ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ও মিডডে মিল

প্রকাশিত: ২১:০১, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০

কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ও মিডডে মিল

বাংলাদেশে যে কোন ধারণা, বিশেষত শিক্ষা খাতে, বারবার নতুনভাবে কোন কোন ক্ষেত্রে একই জিনিস, একই ধারণা-কৌশলকে নতুন নামে প্রবর্তন করার প্রবণতা দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষানীতি- কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের দ্বারা প্রণীত হয়েছিল যেটি, বাস্তবায়নের জন্য একটি ‘সেল’ গঠন করার উদ্যোগ গৃহীত হলেও এর দায়িত্ব নিতে প্রখ্যাত পদার্থবিদ, পরে ডিপিআই, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ফেরদৌস খানকে বারবার বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ পর্যন্ত নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়নি! প্রশাসক-আমলাদের তৈরি যে ‘লাল ফিতা’র দৌরাত্ম্য সম্পর্কে আমরা সবাই কম-বেশি অবগত, সেই ‘লাল ফিতা’ তখন খুব বেশি সক্রিয়ই ছিল বলা চলে। কেননা, পাকিস্তানের প্রাচীনপন্থী প্রশাসন ব্যবস্থা তো তখন বাঙালী মুক্তিযুদ্ধপন্থী ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী-সব আমলাই উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করে সেটিকেই অনুসরণ-অনুকরণ করছিল, যা সদ্য স্বাধীন, নবীন রাষ্ট্রের বিপ্লবাত্মক পরিবর্তনের বিরুদ্ধেই কাজ করেছে। তখন থেকে একমুখী শিক্ষা প্রবর্তন, প্রাথমিক স্তরে বিদেশী ভাষা না রাখা, সমন্বিত সমাজ ও বিজ্ঞান নামে দুটি বিষয় প্রবর্তন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বারবার বিগত ৫০ বছরে অনেক সেমিনার, সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে কিন্তু কোন সমাধান সেভাবে হয়নি। তবু, ’৭৫ পরবর্তী সময়ে, ১৯৮১ সালে প্রথম যখন ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন কেন্দ্র’ নামে আমাদের জন্য অপরিচিত একটি ‘শিক্ষা উন্নয়ন অফিস’ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন সে সময়ের শিক্ষা সচিবের উদ্যোগে সরকারী কলেজ থেকে কিছু বাছাই করা কলেজ শিক্ষক- যারা বইপত্র লিখেছে, সংবাদপত্রে লিখে থাকে, এমন ক’জনকে দিয়ে ওই অফিসের কার্যক্রম শুরু করা হয়। এতে ’৭২ সালের সেপ্টেম্বরে পিএসসির মাধ্যমে ইডেন কলেজে চাকরিরত আমিও তালিকাভুক্ত হই। অবশ্য, ধর্মনিরপেক্ষ ও ‘নাস্তিক’ নামে পরিচিত আবুল ফজলের কন্যা হওয়ার কারণে ওই অফিসের প্রধান হুজুর ধরনের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধতায় আমার নামটি কয়েকবার তালিকা থেকে বাদ পড়ার পর চূড়ান্ত তালিকায় আমার নাম না দেখে সে সময়ের যুগ্ম সচিব ওই ব্যক্তিকে ডেকে ভর্ৎসনা করে নিজ হাতে আমার নামটি লেখেন ও স্বাক্ষর করে চূড়ান্ত করেন। উল্লেখ্য ’৭৪ সালেই আমি ‘সমাজবিজ্ঞানের রূপরেখা’ নামে একটি পাঠ্যবই লিখে কিছুটা পরিচিতি লাভ করেছিলাম। তবে বইটি যেমন ছাত্র-ছাত্রীদের প্রশংসা লাভ করেছিল, তেমনি