ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে পরামর্শক নিয়োগে চুক্তি

১৮.৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারবে

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০

১৮.৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারবে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে জাপানী পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। বুধবার ঢাকার একটি পাঁচতারা হোটেলে চুক্তিটি সই হয়। পরিকল্পনা বলছে, ২০২৬ সালের মধ্যে বন্দর নির্মাণের প্রথম ধাপের কাজ শেষ হলে ১৮ দশমিক পাঁচ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারবে বন্দর জেটিতে। সিঙ্গাপুর বন্দরের ড্রাফট সর্বোচ্চ ১৬ মিটার। এটি হচ্ছে দেশের চতুর্থ বন্দর। এর আগে চট্টগ্রাম, মংলা এবং পায়রাতে বন্দর নির্মাণ করা হয়েছে। তবে গভীরতার দিক থেকে এটি হবে দেশের সব থেকে বেশি ড্রাফটের জাহাজের জন্য। এখন দেশের বন্দরগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে সর্বোচ্চ সাড় নয় মিটার ড্রাফট রয়েছে। মংলাতে সাড়ে আট মিটার আর পায়রাতে সাড়ে সাত মিটার ড্রাফট রয়েছে। তবে পায়রাতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং-এর মাধ্যমে আরও বড় জাহাজ নোঙ্গর করার ব্যবস্থা করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। বুধবার ঢাকায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এ সংক্রান্ত দুটি চুক্তিপত্র সই হয়েছে। মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) কার্যক্রম সংক্রান্ত প্রকল্প পরিচালক জাফর আলম এবং জাপানের নিপ্পন কোয়ের প্রতিনিধি নাওকি কুডো প্রকৌশলগত বিষয়ের চুক্তিপত্রে নিজ নিজ পক্ষে সই করেন। মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের (বন্দর সংযোগ সড়ক অংশ) সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের (আরএইচডি) কার্যক্রম সংক্রান্ত প্রকল্প পরিচালক মোঃ সাদেকুল ইসলাম এবং জাপানের ওরিয়েন্টাল কনসালটেন্ট গ্লোবাল কোম্পানি লিমিটেডের প্রতিনিধি শুনজি ইউশিহারা সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ সংক্রান্ত চুক্তিপত্রে সই করেন। কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ি এলাকায় জাইকার অর্থায়নে মাতারবাড়ি বিদ্যুত কেন্দ্রের সমীক্ষা যাচাই করার সময় গভীর সমুদ্রবন্দরের সুযোগ রয়েছে বলে জানা যায়। প্রথমে বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য শুধু কয়লা আমদানির জন্য বন্দর নির্মাণের চিন্তা করা হলেও পরে পরিবর্তন করা হয়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মাতারবাড়ি বন্দর দেশের গভীর সমুদ্রবন্দরের অভাব ঘুচিয়ে দিতে যাচ্ছে। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটিকে ফাস্টট্র্যাক প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করেন। প্রকল্পটি গত ১০ মার্চ একনেক সভায় অনুমোদন পায়। জাপানের নিপ্পন কোয়ে এবং জাপানের ওরিয়েন্টাল কনসালটেন্ট গ্লোবাল কোম্পানি লিমিটেড দুটিকে প্রকল্পটির পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়েছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দুটির সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পটির কার্যক্রমে আরও এক ধাপ অগ্রসর হলো বলে মনে করা হচ্ছে। নিপ্পন কোয়ে প্রকল্পের যাবতীয় নক্সা প্রণয়ন, ব্যয় নির্ধারণ, টেন্ডার ডকুমেন্টস তৈরি এবং অবকাঠামোগত নির্মাণের বিষয়গুলো তদারকি করবে। পরবর্তীতে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি যন্ত্রাংশ সংগ্রহ থেকে শুরু করে বন্দর চালু করে দেয়ার বিষয়টি সমন্বয় করবে। বন্দর চালু হওয়ার এক বছর পর্যন্ত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা দেবে। এজন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ২৩৪ কোটি টাকার একটি চুক্তি করা হয়েছে। অন্যদিকে ওরিয়েন্টাল কনসালটেন্ট গ্লোবাল কোম্পানি লিমিটেড প্রকল্পের (বন্দর সংযোগ সড়ক অংশ) সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের কার্যক্রম সংক্রান্ত পরামর্শ প্রদান করবে। এজন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটিকে ৪৬৬ কোটি টাকা দিতে হবে। চুক্তি সই অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, মাতারবাড়ি বন্দর নির্মাণের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে আমাদের অধিকার আরও বেশি শক্তিশালী হবে। সুনীল অর্থনীতির ধারাকে অব্যাহত রাখতে মাতারবাড়ি বন্দর নতুন উচ্চমাত্রায় নিয়ে যাবে। এতে প্রতিবেশী দেশগুলো বন্দর ব্যবহার করতে শুরু করলে অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। অনুষ্ঠানে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সমুদ্র সম্পদ ও বঙ্গোপসাগরের বিশাল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে মাতারবাড়ি বন্দর সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। মাতারবাড়ি বন্দরের বাস্তবায়ন একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। তিনি বলেন, দেশরতœ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দুর্বার গতিতে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা নির্মাণে প্রকল্পের কাজ যথাসময়ে সম্পন্ন করতে হবে। চুক্তি সই অনুষ্ঠানে জানানো হয় মাতারবাড়ি বন্দরের প্রথম পর্যায়ের কার্যক্রম ২০২৬ সালে সম্পন্ন হবে। নির্মাণ সম্পন্ন হলে মাতারবাড়ি বন্দরে সাড়ে ১৮ মিটার গভীরতার জাহাজ ভিড়তে পারবে এবং প্রায় ৮ হাজার টিইইউ’স কন্টেইনার (বিশ ফুট দৈর্ঘ্যরে কন্টেইনার) নিয়ে জাহাজ ভিড়তে পারবে মাতারবাড়ি বন্দরে। ফলে সামগ্রিক পরিবহন ব্যয় হ্রাস পাবে আনুমানিক ১৫ শতাংশ। মাতারবাড়ি বন্দর সড়ক, রেল ও নদীপথ দিয়ে সংযুক্ত থাকবে। বন্দরকে কেন্দ্র করে একটি সুপরিকল্পিত যোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে উঠবে। যার ফলে যেকোন পণ্য সহজে এবং কম খরচেই পৌঁছে যাবে আমদানি-রপতানিকারকেদের দোরগোড়ায়। এ বন্দর দিয়ে কয়লা, লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজি), অপরিশোধিত তেল ও তেল পণ্য, সিমেন্ট, ক্লিঙ্কার, সার, খাদ্যশস্য, স্টিলপণ্য এবং স্ক্র্যাপ লোহা আমদানি সহজ হবে। এ সময় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এস এম আবুল কালাম আজাদ, সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী কাজী শাহরিয়ার হোসেন, জাইকার চীফ রিপ্রেজেন্টেটিভ ইউহো হায়াকাওয়া এবং বাংলাদেশে জাপানের রাষ্ট্রদূত হিরোইকি ইয়ামায়া উপস্থিত ছিলেন। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলায় মাতারবাড়ি ও ধলঘাট এলাকায় বন্দরটি নির্মাণ করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ‘মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করবে। মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১২ হাজার ৮৯২ কোটি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (নিজস্ব তহবিল) ২ হাজার ২১৩ কোটি এবং বাংলাদেশ সরকারের ২ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ মাতারবাড়ি বন্দরের অংশ এবং সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের সড়ক অংশ বাস্তবায়ন করবে।
×