ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে তরুণরা মাছ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন

প্রকাশিত: ১৩:০৮, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০

বাংলাদেশে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে তরুণরা মাছ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন

অনলাইন ডেস্ক ॥ বাংলাদেশের তরুণ মৎস্য চাষিদের মধ্যেই অনেকেই নতুন এক পদ্ধতিতে মাছ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন যার নাম বায়োফ্লক, যা দেশে মাছের উৎপাদন অতি দ্রুত বাড়ানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। মাছ চাষের এই পদ্ধতিটি বাংলাদেশে এসেছে মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে। এটি এমন একটি পদ্ধতি যেখানে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় অল্প জায়গায় বিপুল পরিমান মাছ চাষ করা হয়। সরকারের মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট বলছে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা কতটা সঠিক হবে কিংবা চাষিরা কতটা লাভবান হবেন, তা নিয়ে এখন তারা গবেষণা করছেন।বায়োফ্লক পদ্ধতি দেশের এ মূহুর্তে সব চেয়ে বড় প্রকল্প করছেন ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার সরাইলের জিহাদ আহমেদ। বিবিসি বাংলাকে তিনি জানান যে প্রচলিত পদ্ধতিতে মাছ চাষের চেয়ে এই পদ্ধতিটি সম্পূর্ণ আলাদা। "এখানে টেকনিক্যাল বিষয়গুলো সুচারুরূপে দেখতে হয়। আমি প্রায় ৩৯টি ট্যাংকে শিং, কই, মাগুর ও পাবদাসহ বেশ কয়েক ধরনের মাছ চাষ করছি"। নিজের ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে জেনে ২০১৮ সালে ইন্দোনেশিয়া গিয়ে বায়োফ্লকের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন জিহাদ আহমেদ, যিনি এর আগে পোলট্রি খামারের উদ্যোগ নিয়ে কার্যত ব্যর্থ হয়েছিলেন। বায়োফ্লক কি? মৎস্য গবেষকদের মতে, বায়োফ্লক এমন একটি পদ্ধতি যেখানে জৈব বর্জ্যের পুষ্টি থেকে পুনঃব্যবহারযোগ্য খাবার তৈরি করা হয়। অর্থাৎ যে ব্যাকটেরিয়া ও শৈবাল তৈরি হয় তা পানিতে উৎপন্ন হওয়া নাইট্রোজেন গঠিত জৈব বর্জ্যকে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে অ্যামোনিয়া গ্যাস তৈরি হতে না দিয়ে নিজেদের বংশ বাড়ায় এবং এটিকেই ফ্লক বলে। এসব ফ্লকে প্রচুর উপাদান থাকে, যা মাছের পুষ্টির যোগান দেয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন যে প্রোবায়োটিক কালচারের মাধ্যমে ফ্লক তৈরি করা হয়। ময়মনসিংহে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ডঃ মো. খলিলুর রহমান জানান, মূলত যে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় অল্প জায়গায় অনেক পরিমান মাছ চাষ করা হয়, সেই পদ্ধতিকেই বায়োফ্লক বলা হয়। তিনি বলেন, এতে পানির মধ্যে বিশেষ কায়দায় ব্যাকটেরিয়া তৈরি করা হয় এবং সেটাই মাছের খাবারকে রিসাইকেল করে - আবার এটা পানি পরিশোধন করতেও সক্ষম। "তবে মনে রাখতে হবে পানিতে নাইট্রোজেন আর কার্বনের ব্যালেন্স ঠিকমতো না হলে এটা কাজ করবে না এবং মাছ মারা যাবে। অর্থাৎ পদ্ধতিটির সঠিক প্রয়োগ না হলে মাছের রোগ হবে বা মাছ মারা যাবে।" এ কারণে বায়োফ্লক পদ্ধতির জন্য আলাদা ব্যবস্থাপনার দরকার হয়, যা অনেক সময় ব্যয় বাড়িয়ে দিতে পারে বলে জানান ডঃ রহমান। তিনি বলেন, এ পদ্ধতির মাছ চাষের অবকাঠামোতে সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে এবং মাছের ট্যাংকের পানি পরিবর্তন করা যাবে না।মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক বলেন, অনেকে বায়োফ্লক পদ্ধতির ক্ষেত্রে লবণাক্ত পানি ব্যবহারের পরামর্শ দেন, যা ঠিক নয়। "সাধারণভাবে মাছ চাষের ক্ষেত্রে আমরা একটি নির্দিষ্ট সময়ে প্রতি শতাংশে আড়াইশো গ্রাম লবণ দিতে বলি, যা মাছকে রোগমুক্ত রাখতে সহায়তা করে। এখানেও সেটি হতে পারে। তবে বায়োফ্লকের জন্য লবণাক্ত পানি লাগবে, এটি সঠিক তথ্য নয়"। বায়োফ্লকে মাছের ট্যাংক যেমন হয় : একেবারে শুরুতে সাধারণত একটি খাচার মতো তৈরি করা হয়, যার নিচের দিকে ঢালাই দিয়ে মাটির সাথে আটকে দেয়া যেতে পারে। এর ঠিক মাঝামাছি জায়গায় পানির পাইপ সেট করা হয়। অনেকে ঢালাই না করে পলিথিন দিয়েও মেঝের জায়গা প্রস্তুত করে। পরে ওপর থেকে খাচাটি ঢেকে দিতে হবে। আর মেঝেতে পুরু পলিথিন দিয়ে পানি রাখতে হবে। পানির তাপমাত্রা ২৪-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে হবে, আর পানির রং হবে সবুজ, হালকা সবুজ বা বাদামী। এর দ্রবীভূত অক্সিজেন, পিএইচ, ক্ষারত্ব, খরতা, ক্যালসিয়াম, অ্যামোনিয়া, নাইট্রেইট, ফসফরাস, আয়রন, পানির স্বচ্ছতা, গভীরতা, লবণাক্ততা - এগুলোসহ সবকিছুর সুনির্দিষ্ট পরিমাণ মেনে ব্যবস্থা নিতে হয়। এরপর পানিতে দরকারি সব উপাদান ঠিক মতো দিয়ে ফ্লক তৈরি করতে হয়, যার জন্য দরকার হয় সার্বক্ষনিক অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা। ঠিক মতো ফ্লক তৈরি হলে পানির রং হবে সবুজ বা বাদামি, আর পানিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা দেখা যাবে। বায়োফ্লকের বৈশিষ্ট্য : কৃষি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ গত ১৯শে সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি পত্রিকায় লিখেছেন যে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ উৎপাদনের অঙ্ক ও বাণিজ্য হচ্ছে অল্প জায়গায় অধিক মাছ।এর বাইরেও এটি মাছের খাবারের অপচয় কমিয়ে দেয়, নাইট্রোজেন গঠিত বর্জ্যকে মাইক্রোবিয়াল প্রোটিনে রূপান্তর করে এবং পানিতে জৈব বর্জ্য জমা হওয়া প্রতিরোধ করে। মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ডঃ রহমান জানান, বায়োফ্লক পদ্ধতিতে ব্যবহৃত পানিতে দুর্গন্ধ থাকে না এবং পানি পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় না। "এ পদ্ধতিতে পানির গুনগত মান বজায় থাকে, কারণ রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ হয় এক্ষেত্রে"। ঝুঁকি আছে? ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার সরাইলের জিহাদ আহমেদ বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে আলোচনায় এসেছেন নিজ এলাকা এবং এর বাইরেও। আর তাকে অনুসরণ করে ওই এলাকায় আরও অনেকে এই পদ্ধতিতে মাছ চাষে আগ্রহী হয়েছেন। এসব কারণে ওই এলাকার উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মায়মুনা জাহান নিজ উদ্যোগেই জেলা মৎস্য কর্মকর্তাসহ মিস্টার আহমেদের বায়োফ্লক পরিদর্শন করেছেন সম্প্রতি। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, "উনার যে ফিশট্যাংক দেখলাম তাতে মনে হচ্ছে উনি কাজটা করতে পারছেন। মাছগুলোও তরতাজা আছে। তবে এ এলাকায় অনেকেই চেষ্টা করে পারেননি।" তিনি আরও বলেন, এখানে প্রতিমূহুর্তে ট্যাংকের ভেতরের পানিতে নানা পরিবর্তন হয় যেগুলো মনিটরিং করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হয়। উনার লোকজন আছে বলে সেটি তিনি করতে পারছেন। তবে চাষে সাফল্য কতটা এসেছে, সেটি আমাদের এখনও জানা নেই। বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের ভবিষ্যৎ কেমন দেখছেন, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, "ভালোভাবে