ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দেশে বিদেশী ফলের চাষ

টক টক মিষ্টি স্বাদের সবুজ মাল্টা ॥ ফলন ভাল, দাম কম

প্রকাশিত: ২৩:১৪, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০

টক টক মিষ্টি স্বাদের সবুজ মাল্টা ॥ ফলন ভাল, দাম কম

জাহাঙ্গীর আলম শাহীন ॥ বিদেশী ফল মাল্টা এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে লালমনিরহাট শহরে হাঁড়ি ভাঙ্গায়। বছরে ৪০ লাখ টাকার ফল বিক্রির টার্গেট নির্ধারণ করেছে ফল চাষী একরামুল (৩৮)। ইতোমধ্যেই বছরের শুরুতে ১৫ লাখ টাকার বিদেশী টক মিষ্টি সুস্বাদু মাল্টা ও বর্ষাকালীন পেয়ারা বিক্রি করেছে। এখন ফলের এই বাগানটিতে প্রায় ১০/১৫ লাখ টাকার মাল্টা, কমলা, চাইনিজ কমলা ও বর্ষাকালীন পেয়ারা আছে, যা পর্যায়ক্রমে বিক্রি করতে দুই/তিন মাস সময় লাগবে। ফলের বাগানটিতে পর্যায়ক্রমে ২৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে সফল ফল চাষী একরামুল (৩৮)। তিনি উৎপাদন খরচ বাদে প্রতিবছর কমপক্ষে ৪০ লাখ টাকা আয় হবে বলে আশা করছেন। এতে ১০ বছরে কম পক্ষে ৪০ কোটি টাকা আয় করার টার্গেট আছে। লালমনিরহাট জেলা শহরের হাঁড়ি ভাঙ্গায় ৬ একর জমি বছরের ৪৬ হাজার টাকা লিজ নিয়ে করা হয়েছে এই বিশাল মাল্টা, কমলা ও পেয়ারা ফলের বাগান। সেখানে সাথী ফসল হিসেবে মাল্টা, দার্জিলিংয়ের কমলা, চাইনিজ কমলা ও বর্ষাকালীন থাই সেভেন ও থাই ফাইভ পেয়ারার বাগান একই সঙ্গে করা হয়েছে। এই ফলের বাগানকে বলা হয় সাথী ফলের বাগান। এই বিশাল ফলের বাগান ফলের জমি লিজ চারা রোপণ, পরিচর্যা, সংরক্ষণ ও বাণিজ্যিক উৎপাদন পর্যন্ত আসতে এক বছরে ব্যয় হয়েছে পর্যাক্রমে প্রায় ২৫ লাখ টাকা। এক বছর নিবিড় পরিচর্যার পর সুস্বাদু মিষ্টি রসাল বিদেশী ফল মাল্টা বাণিজ্যকভাবে লালমনিরহাটের স্থানীয় বাজারে উঠেছে। সবুজ রঙের এই মাল্টা খেতে খুবই সুস্বাদু। টক টক মিষ্টি স্বাদের মাল্টা লালমনিরহাটের বাজারের অলিতে গলিতে পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি গ্রামের হাটবাজারেও পাওয়া যাচ্ছে। দামে বিদেশী আমদানি মাল্টার চেয়ে সস্তা। বিদেশী মাল্টা প্রতি কেজি ১৮০ টাকা। দেশী সবুজ রঙের মাল্টা প্রতি কেজি পাওয়া যাচ্ছে ১২০ টাকা দরে। বিদেশী ফল মাল্টা বাগানের সফল উদ্যোক্তা নার্সারি ব্যবসায়ী একরামুল (৩৮) জানান, নার্সারি ব্যবসা দিয়ে জীবন শুরু করি। জীবনের শুরুতে নানা চড়াই-উৎরাই পাড় করেছি। করেছি অনেক কষ্ট। নার্সারি ব্যবসায় জড়িত থাকার সুবাদে যশোরের এক বন্ধুর মাধ্যমে সবুজ রঙের এই মাল্টা চাষের সংবাদ পাই।