ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গণপূর্তে শুদ্ধি অভিযান ॥ সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনা হচ্ছে

প্রকাশিত: ২২:০৯, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০

গণপূর্তে শুদ্ধি অভিযান ॥ সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনা হচ্ছে

ফিরোজ মান্না ॥ গণপূর্ত অধিদফতরে চলছে শুদ্ধিকরণ কর্মসূচী। অনিয়ম দুর্নীতির দায়ে গত কয়েক মাসে ১৪ কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে ‘সাসপেন্ড’ করা হয়েছে। দীর্ঘদিন এক জায়গায় থাকা অনেক কর্মকর্তার দফতর বদল করে দিয়েছে। যাতে আর কোন দিন ‘বালিশ কান্ডের’ মতো ঘটনা না ঘটে। বালিশকান্ডে যারা জড়িত তাদের যেসব কর্মকর্তা সহযোগিতা দিয়েছে এমন ৩৪ কর্মকর্তার মধ্যে বর্তমানে অনেকেই জেলে আছেন। বাকিরা জামিনে রয়েছেন। এদের বিচার হবে। বহুল আলোচিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রে পাহাড় সমান দুর্নীতি আর করতে দেয়া হবে না। গণপূর্ত বিভাগের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। এ জন্য একটি দুর্নীতিবিরোধী কমিটি গঠন করা হয়েছে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও গণপূর্ত বিভাগ এ তথ্য জানিয়েছে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, দুর্নীতি দমনে আমরা ‘জিরো টলারেন্স’ অবস্থান নিয়েছি। গণপূর্ত বিভাগের অসৎ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া শুরু করা হয়েছে। যারা বালিশকান্ডের সঙ্গে যুক্ত তাদের বিরুদ্ধে বিচার চলছে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। দুর্নীতিবাজ ঠিকাদারদের বিরুদ্ধেও চলছে অভিযান। যারা প্রভাব খাটাতে যাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য গণপূর্ত অধিদফতরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ রয়েছে কোন দুর্নীতিতে সহ্য করা হবে না। দুর্নীতি মুক্ত দেশ গড়তে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। গণপূর্ত বিভাগ সরকারী কাজ করে। তারাই যদি সরকারের ক্ষতির কারণ হয় তা মেনে নেয়া যায় না। অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে গণপূর্ত বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, গণপূর্ত বিভাগে শৃঙ্খলা ফেরাতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি গোপনে কাজ করছে। কোন কর্মকর্তা কি ধরনের অনিয়ম করছেন তার রিপোর্ট আমার কাছে দিচ্ছে। রিপোর্ট অনুযায়ী আমি অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। ইতোমধ্যে কয়েকজন কর্মকর্তা কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কয়েকজন কর্মকর্তার রিপোর্ট আমার কাছে এসেছে। অচিরেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বালিশকান্ডের মতো আর কোন ঘটনা যাতে না ঘটে সে বিষয়ে আমি কাজ করে যাচ্ছি। রূপপুরের ঘটনা গণপূর্ত বিভাগের ভাবমূর্তিকে অনেক ক্ষুণ্ণ করেছে। গণপূর্তের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সব কর্মকর্তা কর্মচারীকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হচ্ছে। কেউ দুর্নীতি ও অনিয়ম করলে তার বিরুদ্ধেই কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। সূত্র জানিয়েছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রে ৩৪ কর্মকর্তা ও তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করে দুদুক মামলা করেছে। ওই ঘটনায় ১৩ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়। তারা এখন জেল হাজতে আছেন। বাকি কর্মকর্তারা জামিনে বের হয়ে গেছেন। জেলখানায় থাকা ১৩ কর্মকর্তা হলেন পাবনা গণপূর্ত বিভাগের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুল আলম, উপ-সহকারী প্রকৌশলী জাহিদুল কবীর, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মোস্তফা কামাল, উপ-সহকারী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আহমেদ সাজ্জাদ খান, এস্টিমেটর ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী সুমন কুমার নন্দী, সহকারী প্রকৌশলী মোঃ তারেক, সহকারী প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম, উপ-সহকারী