ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইন্ধনে বিএনপি ও জামায়াত-শিবির

হাটহাজারী মাদ্রাসায় ছাত্র আন্দোলন দীর্ঘদিনের ক্ষোভের ফসল

প্রকাশিত: ২৩:১৯, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০

হাটহাজারী মাদ্রাসায় ছাত্র আন্দোলন দীর্ঘদিনের ক্ষোভের ফসল

স্টাফ রিপোর্র্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কার্যালয় হিসেবে পরিচিত হাটহাজারী দারুল উলুম মাদ্রাসায় ছাত্র আন্দোলন দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের ফসল, যার সূত্রপাত ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বর থেকে। সেদিন লাখো কওমি ছাত্র-জনতাকে পুলিশের তোপের মুখে ফেলে চট্টগ্রামে চলে আসেন আল্লামা শফী ও তার ছেলে আনাস মাদানী। সেই থেকে চরম অসন্তোষ দানাবাঁধে কওমি আলেম-ওলামা ও ছাত্রদের মাঝে। এতে মূলত দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে কওমি আলেম-ওলামা ও ছাত্ররা সমাজ। সেই ইস্যুকে কেন্দ্র করে আল্লামা শাহ আহমদ শফী ও জুনায়েদ বাবুনগরীর মধ্যে বিরোধ তুষের আগুনের মতো জ্বলতে শুরু করে। অনুসন্ধানে যে তথ্যগুলো পাওয়া যায় তন্মধ্যে কয়েকটি কারণ খোলাসা হয়ে উঠে। প্রথমত ৫ মে শাপলা চত্বরের জমায়েতকে ঝুঁকিতে ফেলে আল্লামা শফী ও তাঁর পুত্র চলে আসা, দ্বিতীয়ত পরবর্তীতে কওমি সনদ স্বীকৃতির জন্য প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দেয়া, তৃতীয়ত শফীপুত্র মাওলানা আনাস মাদানীর তার পিতাকে নানাভাবে প্রলুব্ধ করা, হেফাজতের প্রভাব কাটিয়ে ছাত্রদের নানাভাবে হয়রানি, অর্থ লোপাট, শিক্ষকদের প্রতি খারাপ আচরণ, অর্থের বিনিময়ে কওমি নিয়মনীতি উপেক্ষা করে কওমি ধারার বিভিন্ন মাদ্রাসায় মোহতামিম বা পরিচালক নিয়োগ দেয়া, চতুর্থত আনাস মাদানী সরকারের এজেন্ট হিসাবে ব্যবহৃত হওয়ার অভিযোগ এবং পঞ্চমত উল্লিখিত কারণগুলো নিয়ে হেফাজতের নায়েবে আমির আল্লামা মহিবুল্লাহ বাবুনগরী, মুফতি ইজাহারুলসহ অনেক শীর্ষ আলেমগণের মধ্যে মতবিরোধ। এসব মিলে শফীপুত্র আনাস মাদানীর ওপর এত ক্ষোভ। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, আনাস মাদানী শুধু নিজের স্বার্থে পিতাকে অন্যায় পথে পরিচালনা করেননি, ক্ষমতা কুক্ষিগত করে প্রভাব বিস্তারও করেছেন হাটহাজারী মাদ্রাসায়। কওমি মাদ্রাসা বোর্ড বেফাক ও হেফাজতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছেন। করেছেন সিনিয়র নেতাদের অবমূল্যায়ন। করেছেন মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত, নিয়োগ বাণিজ্য। গড়েছেন অঢেল সম্পদ। সরকারের দালাল হিসেবেও চিহ্নিত হয়েছেন মাদানী, যার ফসল এই ছাত্র আন্দোলন। এ আন্দোলনে নেপথ্যে থেকে জামায়াত-শিবির-বিএনপি জোট বেঁধে হাটহাজারী মাদ্রাসায় ছাত্র আন্দোলনে ভূমিকা রাখে। তারা একদিকে আনাস মাদানীকে সরিয়ে দিতে আন্দোলনে নানা কৌশলে