এই মাল্টা বাগান প্রথমে যশোরে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে সফলতা আসে। সেখানে গিয়ে মাল্টার স্বাদ গ্রহণ করি। খেতে খুবেই সুস্বাদ। হালকা টক টক মিষ্টি মিষ্টি। স্বাদ বিদেশী মাল্টার চেয়ে একটু অন্য রকম। খুবেই সুস্বাদ। জেলা শহরের হাঁড়ি ভাঙ্গায় ৬ একর জমি ১০ বছরের জন্য লিজ নেই। প্রতি বছর লিজ দিতে হয় ৪৬ হাজার টাকা। জমি যখন লিজ নেই। তখন জমিটি ছিল পরিত্যক্ত ও বালুকাময়। এই জমিতে তেমন কোন আবাদ হতো না। তাই তাঁকে লিজ দেয়া হয়। জমি লিজ নিয়ে শুরু হয় জমির উর্বরাশক্তির কাজ। উঁচু নিচু জমি অন্যত্র হতে মাটি এনে সমান করা হয়। ফেলা হয় গবর ও জৈব সার। প্রয়োজন মতো দেয়া হয় রাসায়নিক সার। বাগান করার মতো জমি উর্বর হলে যশোহর শহর হতে সবুজ রঙের বারি ওয়ান জাতের মাল্টার কলমের চারা (১৫০ টাকা), দার্জিরিংয়ের কমলার কলমের চারা (২০০ টাকা), চাইনিজ কমলার কলমের চারা (২০০ টাকা) ও বর্ষাকালীন পেয়ারা থাই সেভেন ও বর্ষাকালীন পেয়ারা থাই ফাইভ কলমের চারা (৫০ টাকা) দরে কিনে এনে রোপণ করি। চারা রোপণের কম পক্ষে ১৫ দিন আগে সারি বদ্ধভাবে গর্ত করা হয়। সেই গর্তে দেয়া হয় গোবর সার, জৈব সার ও রাসায়নিক সার। গর্তে যখন প্রস্তুত হয় তখন রোপণ করা হয় চারা। তার এই ৬ একরের বাগানে সাথী ফসল হিসেবে বিদেশী ফল সবুজ রঙের বারি ওয়ান জাতের মাল্টা, দার্জিলিংয়ের কমলা, চাইনিচ কমলা ও বর্ষাকালীন পেয়ারা গাছ একই সঙ্গে রোপণ করা হয়। সবুজ রঙের বারি জাতের মাল্টার গাছ আছে ২ হাজার ৮শ’টি, দার্জিলিংয়ের কমলার গাছ আছে ৪শ’টি, চাইনিজ জাতের কমলার গাছ আছে দুশটি ও বর্ষাকালীন থাই সেভেন ও বর্ষাকালীন থাই ফাইভ জাতের পেয়ারা গাছ আছে দুই হাজারটি। এক বছর রোপণ ও পরিচর্যার পর প্রথমে এখন হতে প্রায় দেড় মাস আগে উৎপাদনে আসে বর্ষাকালীন থাই সেভেন ও ফাইভ জাতের পেয়ারা। প্রতিটি গাছে প্রায় এক মণ করে পেয়ারা উৎপাদন হয়েছে। বর্ষাকালীন পেয়ারার বাজার দাম পেয়ারা মৌসুমের পেয়ারার চেয়ে একটু দামে সস্তা। তাই প্রতিমন পেয়ারা পাইকারিভাবে বিক্রি হয়েছে ১৫/১৬ হাজার টাকা দরে। পাইকারগণ বাগানে এসে নগদ অর্থে মণ ধরা কিনে নিয়ে যায়। এবারের করোনাকালীন সময়ে পরিবহন ব্যবস্থা নাজুক থাকায় পেয়ারা স্থানীয় বাজারের বিক্রি করতে হয়েছে। তাই কিছুটা সস্তায় বিক্রি করতে হয়। ইতোমধ্যে বর্ষাকালীন পেয়ারা বিক্রি হয়েছে প্রায় ৭ লাখ টাকার। বাগানে এখনও কয়েক লাখ টাকার পেয়ারা অবিক্রীত অবস্থায় আছে। প্রতিদিন পরিপক্ব পেয়ারা বাগানের গাছ হতে ছিঁড়ে বিক্রি করা হচ্ছে। পেয়ারা আরও দুই/তিন মাস বিক্রি করা যাবে। বর্ষাকালীন পেয়ারা গাছের ফাঁকে ফাঁকে লাগানো হয়েছে বারি ওয়ান জাতের সবুজ রঙের বিদেশী ফল মাল্টা। এক বছর বয়সী মাল্টা গাছে এবারেই প্রথম ফলন এসেছে। প্রতিটি গাছে গড়ে ৪০/৫০টি মাল্টা ধরেছে। ৫টি মাল্টা