প্রকৌশলী আবু সাঈদ, উপ-সহকারী প্রকৌশলী রওশন আলী ও উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী তাহাজ্জুদ হোসেন এবং মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী আসিফ হোসেন ও সাজিন কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী শাহাদত হোসেন। দুদুকের তদন্তে দেখা গেছে একটি বালিশের পেছনে ব্যয় করা হয়েছে ৬ হাজার ৭১৭ টাকা। এর মধ্যে দাম বাবদ ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা আর বালিশটি নিচ থেকে ফ্ল্যাটে ওঠাতে ৭৬০ টাকা খরচ উল্লেখ করা হয়েছে। একটি বৈদ্যুতিক চুলা কেনায় খরচ দেখানো হয়েছে ৭ হাজার ৭৪৭ টাকা আর তা নিচ থেকে ফ্ল্যাটে তুলতে লেগেছে ৬ হাজার ৬৫০ টাকা। একটি ইলেকট্রিক কেটলি কেনা হয়েছে ৫ হাজার ৩১৩ টাকায় এবং তা ফ্ল্যাটে নিতে লেগেছে ২ হাজার ৯৪৫ টাকা। একইভাবে একটি কক্ষ পরিষ্কারের মেশিন কিনতে ১২ হাজার ১৮ টাকা এবং ফ্ল্যাটে ওঠাতে ৬ হাজার ৬৫০ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের দুর্নীতি নিয়ে ওই সময় বিবিসি দেয়া এক সাক্ষাতকারে ‘দিনে-দুপুরে ডাকাতি’ বলে বর্ণনা করেছিলেন সরকারের কৃষিমন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক। এসব দুর্নীতির কারণে ক্ষমতাসীন দলের জন্য ‘রাজনৈতিক মূল্য’ অনেক বেশি দিতে হয়। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রে কর্মরতদের জন্য আবাসিক এলাকায় আসবাবপত্র কেনাকাটায় ব্যাপক দুর্নীতির বিষয়টি ছোট করে দেখার কিছু নেই। তিনি তখন বলেছিলেন, এতে সরকার এবং দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সরকার ভীষণ উদ্বিগ্ন বলে উল্লেখ করেন। আমাদের যত অর্জন সাফল্য সবই ম্লান হয়ে যাচ্ছে, সব ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে। সরকারের অনেক সাফল্যে কালিমা লেপন করা হয়েছে। রূপপুরের ঘটনার পর থেকে গণপূর্ত অধিদফতর দেশের মানুষের কাছে একটি নেতিবাচক নাম হিসেবে পরিচিতি পায়। এই পরিচিতি দূর করতে গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন, দুটি কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে যে ৩৪ কর্মকর্তা বা ব্যক্তি এ ঘটনায় নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত তাদের বিষয়টি আদালতের এখতিয়ারে রয়েছে। এখন যাতে এ ধরনের কোন ঘটনা না ঘটে সেই বিষয়ে গণপূর্ত বিভাগ সচেতনভাবে কাজ করছে। সূত্র জানিয়েছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চারটি ভবনে আসবাব ও ইলেক্ট্রনিক পণ্য সরবরাহের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- সাজিন এন্টারপ্রাইজ, মাজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন লিমিটেড ও জিকেপিবিএল-পায়েল-এইচএল কনসোর্টিয়াম। সাজিনের সরবরাহ করা মালামাল সব থেকে নিম্নমানের। সাজিন একাই পেয়েছে ১৪৬ কোটি টাকার তিনটি কাজ। মাজিদ সন্স কনস্ট্রাকশনের সরবরাহ করা মালামাল সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘স্পেসিফিকেশন’ অনুযায়ী সরবরাহ করেনি। তবে জিকেপিবিএল-পায়েল-এইচএল কনসোর্টিয়ামের সরবরাহ করা মালামাল সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘অপেক্ষাকৃত ভাল’। এদের মধ্যে সাজিন এন্টারপ্রাইজের মালিক শাহাদাত হোসেনের সঙ্গে পাবনা সদর আসনের সাংসদ গোলাম ফারুক খন্দকারের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। প্যাকেজে মোট ১৪৬ কোটি টাকার মধ্যে সাজিন এন্টারপ্রাইজ তিনটি কাজ পেয়েছে। একটি কাজ পেয়েছে মজিদ সন্স লিমিটেড। সাজিন এন্টারপ্রাইজের তিনটি কাজের মধ্যে একটি ২৯ কোটি ১৪ লাখ টাকার বিল গত বছরের অক্টোবরে পরিশোধ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে জিকে শামীমের মালিকানাধিন জিকেপিবিএল রয়েছে। বালিশকান্ডে পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র প্রকল্পের অধীনে গ্রিন সিটি আবাসিক প্রকল্পের জন্য আসবাবপত্র ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয়ে অস্বাভাবিক দুর্নীতির ঘটনা দেশব্যাপী পরিচিতি পায় রূপপুরের বালিশকা- হিসেবে। এতে গণপূর্ত বিভাগের বড় বদনাম হয়। সেই বদনাম মুছে ফেলার চেষ্টা চলছে। বর্তমানে গণপূর্ত বিভাগ সেই কাজটি করে যাচ্ছে।
×