ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ডিজির গাড়িচালক হয়ে স্বাস্থ্যে মালেকের পারিবারিক রাজত্ব

প্রকাশিত: ২২:৫৯, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০

ডিজির গাড়িচালক হয়ে স্বাস্থ্যে মালেকের পারিবারিক রাজত্ব

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের গাড়িচালক হয়ে আব্দুল মালেক পারিবারিক রাজত্ব কায়েম করেছে অধিদফতরে। সে সিন্ডিকেট করে সীমাহীন দুর্নীতির মাধ্যমে নিজের মেয়ে-জামাই-ভাইসহ পরিবারের ১২ জনকে স্বাস্থ্য অধিদফতরে চাকরি দিয়েছে। এছাড়া মহাপরিচালকের জন্য বরাদ্দকৃত পাজেরো জিপসহ তিনটি গাড়ি নিজে ও তার পরিবারের লোকজন নিয়মিত ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করে। তৃতীয় শ্রেণীর সাধারণ কর্মচারী হয়েও এভাবে অবৈধ পথে আয় করে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি, দামী পাজেরো গাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ শত কোটি টাকার সম্পদ গড়া গ্রেফতারকৃত স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়িচালক আব্দুল মালেককে ১৪ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। অবৈধ অস্ত্র ও জাল টাকা উদ্ধারের ঘটনায় করা পৃথক দুই মামলায় সোমবার এই রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত। এদিকে গ্রেফতারের পর স্বাস্থ্য অধিদফতরের মালেকের অপকর্মের কথা ফাঁস হতে শুরু হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, রবিবার ভোরে র‌্যাব-১ এর একটি দল রাজধানীর তুরাগ কামারপাড়ার বামনেরটেক এলাকার ৪২ নম্বর হাজী কমপ্লেক্সের বিলাসবহুল সাত তলা নিজ বাড়ির তৃতীয়তলা থেকে তাকে গ্রেফতার করে। সেখানে তার কাছ থেকে একটি বিদেশী পিস্তল, একটি ম্যাগজিন, পাঁচ রাউন্ড গুলি, দেড় লাখ বাংলাদেশী জালনোট, একটি ল্যাপটপ ও মোবাইল উদ্ধার করা হয়। তাকে গ্রেফতারের পর আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে র‌্যাব। এরপর জানা যায়, বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত রয়েছে তার। এছাড়া তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। র‌্যাব জানায়, শুধু স্বাস্থ্য অধিদফতরের তদ্বিরবাজি করে বিপুল অর্থের মালিক বনেছে। পাশাপাশি অবৈধ অস্ত্র-জালনোটের কারবারের পাশাপাশি চাঁদাবাজি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন আব্দুল মালেক ওরফে বাদল ওরফে ড্রাইভার মালেক। র‌্যাবের হাতে গ্রেফতারের পর মালেক প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অবৈধ অস্ত্রের কারবার, জালনোটের কারবারসহ চাঁদাবাজি করে টাকা হাতিয়ে নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত মালেক জানান, তিনি পেশায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিবহন পুলের একজন ড্রাইভার এবং তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা ৮ম শ্রেণী পাস। তিনি ১৯৮২ সালে সর্বপ্রথম সাভার স্বাস্থ্য প্রকল্পে ড্রাইভার হিসেবে যোগদান করেন। পরে ১৯৮৬ সালে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিবহন পুলে ড্রাইভার হিসেবে চাকরি শুরু করেন। বর্তমানে তিনি প্রেষণে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা অধিদফতরে কর্মরত রয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, মালেকের স্ত্রীর নামে দক্ষিণ কামারপাড়ায় ২টি সাততলা বিলাসবহুল ভবন আছে। ধানম-ির হাতিরপুল এলাকায় ৪.