ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পতেঙ্গাকে টার্নিং পয়েন্ট করছে চউক

চট্টগ্রামে পর্যটন ঘিরে ৪ মহাপরিকল্পনা

প্রকাশিত: ২২:৫৮, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০

চট্টগ্রামে পর্যটন ঘিরে ৪ মহাপরিকল্পনা

মাকসুদ আহমদ, চট্টগ্রাম অফিস ॥ বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল। কক্সবাজার ও পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতসহ পর্যটনে পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা উন্নয়নের মহাপরিকল্পনায় চট্টগ্রামে একের পর এক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন। উন্নয়নের গতিপথে পতেঙ্গাকে টার্নিং পয়েন্ট বানিয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক)। ফলে পতেঙ্গায় বঙ্গবন্ধু টানেলের প্রবেশদ্বার, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের শেষসীমা, পতেঙ্গায় বিশ্বপর্যটনের আদলে পাঁচ কিলোমিটার ওয়াকওয়েসহ রিংরোড প্রকল্প ও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনসহ চার মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে এই সরকারের আমলে। এখন অপেক্ষার পালা ২০২২ সাল পর্যন্ত। পাহাড়, সমুদ্র আর সবুজে ঘেরা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এবং উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালের মধ্যে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার যাবে হাইস্পিড ট্রেন। নয়টি স্টেশন থেকে যাত্রী নিয়ে কক্সবাজার যাবে ট্রেনটি। অন্য কোন সরকারের পক্ষে এ ধরনের পরিকল্পনা মাথায়ও আসেনি- এমন মন্তব্য তৃতীয় প্রজন্মের। সম্প্রতি দোহাজারী থেকে কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ কাজ পরিদর্শন করে এ তথ্য প্রকাশ করেন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। তিনি বলেন, রেলের উন্নয়নে সরকার একের পর এক প্রকল্প বাস্তবায়নে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে। এদিকে পতেঙ্গা টার্নিং পয়েন্টের নেপথ্যে রয়েছে পর্যটনের উদ্দেশে যারা ভারতের দার্জিলিং, থাইল্যান্ডের পাতায়া আর ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অহরহ যাতায়াত করছেন তাদের বিদেশবিমুখ করা। এক্ষেত্রে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত ও বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এ দুটি সমুদ্র সৈকতকে পর্যটনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে রূপায়িত করতে সরকারের উন্নয়ন মহাযজ্ঞ চলমান রয়েছে। লালখান বাজার থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত, পতেঙ্গা টার্নিং পয়েন্ট থেকে আনোয়ারা টানেল আর আনোয়ারা থেকে পটিয়া হয়ে কক্সবাজারে চারলেনের রাস্তা। ২০২২ সালের মধ্যে পর্যটনে শতভাগ এগিয়ে যাবে এমন ধারণা সাবেক চউক চেয়ারম্যান আবদুচ সালামের। গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা পতেঙ্গা সমুদ্র উপকূলে গড়া বিশাল মঞ্চে আয়োজিত সুধী সমাবেশে উন্নয়ন পরিকল্পনার বক্তব্যে বলেন, ‘আমি কাজ করতে চাই দেশের জন্য, দেশের উন্নয়নের জন্য। কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণের চিন্তা করি ২০১০ সালে। ২০১৪ সালে চীনের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করা হলে শতভাগ সহায়তার আশ্বাস পাওয়া যায়। এরই ধারাবাহিকতায় টানেল নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। এই টানেল নির্মাণের মাধ্যমে চট্টগ্রামের পতেঙ্গার সঙ্গে আনোয়ারার সংযোগ হচ্ছে। পটিয়া থেকে কক্সবাজার চারলেন সড়কের কাজ চলছে। পটিয়া ও আনোয়ারার মধ্যে ১০ কিমি বাইপাস সড়ক তৈরি করা হয়েছে চারলেন সড়কের সঙ্গে মিশে যাওয়ার জন্য। ২০২২ সালে চট্টগ্রামের টার্নিং পয়েন্ট হবে পতেঙ্গা। এ টার্নিং পয়েন্ট গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার দুটি ও বাংলাদেশ ব্রিজ অথরটির (বিবিএ) প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্র উপকূলে গড়া এপ্রোচ সড়কে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান টানেল’ এর বোরিং কার্যক্রম