ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কোনভাবেই বাজার হারাতে চায় না

মিয়ানমার থেকে বছরে আসছে ৬ হাজার কোটি টাকার ইয়াবা

প্রকাশিত: ২২:৪১, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০

মিয়ানমার থেকে বছরে আসছে ৬ হাজার কোটি টাকার ইয়াবা

শংকর কুমার দে ॥ কক্সবাজারের টেকনাফে সেন্টমার্টিন; বঙ্গোপসাগর এলাকা। ১৯ সেপ্টেম্বর রাত প্রায় দেড়টা। উত্তাল ঢেউ বঙ্গোপসাগরে। গভীর রাতে উত্তাল ঢেউ উপেক্ষা করে এগিয়ে আসছে ইঞ্জিন চালিত কাঠের নৌকা। টেকনাফ স্টেশনের বড়ঢিল থেকে প্রায় ২৫/৩০ নটিক্যাল মাইল উত্তর-পশ্চিমে গভীর সমুদ্রে ভেসে আসা ইঞ্জিন চালিত নৌকাটি ভেসে আসা দেখতে পায় কোস্টগার্ডের একটি টহল দল। টহল দলের সন্দেহ হয় সাগরে ভাসমান ইঞ্জিন চালিত কাঠের নৌকাটি। নৌকাটিকে থামানোর সঙ্কেত দেয় কোস্টগার্ড। পালানোর কোন পথ না পেয়ে থেমে যায় ইঞ্জিন চালিত নৌকাটি। তল্লাশি চালানো হয় নৌকায়। উদ্ধার হয় ৫ লাখ পিস ইয়াবা। বাজার মূল্য প্রায় ২৫ কোটি টাকা। গ্রেফতার করা হয় রোহিঙ্গাসহ ৭ জনকে। গ্রেফতারকৃতরা হলেন- মহররম আলী (৪৪), আব্দুল শুক্কুর (২৬), আমানুল্লাহ (২৮), নুরুল আলম (৩৮), আব্দুল মোন্নাফ (৩৫), জাহিদ হোসেন (৩৩) ও আব্দুল পেডান (২২)। তারা সবাই টেকনাফের বাসিন্দা। চিন্তা করা যায়, বঙ্গোপসাগরের গভীর সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে ইঞ্জিন চালিত কাঠের নৌকা ঢুবে গিয়ে মৃত্যু হতে পারে সবার। মৃত্যুভয় উপেক্ষা করেই মিয়ানমার থেকে প্রায় ২৫ কোটি টাকা মূল্যের ৫ লাখ পিস ইয়াবা চালান নিয়ে আসা হচ্ছিল। মৃত্যু হয়নি বটে, গ্রেফতার, মামলা, কারাগার ইত্যাদির বেড়াজালে আটকা পড়েছে মাদক পাচারকারী ইয়াবার চালান নিয়ে আসা চক্রটি। কোস্টগার্ডের তৈরি করা প্রতিবেদনে এক দিন আগে উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ পাড়ি দিয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে ইয়াবা চালান পাচারের চিত্রটি উঠে এসেছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর মিয়ানমার থেকে আসছে ৬ হাজার কোটি টাকা মূল্যের ৪০ কোটি ইয়াবার চালান। বাংলাদেশ এখন মিয়ানমারের ইয়াবা চোরাচালানের বিশাল বাজার। ইয়াবা চোরাচালানের এই বাজার কোনভাবেই হারাতে চাচ্ছে না মিয়ানমার। বন্দুকযুদ্ধ, আত্মসমর্পণ, আইনী সহায়তা ও পুনর্বাসনের আশ্বাস; কোন কিছুতেই টলানো যাচ্ছে না ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত মাদক পাচারকারী সিন্ডিকেটকে। মাদক কারবারের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণার পরও মিয়ানমার থেকে আসা অব্যাহত আছে পাচার হয়ে আসা ইয়াবার চালান। ইয়াবার চালান নিয়ে আসছে রোহিঙ্গাসহ মাদক পাচারকারী চক্র। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। মিয়ানমার থেকে নানা কৌশলে টেকনাফ, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম হয়ে মাদক ব্যবসায়ীরা ইয়াবা ট্যাবলেট পাঠাচ্ছে রাজধানী ঢাকায়। রাজধানী ঢাকা থেকে ইয়াবা চলে যাচ্ছে দেশের গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে, মানুষজনের হাতে হাতে। হাত বাড়ালেই এখন পাওয়া যাচ্ছে মরননেশা ইয়াবা। বিজিবি, কোস্টগার্ড, র‌্যাব, পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সব ইউনিটের চোখে ফাঁকি দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা এনে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দিচ্ছে মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত ইয়াবা কারবারের সিন্ডিকেট। পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ সদর দফতরে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত অপরাধ পর্যালোচনা বিষয়ক এক সভায়ও তুলে ধরা তথ্যে বলা হয়েছে, সীমান্তে নিরাপত্তা থাকা সত্ত্বেও মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবার চালান বন্ধ করা যাচ্ছে না। বৈঠক থেকে ইয়াবাসহ মাদকের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালাতে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সীমান্তে নিñিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরী। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইয়াবার প্রধান উৎস মিয়ানমার। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের দুই পারের পাচারকারী সিন্ডিকেট বহাল তবিয়তে আছে। ভারতের কিছু অংশ ও থাইল্যান্ড থেকে ইয়াবা আসছে। এই প্রতিবেশী দেশ থেকে নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসে ইয়াবা। মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্যের বিরুদ্ধে সরাসরি ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণের বাস্তবায়ন ঘাঁটতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে সীমান্ত রক্ষীদের কারও কারও সহযোগিতায় আসছে দুই দেশের পাচারকারী সিন্ডিকেটগুলো। সমুদ্রপথে ইয়াবা টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া, সাবরাং, উখিয়া উপজেলার মনখালী, মহেশখালীর সোনাদিয়া, ঘটিভাঙ্গাসহ পেকুয়া উপজেলার মগনামা ও উজানটিয়া, কুতুবদিয়া ও আনোয়ারা উপজেলার সমুদ্রপথে খালাস করা হয়। বিশেষ করে টেকনাফ উপকূল দিয়ে সবচেয়ে বেশি ঢুকছে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক। মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চোরাচালান আসা যেন অপ্রতিরোধ্য হয়েই উঠেছে। বন্দুকযুদ্ধ, আত্মসমর্পণ, আইনী সহায়তা ও পুনর্বাসনের আশ্বাস কোন কিছুতেই ভ্রƒক্ষেপ করছে না ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেটের সদস্যরা। নানা কৌশলে টেশনাফ, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, থেকে মাদক ব্যবসায়ীরা ইয়াবা ট্যাবলেট নিয়ে আসছে রাজধানী ঢাকায়। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, গত জানুয়ারি মাসে মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চোরাচালান নিয়ে আসার পর র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে টেকনাফে দুুই রোহিঙ্গা মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছে। মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন শামলাপুর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন- উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের হোসাইন শরীফের ছেলে আব্দুর হাসিম (৩০) এবং একই ক্যাম্পের শামসুল আলমের ছেলে মোহাম্মদ আইউব (৪০)। তারা দুজনই চিহ্নিত মাদক কারবারি বলে র‌্যাবের দাবি। এর আগে রাজধানী ঢাকায় আনার পথে কক্সবাজার এলাকায় উদ্ধার করা হয় প্রায় আড়াই কোটি টাকা মূল্যের সাড়ে ৮ লাখ পিস ইয়াবার বড় চালান। বিজিবি অভিযান চালিয়ে দমদমিয়া সংলগ্ন নাফ নদের ওমরখাল নামক এলাকায় একটি নৌকায় তল্লাশি চালিয়ে এই ইয়াবার চালান উদ্ধার করা হয়। মিয়ানমার থেকে ইয়াবার বড় চালান কক্সবাজারে টেকনাফে নিয়ে আসা হচ্ছে, এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে বিজিবি