৫ কাঠা জমিতে একটি নির্মাণাধীন ১০ তলা ভবন আছে এবং দক্ষিণ কামারপাড়ায় ১৫ কাঠা জমিতে একটি ডেইরি ফার্ম আছে। এছাড়াও বিভিন্ন ব্যাংকে নামে- বেনামে বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত আছে বলেও জানা যায়। জানা গেছে, মালেক ড্রাইভার দুটি বিয়ে করেছেন। প্রথম স্ত্রী নার্গিস আক্তারের নামে তুরাগ থানাধীন দক্ষিণ কামারপাড়া রমজান মার্কেটের উত্তর পাশে ছয় কাঠা জায়গার ওপর সাততলার (হাজী কমপ্লেক্স) দুটি আবাসিক বিল্ডিং রয়েছে। যাতে মোট ২৪টি ফ্ল্যাট রয়েছে। এছাড়া আনুমানিক আরও ১০/১২ কাঠার প্লট রয়েছে। বর্তমানে সপরিবারে এই ভবনেরই তৃতীয়তলায় বসবাস করে মালেক। বাকি ফ্ল্যাটগুলোর কয়েকটি ভাড়া দেয়া রয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ড্রাইভার মালেকের মেয়ে বেবির নামে দক্ষিণ কামারপাড়া, ৭০ নম্বর রাজাবাড়ী হোল্ডিংয়ে প্রায় ১৫ কাঠা জায়গার ওপর ‘ইমন ডেইরি ফার্ম’ নামে একটি গরুর খামার রয়েছে। সেখানে প্রায় ৫০টি বাছুরসহ গাভী রয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সাবেক এক মহাপরিচালকের গাড়িচালক মালেক ছিলেন তার আস্থাভাজন। মালেক নিজে গাড়িচালক হলেও মহাপরিচালকের জন্য বরাদ্দকৃত একটা সাদা পাজেরো জিপ গাড়ি (নং ঢাকা মেট্রো গ-১৩-২৯৭৯) নিয়মিত ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করে থাকে। মহাপরিচালকের জন্য বরাদ্দকৃত পাজেরো গাড়ি ছাড়াও স্বাস্থ্য অধিদফতরের আরও দুটি গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করত। এরমধ্যে একটি পিকআপ গাড়ি (ঢাকা মেট্রো ঠ-১৩-৭০০১) তিনি নিজের গরুর খামারের দুধ বিক্রি এবং মেয়ের জামাইয়ের পরিচালিত ক্যান্টিনের মালামাল পরিবহনের কাজে ব্যবহার করত। অপর একটি মাইক্রোবাস (নং ঢাকা মেট্রো চ-৫৩-৬৭৪১) স্বাস্থ্য অধিদফতরে কর্মরত তার পরিবারের অন্য সদস্যরা ব্যবহার করত। স্বাস্থ্য অধিদফতরে তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী হলেও মালেকের ক্ষমতার দাপটে অনেক কর্মকর্তা অসহায় ছিল। সূত্রগুলো জানায়, স্বাস্থ্য অধিদফতরে ড্রাইভার্স এ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠন তৈরি করে নিজে সেই সংগঠনের সভাপতি হয়েছে। এই পদের ক্ষমতাবলে সে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ড্রাইভারদের ওপর একছত্র আধিপত্য কায়েম করেছে। ড্রাইভারদের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির নামে তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করত। এছাড়া তিনি স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক প্রশাসনকে জিম্মি করে বিভিন্ন ডাক্তারদের বদলি ও পদোন্নতি এবং তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ড্রাইভার মালেক তার মেয়ে নৌরিন সুলতানা বেলিকে অফিস সহকারী পদে, ভাই আব্দুল খালেককে অফিস সহায়ক পদে, ভাতিজা আব্দুল হাকিমকে অফিস সহায়ক পদে, বড় মেয়ে বেবির স্বামী রতনকে ক্যান্টিন ম্যানেজার হিসেবে, ভাগ্নে সোহেল শিকারিকে ড্রাইভার পদে, ভায়রা মাহবুবকে ড্রাইভার পদে, নিকট আত্মীয় কামাল পাশাকে অফিস সহায়ক পদে স্বাস্থ্য অধিদফতরে চাকরি দিয়েছে। সূত্রগুলো জানায়, স্বাস্থ্য অধিদফতরে সিন্ডিকেট করে সীমাহীন দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা অবৈধভাবে আয় ও বিদেশে পাচার এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের উপ-পরিচালক মোঃ সামছুল আলম গত বছরের ২২ অক্টোবর তাকে দুদকে তলব করেন। তবে তার বিরুদ্ধে দুদক এখনও অনুসন্ধান শেষ করতে পারেনি। ১৪ দিনের রিমান্ড ॥ অবৈধ অস্ত্র ও জালনোটের কারবার এবং চাঁদাবাজির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিবহন পুলের গাড়িচালক আব্দুল মালেক ওরফে বাদল ওরফে ড্রাইভার মালেকের (৬৩) বিরুদ্ধে দু’টি মামলা দায়ের করেছে র‌্যাব। সোমবার রাজধানীর তুরাগ থানায় র‌্যাবের এক কর্মকর্তা বাদী হয়ে দু’টি মামলা দায়ের করে। তুরাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুরুল মুত্তাকিন জানান, গাড়িচালক আব্দুল মালেকের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে একটি এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনে আরও একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। দু’টি মামলাই র‌্যাব বাদী হয়ে করেছে। এদিন দুপুরে তুরাগ থানার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই রুবেল শেখ সুষ্ঠু তদন্তের প্রয়োজনে অবৈধ অস্ত্র ও জাল টাকার ব্যবসার মামলায় সাত দিন করে মোট ১৪ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে আদালতে হাজির করেন মালেক ড্রাইভারকে। এ সময় আসামি পক্ষের আইনজীবী জিএম মিজানুর রহমান রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিনের আবেদন করেন। রাষ্ট্রপক্ষ ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু এর বিরোধিতা করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে বিচারক ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শহিদুল ইসলাম আসামি মালেককে ১৪ দিনের রিমান্ডে আদেশ দেন। এর আগে আব্দুল মালেককে দুপুর ২টায় আদালতে হাজির করা হয়। এরপর তাকে হাজতখানায় রাখা হয়। বেলা ৩টায় মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রট আদালত- ৭ এর এজলাসে হাজির করা হয় তাকে। তারপর শুনানি শুরু হয়। র‌্যাবের পরিচালক (মিডিয়া) লেঃ কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, ড্রাইভার মালেকের বিরুদ্ধে অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা, জাল টাকার ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। সে তার এলাকায় সাধারণ মানুষকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে শক্তির মহড়া ও দাপট প্রদর্শনের মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে এবং জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। মালেক সাময়িক বরখাস্ত ॥ বিডিনিউজ জানায়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়িচালক আব্দুল মালেককে সাময়িক বরখাস্ত করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সোমবার তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ এবিএম খুরশীদ আলম জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এটা ২০১৯ সালের ঘটনা। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের আগেরই মামলা ছিল। এই অভিযোগের ভিত্তিতেই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। আর সে আমাদের অধিদফতরে ছিল না, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরে ছিল। সোমবার তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (এমআইএস) ডাঃ মোঃ হাবিবুর রহমান জানান, সোমবার প্রশাসন শাখা থেকে আব্দুল মালেকের বরখাস্তের আদেশ জারি হয়। তিনি বলেন, কোন সরকারী কর্মচারী যদি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় বা পুলিশের হেফাজতে যায় বা জেলে যায় তাহলে তাকে মহাপরিচালক সাময়িক বরখাস্ত করতে পারেন। সোমবার তাকে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ জারি করেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত এই মামলা নিষ্পত্তি না হবে ততক্ষণ সাময়িক বরখাস্তের আদেশ বহাল থাকবে।
×