সহায়তা করে এবং অন্যদিকে আল্লামা শফীর মৃত্যুর পর শনিবার অনুষ্ঠিত আল্লামা শফীর জানাজায় সম্মুখসারিতে থেকে কফিন কাঁধে নিয়ে শেষ বিদায় জানায়! সূত্রগুলো আরও জানায়, বড় হুজুর হিসাবে আল্লামা শফীর ওপর জামায়াত-শিবির-বিএনপির অকৃত্রিম ভালবাসা থাকলেও তাঁর পুত্র মাওলানা আনাস মাদানীকে যে কোনভাবে সরিয়ে সরকারী বলয়কে নস্যাৎ করাই মূল উদ্দেশ্য ছিল। তবে কাজের কাজ তাহাই হয়েছে। গত ১১ সেপ্টেম্বর আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর গ্রামের বাড়ি বাবুনগরে তাঁর একমাত্র ছেলের বিবাহত্তোর ওয়ালিমার আয়োজন করা হয়। এ ওয়ালিমায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বাবুনগরীর অনুগত হেফাজত নেতা, বিভিন্ন কওমি মাদ্রাসার নেতা, আলেম ওলামাসহ কিছু জামায়াত-শিবির-বিএনপিপন্থী ব্যক্তিত্ব দাওয়াতে অংশগ্রহণ করেন। ঐদিন জুমার নামাজ আদায় করে মধ্যাহৃ ভোজ শেষে হাটহাজারী মাদ্রাসার সার্বিক পরিস্থিতিতে আল্লামা শফীপুত্র মাওলানা আনাস মাদানীকে সরিয়ে নেয়া ও মাদ্রাসাকে আনাসের গ্রাস থেকে রক্ষা করে সঠিক পথে মাদ্রাসার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে ছাত্র আন্দোলনের নীলনক্সা করা হয় বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়। এমনকি আন্দোলনের আগে সব বিষয় খুব গোপন রাখা হয়। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৬ সেপ্টেম্বর বুধবার বাদ জোহর ছাত্র আন্দোলনের সূচনা করে। জামায়াত-শিবির-বিএনপি সমর্থিত শত শত কর্মী মাদ্রাসার ছাত্রবেশে আগেই কৌশলে ঢুকে পড়ে। সূত্রটি আরও জানায়, বুধবার রাতে বহিরাগত কিছু নামধারী ছাত্র (যারা সরকারবিরোধী) মাদ্রাসার কয়েকটি কক্ষ ভাংচর করে মাদ্রাসার ভিতর ত্রাস সৃষ্টি করে। এর আগে পূর্বপরিকল্পিত ঐ বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাদ্রাসার প্রধান ফটকসহ সব ফটক ভিতর থেকে বন্ধ করে দেয়ায় প্রশাসন শত চেষ্টা করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি; বরং আন্দোলনরত ছাত্ররা মসজিদের মাইক দিয়ে মাদ্রাসার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার জন্য দফায় দফায় ঘোষণা দেয়। বিভিন্ন সময়ে বিরোধ ও বিবৃতি নিয়ে কওমি সমর্থকরা সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যমে নানারকম পোস্ট দিলেও এই ছাত্র আন্দোলন নিয়ে নীরব রয়েছেন। কোন কথা বলছেন না আল্লামা শফীর অনুসারীরাও। এ বিষয়ে কথা বলতে বারবার ফোন করা হলেও কেটে দেন আনাস মাদানী। এদিকে হাটহাজারী মাদ্রাসার এক সিনিয়র শিক্ষকের সাক্ষাতকার ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করা হয়। ওই সাক্ষাতকারে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে বিষোদগার করে বক্তব্য রাখেন। ঐদিন এ ভিডিও ভাইরাল হয়ে পড়ে। পরে রবিবার রাতে ঐ শিক্ষক বাবুনগরীর দফতরে গিয়ে ক্ষমা চান।
×