নিয়ম মেনে সবকিছু করতে পারলে লাভ। কিন্তু ক্ষতি হলে হবে বড় ক্ষতি"। তিনি জানান যে ওই এলাকাতেই আরও কয়েকজন বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের উদ্যোগ নিলেও তাদের ক্ষেত্রে খুব একটা সাফল্য আসেনি। কতদিনে বিক্রির উপযোগী হয় মাছ? মৎস্য কর্মকর্তা মায়মুনা জাহান জানান, সঠিকভাবে চাষ করতে পারলে তিন মাসের মধ্যে মাছ বিক্রির উপযোগী হতে পারে। "এখানে মাছ খাবার খায় আর বড় হয় - এটাই এর মুল থিম। অক্সিজেন ভালো থাকার কারণে মাছগুলো আনন্দে থাকে, যেটা পুকুরে সবসময় হয় না। একটা কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি হয়, যেখানে মাছ দ্রুত বড় হয়"। মাছ চাষি জিহাদ আহমেদ অবশ্য আরও খানিকটা সময় দেন মাছ বড় করতে। তিনি বলেন, বাজারে মাছ বিক্রির উপযোগী হতে চার মাস সময়ই যথেষ্ট। প্রত্যেক প্রজাতির মাছের জন্য চাই আলাদা ব্যবস্থাপনা: গবেষক ও মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, বায়োফ্লকের রসায়ন ঠিকমতো জানা না থাকলে এতে সাফল্য পাওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ এতে প্রত্যেক মাছের প্রজাতির জন্য আলাদা ধরণের পরিচর্যা বা ব্যবস্থাপনার দরকার হতে পারে।মৎস্য কর্মকর্তা মায়মুনা জাহান জানান যে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো মাছ চাষের পানিকে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ের প্রস্তুত করা। "ট্যাংকের পরিবেশ ও পানির ব্যবস্থাপনা প্রতি মূহুর্তে নিশ্চিত করার পাশাপাশি দরকার হবে ভালো মানের মাছের পোনা। লবণাক্ততা, অ্যামোনিয়া, অক্সিজেন কিংবা টিডিএস সঠিক মাত্রায় থাকতেই হবে," বলছিলেন তিনি। পরীক্ষা করে দেখছে মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট: ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার জিহাদ আহমেদের মতো অনেকেই অবশ্য এরই মধ্যে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষে ঝুঁকেছেন, কারণ খুব অল্প জায়গায় বিপুল পরিমান মাছ চাষ সম্ভব হচ্ছে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে।আগ্রহ দেখাচ্ছেন আরও অনেক তরুণ মাছ চাষি। তবে ডঃ খলিলুর রহমান মনে করছেন যে বায়োফ্লক যেহেতু মাছ চাষের একটি নতুন টেকনিক, তাই এক্ষেত্রে বুঝেশুনে এগুতে হবে। "আমরা পরীক্ষা করে দেখছি। এক্সপেরিমেন্ট এখনো চলছে। এর ফল হাতে পাওয়ার পর আমরা হিসেব করে দেখবো যে এতে কেমন ব্যয় হয় কিংবা মৎস্য চাষিরা এতে লাভবান হবেন কি-না"। বায়োফ্লক ধারণা: বিস্তার ঘটছে: জিহাদ আহমেদ নিজেই বিবিসিকে জানান যে এ পর্যন্ত অনেক আগ্রহী ব্যক্তিকে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন এবং তারা এখন এ পদ্ধতি অনুসরণ করে মাছ চাষ করছেন। "এটার এখন ব্যাপক বিস্তৃতি হচ্ছে। আমারই দু'হাজার ছাত্র আছে," বলছিলেন তিনি। ধারণা করা হচ্ছে, মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রের প্রকল্প শেষ হলে এবং তাতে বিষয়টি ইতিবাচকভাবে উঠে এলে বাংলাদেশে আগামীতে বায়োফ্লকের আরও বিস্তার ঘটবে। ডঃ খলিলুর রহমান বলছেন, "আমরা সতর্ক থেকে বায়োফ্লক নিয়ে কাজ করছি, যাতে করে উদ্যোক্তারা পরে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আমরা বলে দিলাম আর লোকজন শুরু করে ক্ষতির শিকার হলো - এমনটি আমরা চাই না"। তবে সরকারিভাবে কী বলা হবে তার অপেক্ষা না করেই যেমন অনেকে নিজ উদ্যোগে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরু করেছেন, তেমনি এই পদ্ধতিতে মাছ চাষের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণও সহজলভ্য হয়ে উঠছে বাংলাদেশে। সূত্র : বিবিসি বাংলা
×