ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ইসলামে সভ্যতা ও সংস্কৃতি

প্রকাশিত: ২১:০৫, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ইসলামে সভ্যতা ও সংস্কৃতি

বিশ্ব মানবসভ্যতার ইতিহাসে প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ (সা.) সর্বপ্রথম এমন এক সভ্যতা সংস্থাপন করলেন যা মানবিক মূল্যবোধ সমৃদ্ধ। তিনি এমন এক সাংস্কৃতিক বলয় নির্মাণ করলেন যা সত্য-সুন্দর সুশোভিত ও সমুজ্জ্বল আলোকধারায় উদ্ভাসিত। তাঁর আবির্ভাবের পূর্বে গোটা পৃথিবীটাই ছিল অজ্ঞতা, অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, র্শিক, কুফর আর নৈরাশ্যের অন্ধকারে আচ্ছন্ন। সভ্যতার ক্ষেত্রে যে সুশোভিত সৌকর্য থাকার কথা, যে সুনৈতিকতা ও সুশীলতা থাকার কথা, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যে পরিচ্ছন্নতা থাকার কথা, বলতে গেলে সেগুলোর উপস্থিতি তখন একেবারেই ছিল না। রাজতন্ত্র আর সামন্ত প্রথার শেকড় সমাজ জীবনে এমন গেড়ে বসেছিল যে সাধারণ মানুষ নির্যাতনে জর্জরিত হচ্ছিল, যাজক শ্রেণীর মস্তিষ্কপ্রসূত নিত্য-নতুন অনুশাসন বিশ্ব মানবতাকে করছিল অপমানিত, লাঞ্ছিত ও পদদলিত। পারস্য ও রোমান এই দুই পরাশক্তির দাপটে পৃথিবীটা খ--বিখ-ে পরিণত হচ্ছিল। তাদের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার মধ্যখানে পড়ে পৃথিবীর মানুষ দুর্ভোগের চরম সীমায় পৌঁছেছিল। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ সুখ-শান্তির স্বপ্ন দেখা পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিল। ক্রীতদাসদের অবস্থা ছিল আরও নাজুক। অনৈতিকতা, অশিক্ষা, কুশিক্ষা-অশান্তি, জুলুম-নির্যাতন পৃথিবীকে ধ্বংসের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছিল। সভ্যতার নামে সবখানে ছিল অসভ্যতা। সংস্কৃতির নামে ছিল কুসংস্কৃতি, অপসংস্কৃতি। নারীদের আসবাবপত্রের মতো পণ্যসামগ্রীতে পরিণত করা হয়েছিল। যাজক শ্রেণী দেবদাসী প্রথা চালু করে নারী সমাজকে ভোগের সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করত। নারীদের মর্যাদা বলতে কিছুই ছিল না। নারীদের ছলনাময়ী, আনন্দময়ী, শয়তানের ফাঁদ, আত্মাহীনা ইত্যাদি বিদ্রƒপাত্মক বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছিল। কন্যা সন্তান হওয়াটাকে অপমানজনক মনে করা হতো। কোন স্ত্রী কন্যা সন্তান প্রসব করলে তার ওপর নেমে আসত কঠিন নির্যাতন। অনেক পিতাই কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দিতেও কুণ্ঠাবোধ করত না। ভারতবর্ষে স্বামীর মরদেহের সঙ্গে স্ত্রীকেও দাহ করা হতো। গ্রীস দেশে স্ত্রীকে অন্যের কাছে বিক্রি করা হতো, উইল করে অন্যকে দেয়া যেত। উপপত্নী ও রক্ষিতা রাখবার কুপ্রথা সর্বত্র ব্যাপকভাবে ছিল। ধর্মের নামে সর্বত্র র্শিক-কুফর আর ধর্মহীনতা চরমভাবে বিদ্যমান ছিল। হযরত ঈসা (আ) যে একাত্মবাদ প্রচার করেছিলেন সেখানে তার কথিত অনুসারীরা ত্রিত্ববাদের ধারনা সৃষ্টি করেছিলেন। হযরত মূসা (আ)-এর শিক্ষা ভুলে গিয়ে ইহুদীরা মনগড়া অনুশাসনে আবদ্ধ হয়ে তাদের ধর্মগুরুদের অনুরক্তে পরিণত হয়েছিল। হযরত ইব্রাহীম (আ) ও হযরত ইসমাঈল (আ) কাবাকেন্দ্রিক যে তাওহিদী জীবন ব্যবস্থা দিয়েছিলেন, সেখানে ৩৬০টি মূর্তি বসিয়ে তা র্শিক-কুফরের কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছিল। সে ঘোর অমানিশায় আচ্ছন্ন পৃথিবীতে আবির্ভূত হলেন সিরাজাম মুনিরা-সমুজ্জ্বল চেরাগ, রহমাতুল্লিল ‘আলামীন-সমগ্র বিশ্ব জগতের জন্য রহমত প্রিয়নবী (সা)। প্রিয়নবী (সা)-এর আবির্ভাবের পূর্বে যুগে যুগে বহু নবী-রসূল পৃথিবীতে এসেছেন। কেউ এসেছেন নিজ কওমকে হিদায়াত দান করতে, আবার কেউ এসেছেন কোন নির্দিষ্ট ভূখ-ের মানুষকে সত্য পথের দিশা দিতে। আর তিনি এলেন সব মানুষের জন্য, গোটা পৃথিবীর জন্য, বিশ্ব জগতের জন্য। তিনি বিশ্ব মানবতাকে এমন এক সভ্যতা দান করলেন, এমন এক সাংস্কৃতিক সৌকর্য শোভায় সুশোভিত করলেন যা তাওহীদ ও রিসালাত থেকে উৎসারিত। ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ এই অকাট্য সত্য সেই সংস্কৃতি ও সভ্যতার মূলবাণী। যা আল্লাহর রবুবিয়াত প্রতিষ্ঠার তাকিদ দেয়, যা সুন্দর পৃথিবী গড়ার তাকিদ দেয়। আধুনিক সভ্যতার সব ভাল, সব সুন্দর তার ভিত্তি যে প্রিয়নবী (সা) স্থাপন করেছেন তা সবাই স্বীকার করেন। চেম্বার্স এনসাইক্লোপিডিয়াতে বলা হয়েছে : ‘It was the prophet who laid the foundation of the vast edifice of enlightment and civilization which has adorned the world since his time the Muslim were commanded by the Quran to say, O God! Increase my knowledge, and heard by Muhammed tell them knowledge is the birth-right fo the faithfull, take it wherever you find it. Such were the seeds which grew into trees whose branches spread to Bagdad, Cicily, Egypt and Spain, and whose fruits are enjoyed to this day by modern Europe.’... মহানবী (সা) এমন এক জ্ঞানালোক ও সভ্যতার বিশাল প্রাসাদের বুনিয়াদ স্থাপন করলেন যা তার সময় থেকে পৃথিবীটাকে অলঙ্কৃত করে আসছে। আল কুরআন মুসলিমকগণকে বলতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে : রাব্বী যিদনী ইলমা হে আমার রব! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দাও। হযরত মুহম্মদ (সা)-কে তারা বলতে শুনেছে : জ্ঞান হচ্ছে মুমিনের জন্মগণ অধিকার। যেখানে তোমরা দেখবে তা গ্রহণ করবে। এমনতরই ছিল সেইসব বীজ যার থেকে উদ্গম হলো বৃক্ষরাজির আর তার শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে গেল বাগদাদ, সিসিলি, মিসর এবং স্পেনে। আর যার ফল ভোগ করছে অজিকের দিনে আধুনিক ইউরোপ। প্রিয়নবী (সা) প্রথম ঘোষণা করলেন মানুষ হচ্ছে ‘আশরাফুল মখলুকাত’-সৃষ্টির সেরা। আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেছেন : ‘নিশ্চয়ই আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, স্থলে ও সাগরে ওদের চলাচলের বাহন দিয়েছি, ওদের উত্তম জীবনোপকরণ দিয়েছি এবং আমি যা কিছু সৃষ্টি করেছি তাদের ওপর ওদের অধিকতর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।’ (সূরা বনী ইসরাঈল : আয়াত ৭০) মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ দূর করে একটি সত্য নিষ্ঠ বিশ্ব ভ্রাতৃ-সমাজ গড়ে তোলার মধ্য দিয়েই যে, কেবল একটি সত্যিকার শান্তির পৃথিবী সংস্থাপন করা সম্ভব। সেই শিক্ষা প্রিয়নবী (সা) দিয়েছেন এবং সেই শান্তির দুনিয়া গড়ার নমুনা হিসেবে মদিনা মুনাওয়ারায় একটি কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। যে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিস্তৃতি ঘটেছিল তদানীন্তন জানা বিশ্বের বিশাল অঞ্চলজুড়ে, যা বিশ্ব মানবসভ্যতার ইতিহাসে দীর্ঘকালব্যাপী সোনালি অধ্যায় রচনা করেছে। আজকে যে বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষ আমরা দেখতে পাচ্ছি তা সেই সভ্যতাই ফসল, তা পাশ্চাত্য জনগণও নিঃসঙ্কোচে স্বীকার করে। কুরআন মজিদের বহু আয়াতে বিজ্ঞানচর্চার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : ‘তিনিই (আল্লাহ) তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন রজনী, দিবস, সূর্য এবং চন্দ্রকে আর নক্ষত্ররাজিও ‘অধীন হয়েছে তারই বিধানে। এতে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে বোধশক্তিসম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য।’ (সূরা নাহল : আয়াত ১২)। ‘আসমানসমূহ ও সৃষ্টিতে, দিবস ও রজনীর পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তির জন্য নির্দেশনাবলী।’ (সূরা আলে ইমরান : আয়াত ১৯১)। চলবে... লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ
×