কট্টরদের সমালোচনাও আকর্ষণ করেছিল। যা হোক, ওই প্রথম বাংলাদেশে কারিকুলাম বা শিক্ষাক্রম নিয়ে পরিকল্পিতভাবে কাজ করার সূচনা ঘটলে অবধারিতভাবে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টগুলো আমাদের জন্য প্রায় বাইবেল হয়ে ওঠে। আমাদের বস্্, হুজুর টাইপ হলেও কেমিস্ট্রি পড়া মানুষ, পাকিস্তানপন্থী হলেও বিজ্ঞানীর তৈরি প্রতিবেদনগুলোর বিষয়বস্তু নিয়ে আমাদের সঙ্গে বিশদ আলোচনায় মেতে উঠতেন। আমরাও উপকৃত হয়েছি এতে। মতিঝিলে অবস্থিত পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সঙ্গে এটি একই অফিসের দুটি বিভাগ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় সম্ভবত ’৮৫-’৮৬ সালে। উল্লেখ্য, তার আগে থেকেই আমরা প্রাথমিক স্তরের, অর্থাৎ ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত সব পাঠ্যবই পর্যালোচনা করে নতুন পাঠ্যবইয়ের শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও পাঠ্যবই রচনার কাজ শুরু করেছি। এখানে বলা ভাল, দেশে এক ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা থাকবে। থাকবে না ইংরেজী মাধ্যম ও মাদ্রাসা-এটি ছিল কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের প্রধান নির্দেশনা। যেটি নানা কারণে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এ প্রতিবেদনের দ্বিতীয় প্রধান নির্দেশনা ছিল-ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত মাতৃভাষাই হবে শিক্ষার মাধ্যম এবং একমাত্র ভাষা, বিদেশী ভাষা ইংরেজী শুরু হবে ক্লাস সিক্স থেকে-এটিও মানা সম্ভব হয়নি। সচিব-আমলা থেকে শুরু করে ইংরেজীতে পাস করা সব স্তরের শিক্ষকের প্রবল বিরোধিতার কবলে পড়ে ইংরেজীকে প্রথম দিকে তৃতীয় শ্রেণী থেকে শুরু করতে হলেও পরে ক্লাস ওয়ান থেকে শুরু করা হয়, শুনেছি এরশাদের নির্দেশে! এর বিরুদ্ধে তখন নবীন কলাম লেখক আমি কঠোর একটি লেখা দৈনিক সংবাদে লিখলে, ডিজি অফিস ও মন্ত্রণালয় সর্বত্র হৈচৈ পড়ে যায়। আমাকে বান্দরবানে বদলি করার কথা শোনা যায়। আমি পরিবারকে চাকরি না থাকা, পরিবারের জন্য খুব প্রয়োজনীয় আয় বন্ধ হতে পারে বলে মানসিকভাবে প্রস্তুত রয়েছি। পরে শেষ পর্যন্ত আমাকে সমর্থন করা এক পলিটেকনিক শিক্ষকের বদলি হয়। উদোর পি-ি বুধোর ঘাড়ে চাপে! এসব কূটনীতিতে আমলারা দৃঢ় ছিলেন। তবে শুনেছি, আবুল ফজলের কন্যাকে বদলি করাটা অনেকে সঠিক পন্থা মনে করেনি। এ সময় কুদরাত-এ-খুদার নির্দেশনা মেনে সব বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানকে সমন্বিত করে পরিবেশ পরিচিতি-সমাজ ও পরিবেশ পরিচিতি-বিজ্ঞান নামে নতুন আঙ্গিকে দুটি পাঠ্যপুস্তক তৈরি করা হয়। একই সঙ্গে নবম শ্রেণী থেকে মানবিক, বিজ্ঞান ও বাণিজ্য- এই তিনটি শাখায় ছাত্র-ছাত্রীদের ভাগ করে পাঠদান করা শুরু হয়। সবচেয়ে বড় কথা- কুদরাত-এ-খুদা কমিশনের প্রতিবেদনটিতে সংবিধানের চারটি মৌলনীতি- ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও বাঙালী জাতীয়তাবাদকে ভিত্তি করে শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, বিষয়ের উদ্দেশ্য, এর শিক্ষাক্রম, বিষয়বস্তু ও মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রণয়ন করা হয়েছিল। তা ছাড়া শিক্ষাক্রমে দেশের এক নম্বর সমস্যা জনসংখ্যা সমস্যাকে সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। তেমনি বিজ্ঞানকে হাতে কলমে কাজের বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল কুদরাতে খুদা কমিশনের প্রতিবেদনের নির্দেশে। নব্বইয়ের দশকে যখন যোগ্যতাভিত্তিক কারিকুলাম তৈরি হয়, তখন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ যেহেতু সংবিধান থেকে কর্তন করা হয়েছে এবং এরশাদের দ্বারা সংবিধানের মাথায় ‘আল্লাহর উপর বিশ্বাস’ যুক্ত হয়েছে, সেই বিষয়টি বড় হয়ে দেখা দেয়। এ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধপন্থী আমাদের সঙ্গে বিরোধীদের বহু তর্কবিতর্ক হয়েছে। ‘সব ধর্মের মানুষের সমানাধিকার’ ও সমতার বিষয়কে পাঠ্য বিষয়বস্তুতে রাখার একটি প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলাম আমরা একটি গোষ্ঠী। কুদরাত-এ-খুদা কমিশনের উল্লেখযোগ্য নির্দেশনা ছিল- সব ধর্মের আলাদা আলাদা পাঠ্যপুস্তক থাকবে না। বরং সব ধর্মের নৈতিক কাহিনী নিয়ে সমন্বিত ‘নীতিশিক্ষা’ নামের একটি বই থাকবে। এটিও বিশাল বিতর্কের ঝড় তুলেছিল। এমন কি ‘নীতিশিক্ষা’র একটি পাঠ্যবই তৈরিও হয়েছিল। পরে এটি শিক্ষকদের বাধায় প্রচলিত হতে পারেনি। চার ধর্মের চারটি ধর্মশিক্ষার বই প্রণীত হলো এবং প্রচলিত হলো। বক্তব্য হলো- কি কি করলে শিক্ষার মান ভাল হবে, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা অর্জিত হবে, শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পাঠ, খেলা ও কাজের মাধ্যমে শেখা, ধারাবাহিক মূল্যায়ন পদ্ধতি, নমনীয় প্রমোশন পলিসি, নীতি শিক্ষা, বিদেশী ভাষা শিক্ষা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিগত পঞ্চাশ বছরে দেখেছি শত শত সেমিনার, আলোচনা, কনফারেন্স হয়েছে। এখন আবার নতুনভাবে যোগ্যতা নির্ধারণ হচ্ছে, বিদেশীরা এসে মত দিচ্ছে, নতুন শিক্ষানীতি ২০১০ হয়েছে। এতে পঞ্চম শ্রেণী অন্তে পরীক্ষার নির্দেশনা না থাকলেও পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। ক্লাস এইট-অন্তেও পরীক্ষা। দশম শ্রেণী শেষে এসএসসি পরীক্ষা, দ্বাদশ শ্রেণী অন্তে এইচএসসি পরীক্ষার ওপর স্কুলের অর্ধবার্ষিক, বার্ষিক পরীক্ষাগুলো তো রয়েছেই। তার মানে অসংখ্য পরীক্ষার চাপে শিক্ষার্থীদের, বিশেষত দরিদ্র ও নিরক্ষরের সন্তানদের মৌলিক সাক্ষরতা দক্ষতা অর্জনে ভোগান্তি বেড়েছে। এবার অন্য প্রসঙ্গ। কথা হচ্ছে পাশের দেশ থেকে অভিজ্ঞতা নিতে হলে তাদের ব্যবস্থা ঘরে বসেই জানা যায়। ওখানে এত পরীক্ষা নিয়ে পাঠের সময় নষ্ট করা হয় না। ওখানে, পশ্চিমবঙ্গেও মিডডে মিল বা খিচুড়ি, ডিম বা মুরগির মাংসের তরকারি শিশুদের দুপুরে খেতে দেয়া হয়। এটা দরিদ্র শিশুদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি পূরণ করে তাদের মেধার বিকাশে