আর চউকের ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে’র উদ্বোধন করেন গত বছর ফেব্রুয়ারিতে। আগামী দুই বছরের মধ্যে শেষ হবে বিবিএর তত্ত্বাবধানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল ও চউকের অর্থায়নে এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে। বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্পের নক্সা অনুযায়ী দেখা গেছে, প্রকল্পের মোট দৈর্ঘ্য ৯ হাজার ২৬৫ দশমিক ৯৭ মিটার। টানেলের দৈর্ঘ্য দুই দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। টানেলের বাইরে পতেঙ্গা এলাকায় ২০০ মিটার আর আনোয়ারায় কাটা হবে ১৯০ মিটার। কার্যপরিধি ২৫ মিটার। আনোয়ারা অংশে ফ্লাইওভারের দৈর্ঘ্য ৬৩৭ মিটার। মোট পাঁচ বছর সময়ের মধ্যে প্রায় তিন বছর অতিক্রান্ত হলো। তবে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই এই টানেলের কাজ শেষ হবে বলে সেতু বিভাগের কয়েক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। ১২ মিটার বৃত্তাকার এই টানেল আচ্ছাদিত অংশ পতেঙ্গা অংশে ১৯৫ মিটার আর আনোয়ারা অংশে ২৩০ মিটার। চারলেন বিশিষ্ট এপ্রোচ সড়কের মধ্যে রয়েছে পতেঙ্গা অংশে ৫৫০ মিটার আর আনোয়ারা অংশে ৪ হাজার ৮০০ মিটার। দূর থেকে দেখতে গোলাকার চশমার মতো এই দুটি টিউব চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে আনোয়ারা উপজেলাকে সংযুক্ত করবে। ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ এর এ্যালাইনমেন্ট হবে চট্টগ্রাম এয়ারপোর্ট থেকে কর্ণফুলী নদীর দুই কিলোমিটার ভাটির দিকে। টানেলের প্রবেশপথ হবে নেভি কলেজের কাছে, বহির্গমন পথ হবে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ের সিইউএফএল সার কারখানা সংলগ্ন ঘাট। প্রকল্প সাইটের উভয়দিকে বগুড়ার আরডিএ কর্তৃক চারটি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে প্রকল্পের পানির চাহিদা মেটানোর জন্য। এছাড়াও পতেঙ্গা ও আনোয়ারা উভয়দিকে দুই মেগাওয়াট বিদ্যুত সংযোগ দেয়া হয়েছে। আবার পতেঙ্গা প্রান্তে ১৫ মেগাওয়াট স্থায়ী বিদ্যুত সংযোগ দেয়া হয়েছে। এজন্য আনোয়ারা প্রান্তে বিদ্যুত সাবস্টেশন নির্মাণ হয়েছে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ৭০/৮০ ফুট নিচে দিয়ে টানেল বোরিং করা হয়েছে। এই টানেল নির্মাণে মোট ভূমি ৩৮৩ একর। বাংলাদেশ ব্রিজ অথরিটির পক্ষ থেকে আরও জানা গেছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বদলে যাবে চট্টগ্রামের চিত্র। গড়ে উঠবে চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন ও যুগোপযোগী সড়ক যোগাযোগ, আধুনিয়কায়ন হবে বিদ্যমান সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা, সংযোগ স্থাপন হবে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে, যুক্ত করা হবে কর্ণফুলী নদীর পূর্ব তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা শহরের সঙ্গে ডাউন টাউনকে, ত্বরান্বিত হবে বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ, বৃদ্ধি পাবে চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষতা ও সুযোগ-সুবিধা, গতি পাবে প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্র বন্দরের নির্মাণ কাজ, নতুন যোগাযোগ ব্যবস্থা সৃষ্টি হবে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের মধ্যে। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে নগরীর লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য ২০১৭ সালের ১১ জুলাই একনেক থেকে অনুমোদন পায়। সম্পূর্ণ সরকারী অর্থায়নে তিন হাজার ২৫০ কোটি ৮৩ লাখ ৯৪ হাজার টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা রয়েছে। বাস্তবায়নাধীন এই ফ্লাইওভারের দৈর্ঘ্য ১৬ দশমিক ৫০ কিমি। আর এর প্রশস্ততা ১৬ দশমিক ৫০ মিটার। নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে গাড়ি ওঠানামার জন্য নয়টি জংশনে ২৪টি র‌্যাম্প তৈরি করা হবে। এই ফ্লাইওভারে তিন হাজার বৈদ্যুতিক পোল স্থাপন করা হবে আর এসব পোলে প্রায় আড়াই হাজার এলইডি বাতি স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
×