মিলে এক কেজি ওজন হয়। বাগানে পাইকারিভাবে প্রতি কেজি মাল্টা ১০০ টকা দরে বিক্রি করা হয়। প্রথম দফায় প্রায় ৭ লাখ টাকার মাল্টা বিক্রি করা হয়েছে। এখনও থোকায় থোকায় মাল্টা গাছে শোভা পাচ্ছে। প্রতিদিন প্রতিটি গাছ হতে পরিপক্ব মাল্টা দেখে দেখে ছিঁড়ে তোলা হচ্ছে। এভাবে এই বাগানের মাল্টা আরও দুই/ তিন মাস উৎপাদন হবে। এখনও কয়েক লাখ টাকার মাল্টা বাগানে আছে। মাল্টার উৎপাদন শেষ হতে না হতেই শীতের শুরুতে দার্জিলিংয়ের কমলা বাগান হতে উৎপাদন শুরু হবে। একই সঙ্গে উৎপাদন শুরু হবে চাইনিজ কমলার। আশা করছি এ বছরই বাগান রোপণের সমস্ত খরচ উঠে আসবে। প্রতি বছর বাগানের উৎপাদন বাড়বে। তবে পরিচর্যার খরচ কমে আসবে। প্রথস বার জমি তৈরি ও চারা রোপণের খরচ হয়ে ছিল। এখন বাগান গড়ে উঠেছে। এখন আর জমি তৈরি ও চারা রোপণের খরচ লাগবে না। শুধুমাত্র জৈব সার, বালাই নাশক ও পরিচর্যার খরচ লাগবে। স্থানীয় ফল ব্যবসায়ী নূর মোহাম্মদ জানান, এই ফলের বাগান ছাড়াও জেলায় বেশ কিছু মৌসুমি ফলের বাগান রয়েছে। এখন কোন ফল অন্য জেলা হতে আনতে হয় না। এই জেলায় প্রায় সব ধরনের ফল বাগানে উৎপাদন করছে কৃষক। মাল্টা ও কমলা এখানে চাষ হবে। সেই মাল্টা ও কমলা সুস্বাদু ও মিষ্টি হবে। এটা ভাবনার বাহিরে ছিল। ফল চাষি একরামুল ভাই সেই ধারণা পাল্টে দিয়েছে। তিনি মিষ্টি সুস্বাদু মাল্টা ও কমলা উৎপাদন ও বাজার জাত করে দেখিয়ে দিয়েছে। এখানে মাল্টা ও কমলা চাষ সম্ভব। এই ফল চাষ অত্যন্ত লাভ জনক। একবার বাগান উৎপাদনে গেলে আর পিছনে ফেলে তাকাতে হয় না। শুধু সঠিক সময়ে সঠিক পরিচর্যা করলে প্রতিবছর উৎপাদন বাড়বে। একরামুল ৬ একরের বাগানের পাশা পাশি নিজ বাড়ির ৪০ শতাংশ জমিতে মাল্টার বাগান করেছে। রংপুর ও মিটা পুকুরেও জমি লিজ নিয়ে বাগান ও নার্সারি করেছে। প্রতিমাসে তাঁর সকল খরচ দিয়ে প্রায় ২/৩ লাখ টাকা মাসিক আয় আসে। তবে তিনি দুঃখ করে বলেন, তার এত বড় বাগান। কোনদিন কোন সরকারী কৃষি কর্মকর্তা তার খোঁজ নিতে এলো না। প্রতিদিন কম সাধারণ মানুষ বাগানে বেড়াতে আসে। নানা রকম উৎসাহব্যঞ্জক কথা বলে। সাফল্য দেখে খুশি হয়। আমিও তাদের বলি। আপনার বাগান করেন। সহায়তা করব। নিজের পায়ে দাঁড়ান। এমন প্রকৃতি, উর্বর মাটি ও সোনার দেশ থাকতে। পরবাসে যাওয়ার কোন দরকার নেই। এ দেশেই কৃষিতে লাখ লাখ টাকা মাসিক আয় করা সম্ভব। ক্ষুদ্র পরিসরে শুরু করুন। আজই শুরু করুন। আগামী দিনের জন্য ফেলে রাখবেন না। লালমনিরহাটের বাজারের দেশের উৎপাদিত বিদেশী ফল মাল্টা কম দামে পেয়ে ক্রেতারা দারুণ খুশি স্বাদেও অনন্য। কৃষক একরামুল সফলভাবে সুস্বাদু মিষ্টি ও রসালো মাল্টা চাষ করে রীতিমতো হৈ চৈ ফেরে দিয়েছে। সবার দৃষ্টি এখন মাল্টা বাগানের দিকে।
×