সাহায্য করার লক্ষ্যে প্রবর্তন করা হয়েছে, যা ঝরে পড়াও রোধ করে। বাংলাদেশে প্রায় পনের-ষোল বছর আগে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল একটি গ্রামীণ এলাকায় কয়েকটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একদিকে মিডডে মিল, অপরদিকে স্কুল শুরুর আগে ঝরে পড়া ও পিছিয়ে পড়া শিশুদের জন্য শিক্ষাদানের ব্যবস্থা চালু করেছিল। যেটি শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ চালিয়ে যেতে যোগ্য করে তোলার লক্ষ্যে করা হত। এদের মিডডে মিল হিসেবে পুষ্টি বিস্কুট বিতরণ করা হতো। পরে এর আওতা দেশের সব সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিস্তৃত করা হয়। সম্ভবত এখন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রান্না করা খাবার দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। আমার মতে- বাজার করা, রান্না করা ও খাবার বিতরণ করার কাজটি যথেষ্ট ঝামেলাপূর্ণ। সে জন্য এলাকার একটি দলকে, হতে পারে ইউনিয়ন পরিষদের কোন সদস্যের নেতৃত্বে এই আয়োজনটির ম্যানেজমেন্টটি ছেড়ে দেয়া যেতে পারে। কোনভাবেই এমন ঝামেলা ও অর্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে স্কুল শিক্ষকরা যুক্ত থাকবেন না। মাসে একবার প্রধান শিক্ষক, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে ওই দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটি আয়-ব্যয়ের হিসাব দাখিল করবে। স্কুল ম্যানেজমেন্ট কমিটিও এ কাজটি করতে পারে। যারাই করবে, তারা কাজটি করার যোগ্য কিনা, আগ্রহী পরিচ্ছন্ন চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি কিনা, সেটিও দেখতে হবে। অর্থাৎ, ‘আউট সোর্সিং’ করেই রান্না করা মিডডে মিল দিতে হবে, যার রেগুলার অডিটও করতে হবে। শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমি কয়েকবার বিদেশে কনফারেন্সে, সেমিনারে গিয়েছি। এতে আমলা-প্রশাসকদের প্রয়োজন না থাকলেও কোন কোন সময় যেতে দেখেছি এবং কেনাকাটায় তাদের ভ্রমণ সীমিত দেখেছি। দু-একটি সফরে কোন হাত খরচ ছিল না, শুধু থাকা-খাওয়ার খরচ ইউনেস্কো দিয়েছে, এমন কোন বিদেশ ভ্রমণে কোন আমলাকে কখনও যেতে দেখিনি। এমনকি কেউ যাবে না বলে এক সেমিনারে আমার নাম দেয়া হয় বলে একা আমি গিয়েছি। শেষ কথা-সময় গড়িয়েছে অনেক। সুতরাং নতুন যোগ্যতা, নতুন কৌশল, নতুন ধ্যান-ধারণায় শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক, মূল্যায়ন ব্যবস্থা সমৃদ্ধ হবে-এটাই কাক্সিক্ষত ও স্বাভাবিক। তবে আমার মতে রান্না করা খাবার দেয়ার পরিবর্তে সিদ্ধ ডিম, এক মগ দুধ, একটা কলা, একটা বনরুটি-এই খাবার দেয়া উত্তম ব্যবস্থা হত বলে মনে করি। এতে দুর্নীতির সুযোগও কম থাকবে। কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখতে পারেন প্রস্তাবটি। কলার পরিবর্তে ঋতুভেদে অন্য ফলও দেয়া যায়। যা হোক, শিক্ষার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পুষ্টি প্রদানের কোন বিকল্প নেই। লেখক : শিক্ষাবিদ
×