আহমেদকে। পাল্টাপাল্টি বহিষ্কারের মধ্যে গত ৪ মার্চ গণফোরামের সভাপতি কামাল হোসেন কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে দুই সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেন। তিনি নিজে আহ্বায়ক হয়ে সাধারণ সম্পাদক করেন রেজা কিবরিয়াকে।
×