ইয়াবার চালান উদ্ধার করে। বিজিবির উপস্থিতি টের পেয়ে একটি নৌকা রেখে পাচারকারীরা পালিয়ে যায়। পরে নৌকায় তল্লাশি চালিয়ে ৮ লাখ ৪০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়, যার বাজার মূল্য প্রায় আড়াই কোটি টাকা বলে বিজিবির দাবি। এত কিছুর পরও বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সব ইউনিটের চোখ ফাঁকি দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা এনে রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনা অব্যাহত আছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে কোন ইয়াবার চালান ধরা পড়ার পর ইয়াবা পাচারে নতুন কৌশল অবলম্বন করে ইয়াবা সিন্ডিকেট সদস্যরা। ইয়াবা পাচারের জন্য রোগী বহনকারী এ্যাম্বুলেন্সসহ নানা ধরনের গাড়িতে বহনের পাশাপাশি বিভিন্ন ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি ও কুরিয়ার সার্ভিসের পার্সেলের মাধ্যম কোন কিছুই বাদ যাচ্ছে না। বিজিবির সদর দফতর পিলখানায় সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনেও বলা হয়, মাদক পাচারসহ সব ধরনের চোরাচালান বন্ধে কাজ করছে বিজিবি। বাহিনীর সার্বিক কর্মকান্ড ও সফলতার লক্ষ্যে মাদকসহ সার্বিক চোরাচালান বন্ধে বিজিবি সততার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। ইয়াবার চালান আসা কেন বন্ধ হচ্ছে না, এমন এক প্রশ্নের জবাবে বিজিবি মহাপরিচালক বলেছেন, পরিবার, সমাজ, সামাজিক সংগঠন, সমাজকর্মী, সর্বোপরি সব বাহিনীর কাজ এটা। তিনি বলেন, ইয়াবার উৎপাদন কোথায় হয়, সোর্সটা কোথায়, সেটা জানতে হবে। অবশ্যই এটা মিয়ানমারে হয়। অন্যান্য দেশেও হয়। আমাদের দেশে যে হয় না, তাও নয়। মিয়ানমারের এই চরিত্রটা আপনারা বুঝে নেবেন। এই ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে তাদের সব সংস্থার সব স্তরের লোক জড়িত। সেখানে সবাই এর সঙ্গে জড়িত। এছাড়া এই ইয়াবা ব্যবসায়ের সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে রোহিঙ্গা জড়িত আছে। ইয়াবা ব্যবসার জন্য মিয়ানমারেরও কিছু রোহিঙ্গা আছে। যাদের দিয়ে তারা এ ব্যবসা করায়। আমাদের দেশেও অনেক লোক এর সঙ্গে জড়িত। এক্ষেত্রে আমরা সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে তাদের কাস্টডিতে নিয়ে আসব। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, ইয়াবা চালান বন্ধ না হওয়ার প্রাথমিক কারণ হচ্ছে, মানুষ ইয়াবা সেবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এখন চাহিদা থাকলে তো যোগান আসবেই। এখনও কিছু রোহিঙ্গা ইয়াবা চালানের বাহক হিসেবে কাজ করছে। ইয়াবাসহ মাদক চোরাচালান বন্ধে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও প্রতিদিনই ইয়াবার চালান আসছে, আমরা অভিযান চালাচ্ছি। ইয়াবা আটক করছি। পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, জলসীমান্তের কাজ করছে বাংলাদেশ কোস্টগার্ড বাহিনী। স্থল সীমান্তে কাজ করছে বিজিবি। তারপরও প্রায়ই ইয়াবাসহ বিভিন্ন চোরাচালান পণ্য আসছে, আটকও করছেন এই বাহিনীর সদস্যরা। মিয়ানমারে তো আছেই। বাংলাদেশেও অনেক অসাধু লোক এই ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। দুই দেশে অবস্থান করা কিছু রোহিঙ্গাও জড়িত আছে এই ইয়াবা ব্যবসায়ের সঙ্গে। যারা ইয়াবার সঙ্গে ধরা পড়ছে, তারা মূলত বাহক। মূল ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে ধরা গেলে ইয়াবার চালান কমে আসবে বলে পুলিশ কর্মকর্তার দাবি।
×